You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুশরীভূজা প্রতিরোধ ও কাশিয়াবাড়ী কাউন্সিল অপারেশন

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট (১৮ শ্রাবণ) সোমবার সকালে কাশিয়াবাড়ীর কাশেম ও পঞ্চনন্দপুরের আফসার থানা ভবনে খবর দিলে যে, আজ পাকবাহিনী আসবে। মুক্তিবাহিনীর ২০/২৫ জনের একটি টহল দল প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বের হয়। এই দলের কমান্ডার হিসেবে ছিলেন আ. রাজ্জাক, রাজা মিয়া, আতাউর (শিবগঞ্জ) ও ওয়ারিশ মোল্লা। মুক্তিবাহিনী এই লড়াকু টহল দল মুশরীভূজা ক্যানেলে আবার পাকবাহিনীর মুখোমুখী হয়। বেলা ১টার দিকে পাকবাহিনীর সাথে গুলিবিনিময় শুরু হয়। প্রায় ঘন্টাখানেক লড়াই চলার পর আর্টিলারি মান্নানের ২ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ফলে পাকবাহিনীর ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। এই দিন পাকবাহিনীর চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ৪০ জনের মতো পাকফৌজ নিহত হয়। ৪টি গরুর গাড়ি করে লাশ বহন করে নিয়ে যায়। মেজর সাজ্জাদকে তাঁরা চৌকিতে অরে নিয়ে যায়। ওপর দিকে মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স উইথড্র করে আদালতলাতে ওঠে আসে। এ দিকে মুশরীভূজায় পাক প্রতিরোধের খবর থানা ভবনে পৌঁছার পর ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মুশরীভূজা অভিমুখে রওয়ানা হন। আদাতলায় সাত্তার তেলীর বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধা খাওয়া-দাওয়া সেরে বেলা ৩টার দিকে আবার মুশরীভূজা ক্যানেলে ডিফেন্স স্থাপন করে। এরপর নামো মুশরীভূজা টিউবওয়েলের মিস্ত্রি আ. শুকুরকে রেকি হিসেবে ছাড়া হয়। তিনি সংবাদ দেন যে, পাকবাহিনী নেই। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স উইথড্র করে সামনে অগ্রসর হন। এভাবে, আ. শুকুর সামনে রেকি করেন আর মুক্তিবাহিনী সামনে অগ্রসর হয়। ঘাইবাড়ী ওয়াপদা পার হয়ে সামনে কাশেম এসে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেন যে, “পাকফৌজ রহনপুরে চলে গেছে; কয়েকজন রাজকার কাশিয়াবাড়ী কাউন্সিলে আছে”। মুক্তবাহিনী কাশিয়াবাড়ী অভিমুখে রওয়ানা হয়। তাঁরা কাশিয়াবাড়ি মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে তাহের মিয়ার বাড়িতে দেখতে পান একটি পাকিস্তানী পতাকা উড়ানো এবং পতাকাসহ বাড়ীটি কাগজের ফুলের মালা দিয়ে সাজানো আছে। মুক্তিযোদ্ধারা পতাকাসহ বাড়ীটি গুলি বর্ষণ করে তছনছ করে দেন। তাহের মিয়ার বাড়ি থেকে কাউন্সিলের দূরত্ব ছিল প্রায় ১ শ’ গজ। ওই কাউন্সিলের উত্তরে একটি রাইস মিল ছিল। মুক্তিযোদ্ধা সেখান থেকে কাউন্সিলের অবস্থান ও রাজাকারদের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর একটি কভারিং দল কাশিয়াবাড়ী বাকের কাছে ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে অবস্থান গ্রহণ করে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় সাহসিকতার সাথে কাউন্সিল ঘেরাও করে। মুক্তিবাহিনীর আগমন টের পেয়ে কাউন্সিল ঘর থেকে দু’জন রাজাকার ত্বরিৎ পালিয়ে যায়। কিন্তু কুখ্যাত রাজকার আ. খালেক (মুজাহিদ বাহিনীর সুবেদার) পাকবাহিনীর রহনপুর সেনা ছাউনিতে টেলিফোনে মুক্তিবাহিনীর আগমনের খবর দিতে থাকে। রাজাকার আ. খালেক মুক্তিবাহিনীর আগমনের খবর দিয়ে পাকবাহিনীকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার আহবান জানাচ্ছিল। বীরযোদ্ধা আফসার (মান্দা থানা) খোলা জানলার ফাঁক দিকে এস, এম, সি’র গুলি ছুঁড়ে রাজাকার খালেককে হত্যা করেন। গুলি ছুঁড়েই মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে কভারিং দলের কাছে ফিরে আসেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজাকার খালেককে মেঝেতে পড়ে যাবার শব্দ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নিহত হবার বিষয়ে নিশ্চিত হন। রাজাকার খালেক পাকবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিলে এবং সেট বসানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা খালেকের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। তাঁর সাথে ওই ঘর থেকে রাজাকারদের ব্যবহৃত ১টি ষ্ট্যান্ডগান, ১টি রাইফেল, ১টি সিভিলগান, ২ বক্স গুলি, ১টি রেডিও সেট, ১টি টেলিফোন সেট জব্দ করে। মুক্তিবাহিনী খালেকের লাশ গরুর গাড়ীতে করে ভোলাহাট নিয়ে যাবার সময় পাকবাহিনী রহনপুর থেকে পরপর ৬টি শেল নিক্ষেপ করে কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শেলগুলো বিলে গিয়ে পড়ে। সেদিন পাকবাহিনী তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দরুন এতই-ভীত-সস্ত্রস্ত ছিল যে তাদের দোসরদের রক্ষা করতে নদী পার হয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলা করার সাহস করেনি। এই অপারেশনের সময় রাজাকারদের একটি দল কাশিয়াবাড়ী বাঁকের পূর্বে নদীর ধারে লুকিয়ে পজিশনে ছিল, তারা ভয়ে ফায়ার ওপেন করতে সাহস পায়নি। উল্লেখ্য, কাউন্সিল অপারেশন ও খালেককে হত্যার পেছনে মান্দার আফসার , নামো মুশরীগভূজার আ. শুকুর, নবাবগঞ্জের কসিমুদ্দিন, পঞ্চনন্দপুরের আফসার বাহাদুরগঞ্জের হাসিমুদ্দিন, গোপীনাথপুরের আ. রাজ্জাক রাজা, রাধানগরের সাজেদ আলী দুঃসাহসীকতার পরিচয় দেন। মুক্তিবাহিনী রাজকার খালেকের লাশ ভোলাহাট অভিমুখে নিয়ে যাবার পথে আলমপুরে একজন লোক খবর দেন যে, পিস কমিটির চেয়ারম্যান সহিমুদ্দিন বিশ্বাসের জমিজমা দেখাশুনার দফাদার আ. রশিদ মুক্তিযোদ্ধাদের খবরা-খবর পাকবাহিনীর ছত্রছায়া আশ্রিত বিশ্বাসের কাছে পাচার করে। এই খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আলমপুর বাজারে অবস্থিত আ. রশিদের বাড়িটি ঘেরাও করে এবং তাঁকে আটক করে বেঁধে থানায় নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধারারা রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। আ. রশিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একদিন পর তাঁকে হত্যা কতা হয়। সফল অপারেশনের জন্য মুক্তিবাহিনীর ওই দলের বীরত্বের প্রতি স্থানীয় প্রশাসক জজ আ. হান্নান চৌধুরী, হাফিজুর রহমান হাসুন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ধন্যবাদ অ প্রশংসা জ্ঞাপন করেন।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!