মুশরীভূজা সম্মুখ সমর-২, ভোলাহাট
ভোলাহাট থানা ভবন থেকে মুক্তিবাহিনী টহল তৎপরতা অব্যাহত ভাবে চলছে। এদিকে পাকবাহিনী ভোলাহাট এলাকা দখলে আনতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৯ জুলাই ১৯৭১ সকাল ১১টার দিকে বোয়ালিয়ার মংলু চেয়ারম্যানের ১৮/১৯ বছর বয়স্ক ভাতিজা আনজার হোসেন নিপুল থানা ভবনে এসে মুক্তিবাহিণীকে জানান যে, “পাক বাহিনী আজকে ভোলাহাটে আসবেই”। তিনি জানান যে, পাকফৌজ সকাল ৮/৯ টার দিকে রহনপুর থেকে মহানন্দা নদীর মকরমপুর ঘাট পার হয়ে কাশিয়াবাড়ী কাউন্সিলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সংখ্যা হবে প্রায় ৫/৬ শ। এই তথ্যের ভিত্তিতে থানা ভবন থেকে মুক্তিবাহিনীর ১৫ জনের একটি টহলদার ভোলাহাট-রহনপুর ব্রিজের নীচে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলে কমান্ডার ছিলেন ইপিআরের খলিল (বরিশাল) বিক্রেতার ছদ্মবেশে রেকি করেন। তিনি দ্রুত মুক্তিবাহিণীকে সংবাদ দেয়ার পর মুহূর্তেই পাকফৌজের সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রীজের নীচে সঠিকভাবে পজিশনের যেতেই হানাদার বাহিনী স্কুলের মফিজ বিশ্বাস ও অজাম্মুল এমপিএ- সহ রাজাকার ও বহুসংখ্যক পাবলিককে সাথে এনেছিল। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানার জন্য অথবা উস্কাণী দেয়ার জন্য ভোলাহাট-রহনপুর মুশরীভূজা ব্রীজের ওপর দিয়ে একটি গুলি ছুঁড়লো। মুক্তিযোদ্ধারা তাৎক্ষণাৎ ঠিকমতো পজিশনে যেতে সক্ষম হন। পাকবাহিনী এরপর নদীর দিকে ভারত অভিমুখে কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে। হানাদার বাহিনী একবার ব্রীজ পার হবার ইচ্ছা করছে আবার ভয়ে পিছনে সরে যাচ্ছে। সেখানে রাস্তার ধারে বেড়ায় মাদার গাছ ছিল। পাকবাহিনীর কেউ কেউ মাদার গাছের এগাছ-ওগাছ লেফট-রাইট করে যাওয়া আসা করছে। এদিকে রাজাকার ও পাবলিকরা স্কুলের ঘর থেকে বেঞ্চ বের করে মাঠে বসার ব্যবস্থা করছে। রংপুরে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা আর্টিলারি মান্নান টু-ইঞ্চ-মর্টারের ৩ রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে ৪ জন পাকফৌজ ধরাশায়ী হয় এবং কিছু সংখ্যক আহত হয়। এরপর বৃষ্টির মতো গুলি বিনিময় শুরু হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রাত ১২টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। রাত ১২টা পর্যন্ত গুলি বিনিময়ের পর যখন নীরব অবস্থা তখন রাত প্রায় আড়াইটার দিকে গোপনে অতি সতর্কতার সাথে কোমরে ২টি করে বোমা বেঁধে রাজা মিয়া, ফলতান ও সাইফুদ্দিন মুশুরীভূজা হাই স্কুলে প্রবেশ করেন। তাঁরা দেখলেন সেখানে কেউ নেই। স্কুলের পেছনে পশ্চিম দিকে গিয়ে দেখতে পেলেন রক্তাক্ত জায়গা এবং হাড়ের গুড়া। তাঁরা স্কুলের দক্ষিণে আশরাফের বাড়ী গেলেন। পাকফৌজদের ডাকে ন যাবার দরুন সেদিন আশরাফকে পাকবাহিনী বেধড়ক মেরেছিল। তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ৩ জন জানালেন কয়েকজন পাকফৌজ মারা গেছে এবং প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে তাঁরা রহনপুর অভিমুখে চলে গেছে। ঐ ৩জন মুক্তিযোদ্ধা হিন্দু স্বর্ণকারের বাড়ী পর্যন্ত গিয়ে পাকবাহিনীর অবস্থান জানার জন্য পূর্বে দাঁড়ার দিকে বোমা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের কোন সাড়া না পেয়ে আবার ফিরে আসলে রক্তাক্ত জায়গায়। সেখানে বোমার ফ্যান ও বোমার মাথায় পিক আপ পেলেন। তারপর তাঁরা ফিরে এলেন মুক্তিবাহিনী অবস্থানে। ২০ জুলাই সন্ধ্যা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে থাকেন। ঐ দিন সকালে স্থানীয় লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছিল। দুপুরে ইপিআর তাজার নেতৃত্বে ৭/৮ জনের মুক্তিবাহিনী টহল দহল থানা ভবন থেকে মুশরীভূজা ডিফেন্সে উপস্থিত হন। তাঁদের সাথে ডিফেন্সে থানা ভবন থেকে খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন যাদুনগর গ্রামের জয়নালসক কয়েকজন। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় হেডকোয়ার্টারে মুক্তিবাহিনী ফিরে আসে।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত