You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোহামায়া রেলওয়ে ব্রিজে উল্কা ট্রেন অপারেশন, চট্টগ্রাম

মিরসরাই ও মস্তাননগর রেলস্টশনের মধ্যবর্তী স্থানে মোহামায়া নালার (ছড়ার) উপর একটি রেলওয়ে ব্রিজ অবস্থিত। এই ব্রিজের উপর ১ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে ঢাকাগামী উল্কা ট্রেনে গেরিলা অপারেশন পরিচালিত হয়। এই সময় এই রেলপথে উল্কা দ্রুতগতির এবং সাধারণ মানুষের নিকট আকর্ষণীয় রেলগাড়ি ছিল। মোহামায়া রেলওয়ে ব্রিজ এবং এর উপর উল্কা নামের গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ্যে আকর্ষণীয় ট্রেনকে একসাথে ধ্বংস করে রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদিভাবে বিচ্ছিন্ন, ট্রেনযাত্রী পাকসেনাদের হতাহত ও তাদের যুদ্ধের সরঞ্জামাদি বিনষ্ট এবং শত্রুপক্ষসহ মুক্তিকামী এলাকাবাসীকে মুক্তিযোদ্ধাদের অমিতশক্তি প্রদর্শণ করা। কমান্ডার নিজাম, সহকারী কমান্ডার জাহাঙ্গীর (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), শাহাজাহান-১, শাহাজাহান-২ (খুলনা), মোঃ সফি, সলিমুদ্দিন, লোকমান এবং আরো কয়েক সহযোগীসহ ১ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অপারেশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা দেন। তাঁদের সাথে ছিল দুইটি এল এম জি , চারটি স্টেনগান, চারটি এস এল আর, দুইটি গ্রেনেড, দুইটি পিস্তল এবং একটি সিগন্যাল পিস্তল। এছাড়াও তাঁদের সাথে ছিল ২৫০ পাউন্ড বিস্ফোরক, জি ই সি এবং পি ই কে স্ল্যাব (প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ) আনুমানিক ১০০ পাউন্ড, পুল সুইচ মার্ক-৪ এবং ৪০০ গজ ডেটোনেটর কর্ড। রাত সাড়ে ১১টায় তাঁরা পথিমধ্যে বিশ্রাম নেন। পি ই কে বিস্ফোরক দ্রব্যাটি প্লাস্টিক কভার থেকে খুলে রুটি বানানোর মতো মলে সবগুলোকে একসাথে করেন। তারপর এটাকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। ব্রিজের গোড়া বা রেল লাইনের নিচের পাথর সরানো ও মাটি খুঁড়ে গর্ত করার জন্য স্থানীয়ভাবে কোদাল, শাবল, দা ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। এভাবে প্রস্তুতি নিতে তাঁদের দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লেগে যায়। পরে তাঁরা রাত আনুমানিক আড়াইটায় ঐ বাড়ি থেকে অপারেশনর জন্য প্রস্তুত করা জিনিসপত্র নিয়ে উদ্দিষ্টস্থানে রওয়ানা দেন। বর্ষাকাল এবং বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। অপারেশন স্থান থেকে ২০০ গজ দূরে থাকতেই তাঁরা দেখতে পান যে, পাকসেনারা একটি রেলগাড়িতে করে চারদিকে সার্চলাইট দিয়ে আশেপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করছে। এটা ছিল পাকসেনাদের রুটিন টহল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তা জানা ছিল না। তখন রাত আনুমানিক ৩টা। রেলগাড়িটি চলে গেলে তাঁরা মোহামায়া ব্রিজের ওপর ওঠেন। এখানে কালবিলম্ব না করে আগে থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ বিস্ফোরক দ্রব্যাদি স্থাপনের কাজে লেগে যান। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ অনুযায়ী নির্দিষ্ট অবস্থান নেন। একটি বিচ্ছিন্নকারী দল বা ‘কাট অফ পার্টি’ ব্রিজের উত্তরে রাখা হয়। তাঁদের সাথে ছিল একটি স্টেনগান ও এসএলআর। অন্য বিচ্ছিন্নকারী দলটি ব্রিজের দক্ষিণে রেললাইনসংলগ্ন স্থানে অবস্থান নেয়। এই পার্টির সাথেও পূর্বোক্তসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়। মূল দলকে ব্রিজের পশ্চিমে ছড়ার দক্ষিণে রাখা হয়। তাঁদের সাথে ছিল একটি এলএমজি ও একটি এসএলআর। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ব্রিজের পশ্চিমে আনুমানিক ২০০ গজ দূরে ছড়ার উত্তরপাড় দিয়ে যাওয়া রাস্তার পাশে আখক্ষেতে পজিশন নেয়। এখানে পার্টি রাখার উদ্দেশ্য ছিল যাতে পশ্চিম দিক থেকে আসা রাস্তা দিয়ে কেউ রেললাইনের দিকে যেতে না পারে। কমান্ডার নিজাম ব্রিজের পশ্চিমে ১০০ গজ দূরে ছড়ার দক্ষিণে অবস্থান নেন। ভোর পাঁচটার মধ্যে বীর্যের চারকোণায় রেললাইনের নিচে এক্সপ্লোসিভ স্থাপিত এবং ডেটোনেটর কার্ড দিয়ে চারটি এক্সপ্লোসিভকে একসাথে যুক্ত করা হয়। প্রধান কর্ড কমান্ডার নিজামের কাছে রাখা হয়। উল্লেখ, ডেটোনেটর কর্ডগুলো চার ইঞ্চি গর্ত করে মাটির ভেতর দিয়ে টেনে আনা এবং প্রধান কর্ডের সাথে পুলসুইচ সংযুক্ত হয়। আনুষাঙ্গিক অন্য কাজ শেষ হলে কমান্ডার নিজামের নির্দেশ মতো কাট অফ পার্টি দুটো পশ্চাদপসরণ করে আশ্রয়কেন্দ্র মাতব্বরহাটে ফিরে যায়। অপারেশন স্থানে ছিলেন শুধু অ্যাম্বুশ পার্টিসহ কমান্ডার নিজাম। এরপর তাঁরা স্থানীয় একটি পরিচিত বাড়িতে হাতমুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেন। ব্রিজের আশেপাশের মাঠ আউশ ধানের চাষ করা হয়েছিল এবং ধান গাছগুলো ছিল আনুমানিক দু’হাতের মতো লম্বা। ধানগাছগুলো থাকায় পর্যাপ্ত কাভার নিয়ে লুকিয়ে থাকাও সহজ ছিল। নাস্তা শেষ করে কমান্ডার নিজাম একাই রেললাইনের ওপর ওঠেন। তখন সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা। তিনি ব্রিজের আশেপাশে কৃষিকাজে নিয়োজিত পরিচিত চাষিদের ইশারা দিয়ে সরে যেতে বলেন। অবশ্য অচেনা চাষিদের গোপনীয়তা স্বার্থে কিছুই বলেননি। এরপর তিনি রেললাইনের দক্ষিণদিকে তাকাতেই দেখতে পান, মিরসরাই রেলস্টেশনের একটি ট্রেন দাঁড়ানো। তিনি সময়ের হিসাব অনুযায়ী ধারণা করেন একটা উল্কা ট্রেন নয়। কারণ, এই ট্রেন সকাল সাতটায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ছাড়ে এবং মিরসরাই রেলস্টেশনে পৌঁছাতে সকাল সাতটা পঞ্চাশ হবার কহা। উপরস্তু মিরসরাই স্টেশনে এই উল্কা ট্রেনের স্টপেজ নেই। তবু তিনি তাঁর এ্যাকশন পয়েন্টে চলে যান। দশ মিনিট পর তিনি দেখতে পান, মিরসরাই স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটি শুধু একটি ইঞ্জিন ও চারটি খোলা বগি (গাড়ি বা অস্ত্রশস্ত্র বহন করার বগি) নিয়ে ব্রিজ অতিক্রম করে উত্তর দিকে অর্থাৎ ঢাকার দিকে যাচ্ছে। কমান্ডার নিজাম বুঝতে পারেন, এটি একটি Testing Train বা শাটল ট্রেন যা রেললাইন ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করার কাজে ব্যবহৃত হয়। এজন্য তিনি কোনো এ্যাকশন না নিয়ে লুকিয়ে থাকেন এবং অ্যাম্বুশ পার্টিকেও তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোনো এ্যাকশনে না যাওয়ার সুপষ্ট নির্দেশ দেন। ট্রেনটি ছলে যাবার দশ মিনিট পর আবার তিনি রেললাইনের উপর ওঠেন। দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে দেখতে পান একটি ট্রেন আসছে এবং শব্দও শোনা যাচ্ছে। একই ট্রেনটির আগমনের সময়ের সাথে তাঁর প্রত্যাশিত ট্রেনের সময়ের প্রায় মিল হওয়ায় তিনি বুঝতে পারেন, এটাই তাঁদের টার্গেট অর্থাৎ ‘উল্কা এক্সপ্রেস’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ্যাকশন পয়েন্টে গিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আদেশ দেন। দেখতে দেখতে ট্রেনটি তাঁর টার্গেত পয়েন্টে এসে উপস্থিত হলে অর্থাৎ ইঞ্জিন ব্রিজের অর্ধেক অতিক্রম করামাত্রাই তিন ‘পুল সুইচ’-এ টান দেন। সাথে সাথেই স্থাপিত এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরিত হয়। ব্রিজের এলাকা ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে যায়। রেললাইনের পাথর চারদিকে বুলেটের মতো ছুটতে থাকে। এই অবস্থায় তিনি পশ্চাদপসরন করেন এবং অ্যাম্বুশ পার্টিকেও পশ্চাদপসরণের আদেশ দেন। তারপর তাঁরা নিরাপত্তার জন্য গ্রামের পরিচিত চাষিদের কাছ থেকে লাঙল ও জোয়াল নিয়ে শরীরে কাদা লাগিয়ে কৃষক সেজে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড অতিক্রম করেন। ক্ষয়তক্ষতিঃ পরে জানা গেছে এই অপারেশনে ১০ জনের মতো পাকসেনা মারা যায় এবং ৫ জন আহত হয়। উল্কা ট্রেনের সাতটি বগি ইঞ্জিনসহ খাদে পড়ে যায়। কিছু নিরীহ যাত্রীও মারা যায়।
[৫৯৭] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!