মোরাপাড়া ও বাসুদেবপুরের যুদ্ধ, ভোলা
এই যুদ্ধে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে রেকি করা হয়। ২২ নভেম্বর ১৯৭১-এ ৮ গার্ডস কর্তৃক প্রথমে নোয়াপাড়া ও পরের পর্বে মোরাপাড়া আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী ৮ গার্ডস ঘাসুরিয়াতে ফার্ম বেজ স্থাপন করে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে অতি সন্তর্পণে সে কোম্পানি নোয়াপাড়া আক্রমণ করে রাত ৮টায়। অনেক জলাশয়, পুকুর এবং কর্দমাক্ত ও সিক্ত ভূমি পেরিয়ে এই আক্রমণ সার্থক হয়। রাতের অন্ধকারে নোয়াপাড়া শত্রু পজিশন অক্ষত থাকে। এরপর এ ও বি কোম্পানি রাত ১.৩০ মিনিটে মোরাপাড়া আক্রমণ করে। বিন্যাস এলাকা অতিক্রমের পরপরই তারা আর্টিলারি ফায়ারসহ সকল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে ফায়ারের সম্মুখীন হয়। মন্থর হয়ে যায় আক্রমণের গতি এবং নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ‘এ’ কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার ও উপ-অধিনায়ক শহীদ হন। কোম্পানির মাত্র ৫০ জন দক্ষিণ এবং পশ্চিম মোরাপাড়াতে প্রতিরক্ষা অবস্থানে সম্মুখ সমরে (Close combat) –এ পৌঁছে। ‘বি’ কোম্পানি উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আক্রমণে অনুরূপ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কোম্পানি দক্ষিন-পূর্ব পাশ দখল করলেও গ্রাম শত্রুমুক্ত হয় না। এ পর্যায়ে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ৪র্থ কোম্পানিকে গ্রাম শত্রুমুক্ত করার জন্য আক্রমণে তলব করে। দ্রুতগতিতে ভয়ংকর এক যুদ্ধ শেষে ‘এ’ কোম্পানি উত্তর এবং পশ্চিমে কিছু জায়গা দখল করলেও ফলাফল আসে না। ভোর রাতে সম্মুখ সমরে এই কোম্পানি কমান্ডারও শহীদ হন। এ পর্যায়ে ব্রিগেড কমান্ডার ৫ গারওয়ালের একটি কোম্পানি প্রেরণ করে বাসুদেবপুর বিওপি দখলের জন্য। এদিকে মোরাপাড়া পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না। দিনের আলোতে আক্রমণকারীদের সাহায্যের জন্য প্রেরিত ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন সিক্ত, কর্দমাক্ত ও নরম ভূমির অন্য অগ্রসর হতে পারে না। এ পর্যায়ে ৫ গারওয়াল ও গার্ড, শত্রুর ব্যাপারে আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য পেট্রোলিং পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তারা মোরাপাড়াস্থ কোম্পানির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। অধিনায়ক দ্রুততার সাথে এই সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে মোরাপাড়া দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তানী একটি কোম্পানি পাল্টা আক্রমণ রচনার জন্য মোরাপাড়ার দিক অগ্রসর হয়। ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারির মুহুর্মুহু ফায়ারে সবাই হতবিহব্বল হয়ে দৌড়ে পালায়। এর মধ্য হযরত আলী ও আজিজুল হক শেষের দিকে পূর্ব দিকে এসে ক্লান্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে থেক দুটি রাইফেল ও গুলি নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে গাছের আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকে। পাকবাহিনী ক্রমান্বয়ে পিছু হটতে হটতে একপর্যায়ে বাগানের ভেতরে ঢুকে যায়। পাকবাহিনী নিহতদের লাশ পেছনে ফেলে কোনোমতে আহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানী এক সুবেদার গুলি করতে করতে পেছনে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখে তার চাইনিজ রাইফেলের গুলি শেষ হয় গেছে। উপায়ন্তর না দেখে সে ভুলে উত্তর দিকে না গিয়ে পূর্ব দিকে দৌড় দেয়। হযরত আলী পালিয়ে যাওয়া সুবেদারটির পিছু ধাওয়া করে এবং আরো পূর্বে এসে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। এদিকে পাকবাহিনী দৌড়ে এসে খেয়াঘাটে উপস্থিত হয়। ইতিমধ্যে স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ স্বউদ্যোগে যেসব নৌকা করে পাকবাহিনী এপারে এসেছিল তার মধ্যে দুটি নৌকা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে আসা পাকবাহিনী রাইফেলের মুখে আশপাশ থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে আনে এবং বেঁচে যাওয়া রাজাকারদের দিয়ে ডোবানো নৌকাগুলো উঠিয়ে বোরহানউদ্দিনের এ পাড়ে চলে আসে। সুস্থ রাজাকারদের বোরহানউদ্দিন থানায় রেখে আহতদের নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে সরাসরি ভোলা সদরে ওয়াপদা ক্যাম্পে চলে আসে। এই যুদ্ধে আটজন রাজাকারসহ মোট ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরে খবরে জানা যায়, পালিয়ে যাওয়া আহতদের সংখ্যা ছিল ২২ জন। দেউলার এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুধু ভোলা দ্বীপে নয়, দেশের জন্য কোথাও ১৬টি ৩০৩ রাইফেল দিয়ে চারটি লাইট মেশিনগান, চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেলসহ সুসজ্জিত, আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীকে এভাবে পরাজিত করেছে-এ ধরনের ঘটনা আমার জানা নেই ওই সময়ের পেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকবাহিনী তথ্য সংগ্রহ করেই আক্রমণে এসেছিল; কিন্তু অল্প কয়টি রাইফেল নিয়ে ৮০ জনের একটি আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত দলকে আক্রমণ করবে এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। একদিকে তারা দেউলা প্রবেশের পরে তালুকদার বাড়ি পর্যন্ত কোথাও কোনো রেসিসটেন্স না পাওয়ায় আক্রমণের আশঙ্কা তাদের মন থেকে সরে যায়। ফলে আক্রান্ত মুহূর্তে তারা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের প্রধান কারণ হলো তাদের অ্যাম্বুশের অবস্থান। অত্যন্ত উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশই মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি, ৮০ জনের আধুনিক অস্ত্র ও প্রচুর গুলি থাকা সত্ত্বেও পাকবাহিনী বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আরো একটি দিক হলো মুক্তিযোদ্ধারা অসম সাহসিকতায় স্থান বদল করে ক্রমাগত বিভিন্ন অবস্থান থেকে আক্রমণ করায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুমানে ব্যর্থ হয়ে মনোবল হারিয়ে পালিয়ে যায়। ভোলায় গিয়ে পাকবাহিনী যে রিপোর্ট করে তাতে তারা কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলে উল্লেখ করে। এই যুদ্ধে পাঁচটি গুলিবিহীন চাইনিজ রাইফেল, আটটি ৩০৩ রাইফেল ও এক পেটি ৩০৩ রাইফেলের গুলি পাওয়া যায়। সেদিন সন্ধ্যায় উত্তর-পূর্ব দিকে এক চাষীর বাড়িতে ঘরের মাচায় পাওয়া যায় এক পাক মিলিশিয়াকে। গোলাগুলির সময় সে প্রাণভয়ে অস্ত্র হারিয়ে পালিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওই বাড়ির লোকজনও তখন গোলাগুলির শব্দে পালিয়ে বাড়িছাড়া। খালি বাড়িতে সে ঢুকে একঘরের মাচায় উঠে বসে থাকে। ওই মিলিশিয়ার পায়ে গুলি লেগে আহত হয়েছিল। শেষ বিকেলের দিকে বাড়ির লোকজন ঘরে ফিরে আসে। এক সময় তারা মাচার ওপর নড়াচড়ার শব্দ পায়। ব্যাপার কি দেখার জন্য উপরে উঠে দেখে এক পাকসেনা। ভয়ার্ত চিৎকারে বাড়ির লোকজন লাঠি, দা, বল্লম, নিয়ে একত্র হয়। তাদের চিৎকারে আশপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন ছুটে আসে। এর মধ্যে কয়েকজন সাহস করে মাচায় উঠে মিলিশিয়াটিকে ধরে উঠানে নিয়ে আসে। আহত হওয়ার কারণে আগেই অর্ধমৃত ছিল। গণপিটুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। এমনো শোণা যায়, ওই বাড়ির এক বুড়ি হাতের কাছে কিছু না পেয়ে খুন্তি দিয়েও দু-চার ঘা দেয়। এ ঘটনা থেকে তৎকালীন সময়ের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল এটাই তার বহিঃপ্রকাশ। রাতের মধ্যেই পাকবাহিনী ও রাজাকারদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
[৫৯৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত