You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.30 | মেঘনা নদীর যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

মেঘনা নদীর যুদ্ধ

[এ বিবরণটি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জেনারেল শফিউল্লাহ’র]
৩০ মার্চ অপরাহ্ন ৪টার সময় ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন অফিসার এবং সৈনিকদের পিটি হলে একত্র করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। ময়মনসিংহ বসেই আমি আমার পরিকল্পনা নির্ধারণ করি। আমার পরিকল্পনা হচ্ছেঃ
১. পূর্বদিক থেকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এবং একটি কোম্পানিসহ ইপিআরদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাস আক্রমণ করা।
২. বর্ণিত দিকে আমাদের উপস্থিতি গোপন করার জন্য ইপিআর এবং দু’টি কোম্পানি ঢাকার পশ্চিম অংশে মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা বিমান বন্দর এলাকায় পাঠিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা।
৩. মুজাহিদ এবং আনসারদের একটি কোম্পানিকে কয়েকজন নিয়মিত সৈন্যের সাহায্য ক্ষমতাসম্পন্ন করে গফরগাঁয়ে মোতায়েন করা যাতে ঢাকার দিকে আসার জন্যে পাকিস্তানীরা রেলপথ ব্যবহার করতে না পারে।
৪. টাঙ্গাইলে ইপিআর এবং আনসারদের নিয়ে গঠিত একটি মিশ্র কোম্পানি মোতায়েন করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাশড়কে শত্রুবাহিনীর গতিরোধ করা।
৫. বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং সিরাজগঞ্জ ঘাটে ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারদের মাধ্যমে গঠিত একটি মিশ্র কোম্পানি মোতায়েন করে উত্তর দিকে থেকে শত্রুদের সম্ভাব্য চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া। ৩০ মার্চ আমার সদর দফতর কিশোরগঞ্জে স্থানান্তর করি। ময়মনসিংহ এবং কিশোরগঞ্জে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত অথবা ছুটি ভোগরত অফিসার আমার সাথে যোগ দেন। এরা হচ্ছেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতি এবং ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। এ তিনজন অতিরিক্ত অফিসারকে পেয়ে আমার কাজের পরিধি আরও বেড়ে যায় এবং তা প্রত্যেক ফিল্ড অফিসারের জন্য একান্ত কাম্য বিষয়! আমার সৈন্যরা যখন ভৈরব বাজার থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়, ক্যাপ্টেন সায়গল, ব্যাটালিয়নের একজন অফিসার, যিনি কোর কমান্ডারের হেলিকপ্টার পাইলট ছিলেন, দলত্যাগ করে ব্যাটালিয়ন যোগ দেন। আমি তাঁকে আমরা আলফা কোম্পানির নেতৃত্ব প্রদান করি। এই কোম্পানি ৩১ মার্চ নরসিংদী পৌঁছে। পরদিন আমার সৈনিকদের অগ্রবর্তী দলসমূহ যারা নরসিংদীর সমাবেশকৃত এলাকা ছেড়ে আগে রওয়ানা হয়েছিল, বাসাবো এলাকায় পৌঁছে এবং এখান থেকে ঢাকা সেনানিবাসে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে
আক্রমণ প্রত্যাহারঃ কিশোরগঞ্জ মেজর খালেদ মোশররফের একটি বার্তা পেলাম। ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমা ইতোমধ্যে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ঢাকার ওপরে আমার আসন্ন আক্রমণ পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে তিনি আমাকে তাঁর প্রত্যাহারের জন্যে অনুরোধ জানান। উক্ত বার্তায় তিনি আরও জানালেন যে, তিনি আমার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। নিরাপত্তার কারণে বেতারের মাধ্যমে তাঁকে আমার পরিকল্পনার কথা জানানো থেকে বিরত থাকি। যাহোক মেজর খালেদের বেতার বার্তা আমার জন্যে একটি উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদও বটে। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের ব্যাপারে তিনি হচ্ছেন আরেকজন সৈনিক। বয়সে তরুণ। সাহসী ব্যক্তি। তার ওপর আমার অগাধ আস্থা রয়েছে। যতটা সম্ভব দ্রুত তার সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠি। তারিখটি হচ্ছে ৩১ মার্চ। ঢাকা অগ্রসর হওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে। খালেদের মনোভাব বোঝার আগে আমার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে আমি সম্মত নই। তাই, দুপুর ১টার সময় মেজর কাজী নূরুজ্জামানসহ একটি রেল ইঞ্জিন নিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া রওয়ানা হলাম। ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌঁছে জানলাম যে, মেজর খালেদ তার দফতরে নেই। মেজর সাফায়ত জামিল, মেজর খালেদের রেখে যাওয়া একটি পত্র আমাকে দেন। মেজর সাফায়ত হচ্ছে মেজর খালেদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। অনুরোধপত্রটি হচ্ছে এরকমঃ “ঢাকার দিকে যাবে না। এর ফলে আপনি কেবল দেয়ালেই মাথা ঠুকবেন। আমরা সিলেটের কিছু অংশসহ ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমা মুক্ত করেছি। ঢাকার ওপর আর কোনো তৎপরতা পরিচালনা করার আগে আমাদের মিলিতভাবে পুরো এলাকা মুক্ত করে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করছি, তারা আমাদেরকে সাহায্য করতে সম্মত আছে। আমি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করতে পারলাম না, কেননা সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। তিনি সাহাযযের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- খালেদ” আক্রমণের পরিকল্পনা করা কালে আমি ভালো করেই জানতাম ঢাকায় আমার জন্যে কী অপেক্ষ করছে। সব কিছু জেনেই আমি আমার সংকল্প স্থির করেছি। যাহোক, মেজর খালেদের বার্তা আমার ভাবনার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমি মেজর খালেদের প্রস্তাব নিয়ে মেজর জামানের সাথে মতবিনিময় করলাম এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, মেজর খালেদের প্রস্তাব হচ্ছে যুক্তিপূর্ণ এবং বিচক্ষণ। মেজর খালেদের নিজস্ব শক্তি এবং সীমান্ত্রক্ষীদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আমাদের মনে আস্থাবোধ জাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের জন্যে সমীচীন হবে ব্রাক্ষণবাড়িয়া এবন সিলেট মুক্ত করার জন্যে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা এবং অতঃপর ঢাকার দিকে এগিএ যাওয়া। অতএব আক্রমণ পরিচালনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ঢাকার দিকে অগ্রসরমান আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিই আশুগঞ্জ এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় স্থাপিত পর্যায়ক্রমিক অবস্থানে পিছিয়ে আসার জন্যে এবং এক কোম্পানি সৈনিক ঢাকা নরসিংদী সড়কে তাঁদের প্রত্যাহারের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রেখে দেই। পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন নাসিমকে ‘আলফা’ কোম্পানির কমান্ডার এবং লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদকে কোম্পানি অফিসার নিয়োগ করে ৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ বন্দরে রেল স্টেশনএর কাছে কোম্পানি দফতর স্থাপনের নির্দেশ দেই। আশুগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। আমাদের দেখে স্তানীয় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়। তারা আমাদের সৈনিকদের খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে সবরকম সহযোগিতা করতে থাকে। এসময় স্থানীয় ছাত্র ও যুবকরা দলে দলে আমাদের ক্যাম্পে এসে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং-এর জন্য নাম লিখাতে থাকে। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে আমরা অভিভূত হই। খাদ্যের জন্য কখনো আমাদেরকে উদ্বিগ্ন হতে হয়নি। আমার কখনো ক্ষুধার্ত থাকিনি। সর্বত্র কেউ না কেউ আমাদের যত্ন নিয়েছে। নরসিংদীর এক মিল ম্যানেজার মিজানুর রহমান, আশুগঞ্জের সাফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সাবেক এমপিএ লুৎফুল হাই সাচ্চু, মাধবপুরের মাহবুব, সিলেটের সাবু চৌধুরী, মোহাম্মদ আলকাছ মিয়া প্রমুখ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সিলেট এবং কুমিল্লার মধ্যে ব্রাক্ষণবাড়িয়া হচ্ছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেহেতু পাকিস্তানীদের বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে ব্রাক্ষণবাড়িয়া। নদীপথে সিলেটের সাথে যোগাযোগ ক্ষেত্রে ভৈরব-আশুগঞ্জ যৌগিক সামরিক কলাকৌশল এবং যুদ্ধ পরিকল্পনার দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। যা হোক, মেজর খালেদ তার সৈন্যদের নিয়ে দক্ষিণ দিকে, আমার সৈন্যরা উত্তর দিকে-উভয় দিক থেকে যথাক্রমে ব্রাক্ষণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জ-ভৈরব আমাদের করায়ত্ত। আমাদের এ অবস্থানকে চুরমার করার জন্য পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে ওঠে। কুমিল্লায় অবস্থিত ৫৩ তম ব্রিগেড নিয়ে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি আগেই চট্টগ্রাম তাদের করায়ত্তে আনার জন্য চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে যায়। চট্টগ্রামে পৌঁছে ব্রিগেডটি ১১৭ তম ব্রিগেড বা সাবেক ৯ম পদাতিক ডিভিশনের অধীনে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সিলেট- কুমিল্লা সড়কে পাকিস্তানীরা অব্যাহত নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। লক্ষ্য হচ্ছে ৩১৩ তম কুমিল্লা সড়কে পাকিস্তানীরা অব্যাহত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। লক্ষ্য হচ্ছে ৩১৩ তম এবং ১১৭ তম ব্রিগেড দুটিকে উক্ত সড়কে সহজভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়া এর ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের রক্ষাব্যুহ ছিন্নভিন্ন করার জন্যে ঢাকা থেকে অভিযান চালানো হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ভৈরব-আশুগঞ্জের শত্রুদের মুখোমুখি হতে হবে। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে প্রত্যেকটি নদীতে পানির উচ্চতা হ্রাস পায়। নদীতীরসহ স্থানে স্থানে দুরারোহভাবে ঢালু বা খাড়া হয়ে যায়। বজরা ছাড়া যানবাহন চলাচল অক্ষুণ্ন রাখা সম্ভব নয়। আশুগঞ্জের দিকে মেঘনায় যদিও অবতরণের ব্যাপক সুবিধা নেই তবু পদাতিক বাহিনীর চলাচল মোটেই কষ্টকর নয়। মেঘনা সেতুর স্বাভাবিক প্রবাহের পাশে আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন। এ স্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু। ক্যাপ্টেন নাসিমের অধীনে এক কোম্পানি নিয়মিত সৈনিক দিয়ে আমি এ এলাকাটি ধরে রাখার জন্য সিদ্ধান্ত নিই। আশুগঞ্জের তিন মাইল উত্তরে আজবপুরে নদীঘাট হচ্ছে সরাইল এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মধ্যে যাতায়াতকারীদের জন্যে সুবিধাজনক। সেখানে একজন জেসিও’র নেতৃত্ব এক কোম্পানি অনিয়মিত সৈনিক মোতায়েন করা হয়। আশুগঞ্জের দু’মাইল দক্ষিণে লালপুরে লেফটেন্যান্ট মোরশেদ এর অধীনে নিয়মিত- অনিয়মিত সৈনিকদের মিশ্রণে গঠিত একটি কোম্পানি অবস্থান গ্রহণ করে; যাতে লালপুর এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে রাস্তাটি ব্যবহার করতে সক্ষম না হয়। নরসিংদী এলাকায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে ভৈরব বাজারে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দিই। তার সাথে রয়েছে একটি ইপিআর কোম্পানি। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার তিতাস নদীর গোকর্ণঘাট রক্ষার দায়িত্বে একটি মিশ্র কোম্পানিসহ ক্যাপ্টেন মতিন। তাকে সরাইলে রাখার উদ্দেশ্য হলো গোকর্ণঘাট এবং তালশহর প্রতিরক্ষা লাইনে আক্রমণের ক্ষেত্রে তাদেরকে রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে ব্যবহার করা। আশুগঞ্জ এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মধ্যস্থলে এটি হচ্ছে একমাত্র প্রতিরক্ষা লাইন। এ কোম্পানিটিকে সচল অবস্থায় রাখা হয় যাতে তালশহর- গোকর্ণঘাট ডিফেন্স লাইনে দ্রুত অগ্রসর হয়ে এলাকাটি দখল করতে পারে। এবং আশুগঞ্জ ফ্রণ্টে যে কোনো আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তা ব্যর্থ করে দিতে পারে। সম্প্রতি আমাদের এলাকায় পর্যবেক্ষণকারী বিমান এবং হেলিকপ্টারের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমরা এসব আনাগোনার কারণ বুঝতে পারি। আমরাও তাই শত্রুকে প্রতারিত করার কৌশল গ্রহণ করি। ভৈরবে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। পাঁচদোনা এবং নরসিংদী থেকে বহুকষ্টে তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়ে এসেছেন। পাকিস্তানীরা তাকে খুব কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করেছে। রামপুরা সেতু বিনষ্ট করে দেয়া হলেও তা সংস্কার করে বা সেতুবন্ধন নির্মাণ করে এগিয়ে যাওয়া মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যপার। সেখানে শক্তি বৃদ্ধির জন্যে সৈন্য প্রেরণ করতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। ১৩ এপ্রিল, হালে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এক মুক্তিযোদ্ধাদল ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌঁছায়। আমি তাঁদেরকে এখনি ভৈরববাজারে পাঠিয়ে দিই। এটি হচ্ছে তেলিয়াপাড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম দল আমার সৈন্যরা যাত্রার শুরুতেই প্রচণ্ড বিমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এর ফলে ব্রাক্ষণবাড়িয়া রেল স্টেশনে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহী মোহাম্মদ মোহসিন এবং একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। ১৪ এপ্রিল, মৌলভীবাজারে একটি সমন্বয় সভায় উপস্থিত থাকার জন্যে আমাকে ডাকা হয়। আমি ভোরবেলা ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে যাত্রা শুরু করি। ১৪ এপ্রিল সকালে নৌযানের একটি বহর লালপুরের কাছে মেঘনা নদীতে আসে। আমাদের অনুমান ঠিকই ছিল। নৌযানের বহরটি অবতরণের স্থান নির্ণয় করার জন্য এসেছে। এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, অবতরণের ব্যাপারে শত্রুপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিন্যাস সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। এ কারণে অবতরণ পরিকল্পনার শিথিলতা রয়েছে। শত্রুরা আকস্মিকভাবে লালপুর থেকে গোলাবর্ষণে আক্রান্ত হয়ে যায়। প্রায় এক ঘন্টা ধরে গোলাগুলি বিনিময় হয়। শত্রুরা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে ভাটির স্রোতে চলে যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজা তখন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লালপুরে আক্রমণ সম্ভাবনায় সরাইলে অবস্থিত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে সেখানে অবস্থান নেওয়ার জন্যে তিনি নির্দেশ দেন। রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মতিন সেখানে পৌঁছে। কিন্তু রাতের বেলা সৈন্যদের লালপুরে বিন্যস্ত করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তার রিকোয়েললেস রাইফেল আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কাছে পরিবহন অসুবিধার কারণে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির ডানদিকে লালপুরে লেফটেন্যান্ট মোরশেদ অবস্থান করছিল। আমার কাছে এ বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয় কেন ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে পদদলে আশুগঞ্জ হয়ে লালপুরে আসতে হয়েছে। বরং যানবাহনের মাধ্যমে তাদেরকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পথে প্রেরণ করা সহজ ছিল। ১৫ এপ্রিল শত্রুপক্ষের আসন্ন অবতরণের খবর পেয়ে রাত ২টায় মৌলভীবাজার ছেড়ে ভোরবেলা ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌছি। আমি একথা জেনে অবাক হই যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজা আমার রিজার্ভ কোম্পানি সরাইল থেকে লালপুরে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। কৌশলগত দিক থেকে অবশ্যই লালপুরের গুরুত্ব রয়েছে। এটি তিতাস নদীর মুখে অবস্থিত বলে নদীর উপর প্রভাব বিস্তার করছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার কাছে গভীর মোতায়েন ছিল অধিকতর মূল্যবান। সৈন্যদের এক লাইনে নিয়োগ পদ্ধতিতে নদীতীরে মোতায়েন করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় Beaching Operation বা নদীবক্ষ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা খুবই কষ্টকর হলেও, কদাচিৎ ব্যর্থ হয়। সংকল্পবদ্ধ শত্রু সর্বদাই উপকূলে অবতরণ করতে পারে এবং সাফল্যের সাথে সেতুবদ্ধ রচনায় সক্ষম হয়। অবতরণের পরে আমরা তাকে বাধা দিতে পারি এবং তার বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমিক মধ্যবর্তী অবস্থানসমূহ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমার মধ্যবর্তী অবস্থান খালি রয়ে গেল। আমার কোনো বেতার যন্ত্র নেই। আছে ফুট রানার। তা আবার সময় সাপেক্ষ। যুদ্ধ ঘনীভূত হয়ে আসছে। এখন অবিরাম বিমান হামলা চলছে। কাজেই রিজার্ভ কোম্পানি ডেকে পচিহনে আনা নিরর্থক এবং অযৌক্তিকও বটে। আমাকে সব সয়ে যেতে হলো শুভ ফলাফলের প্রত্যাশায়। ১৫ এপ্রিল, ভোর সাড়ে পাঁচটায় আশুগঞ্জে আমাদের অবস্থানে শত্রুদের গোলাবর্ষণ শুরু হয় এবং একই অবস্থা চলে লালপুর এবং ভৈরবে। বোঝা গেল, Per-H-Hour গোলাবর্ষণ চলছে। অনুমিত হয়, খানাবাড়ি রেল স্টেশনের কাছাকাছি এলাকা থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ হচ্ছে। লালপুরের সামনে আবার নৌযানের বহর উপস্থিত। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে আমার সৈন্যরা লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সৈন্যরা সতর্কতার সাথে মেঘনার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে। গোলন্দাজ গোলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় অবতরণের জন্যে লালপুরের দিকে চলছে। নৌবহরের মধ্যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে। রয়েছে দু’টি গানবোট, দু’টি ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাঙ্ক এবং ৪টি লঞ্চ। আমি আমার ছেলেদেরকে তাঁদের ধৈর্য এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শত্রুর ওপরে দৃষ্টি নিবন্ধ করে ট্রিগারে হাত রেখে ওরা দূরত্বের পরিমাপ করে চলেছে। এ সময়ে ভৈরববাজার রেললাইন চুপিসারে আরেকটি শত্রু ব্যাটালিয়ন অগ্রসর। নদীর ওপর পাড়ে যুদ্ধের ওপরে প্রভাব বিস্তার করার মতো কোনো উপায় আমার হাতে ছিল না। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল শত্রুদেরকে প্রতিহত করে তাঁদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার জন্য এবনগ শেষ পর্যায়ে সেতুর ওপর দিয়ে এবং নৌকার সাহায্যে আশুগঞ্জে হটে যাবার জন্যেও পরামর্শ দেয়া হয়। যুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। নৌবহরটি আরও এগিয়ে আসে এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। লালপুরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিন বিগত রাতে তার ১০৬ মিলিমিটার রিকোয়েললেস রাইফেল আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির কাছে ফেলে এসেছিল। যাহোক, একটি ৭৫ মিলিমিটার রিকোয়েললেস রাইফেল গোকর্ণঘাট থেকে নিয়ে এসে অবতরণকালীন ট্যাঙ্কের ওপরে ৫টি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এতে শত্রুর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নৌবহরটি যখন অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তখনো আমাদের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছে তখন একজন ট্রিগ্যার হ্যাপি সৈনিক গুলিবর্ষণ করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে ট্যাঙ্ক থেকে একযোগে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমাদের রকেট লাঞ্চার এবং মর্টার ভারি গোলাবর্ষণে শত্রুদের অবস্থানে প্রচণ্ড আঘাত করে। পাকিস্তানী বাহিনী হতভম্ব হয়ে তীর থেকে অন্যত্র ভেসে যেতে থাকে। আমাদের গুলিবর্ষণ অব্যাহত গতিতে ওদেরকে ধাওয়া করে। অল্প সময়ের মধ্যে দু’টি স্যাবর এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আমাদের অবস্থানসমূহে বোমাবর্ষণ করে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলায় মত্ত হয় ওঠে। আমারাও আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। বিমান আক্রমণের ফলে আমার সৈন্যরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টা ধরে বিমান আক্রমণ চলে। এ সময় আমি লক্ষ্য করি এক ঝাঁক এমআই-৮ হেলিকপ্টার নদীর অপর-পাড়ে আশুগঞ্জ এবং আজবপুরের মাঝামাঝি সোহাগপুরে ঘোরাফেরা করছে। হেলিকপ্টারগুলো উবু হয়ে পাকিস্তানীদের নামিয়ে দিয়ে আরও কিছু নিয়ে আসার জন্য দ্রুতবেগে উড়ে যাচ্ছে। একটি কোম্পানি আমাদের পেছনে সোহাগপুর এলাকায় অবতরণ করে। হেলিকপ্টার প্রতিহত করার মতো কোনো বাহিনী বা অস্ত্র আমাদের হাতে ছিল না। এভাবে যুদ্ধে আরও একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো। আমাদের বেশি কিছু করার মতো ক্ষমতা নেই। আজবপুরে স্বল্প সংখ্যক অনিয়মিত সৈনিক রয়েছে- একজন জুনিয়র কমিশনড অফিসারের অধীনে। বিনা বাধায় হেলিকপ্টারগুলো সেখানে অবতরণ করে। শত্রুদের বিমান আক্রমণ যুদ্ধক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। আমার সৈন্যরা কোনো রকমে পরিখায় আশ্রয় নেয়। তাদের চলার গতি এবং উদ্যোগ গ্রহণ ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে গেছে। হেলিকপ্টার অবতরণে বাধা দেয়ার জন্যে ক্যাপ্টেন নাসিম দ্রুতবেগে তার কোম্পানিকে পুনরায় একত্র করে বিমান আক্রমণ সত্ত্বেও শত্রুপক্ষের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমজি পোস্টের কমান্ডার ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই রেলপথে স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রুদের ওপরে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে ৮৩ মিলিটার ব্লেন্ডিসাইড থেকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত গোলায় আবদুল হাই নিহত হয়।
শত্রুরা আমাদের অবস্থানসমূহ ঘিরে ফেলে এবং আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন নাসিম এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদ যুদ্ধ চলাকালে আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটে। হেলিকপ্টার সাফল্যের সাথে অবতরণ করছে দেহকে আমি আমার সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওরা আগেই সাংঘাতিক ধরনের বিশৃঙ্খলা অবস্থায় পড়ে গেছে। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন নাসিম সরাইলের দিকে পিছু হটে যায়। শত্রুদের নৌবহর তিতাসের মুখে তাদের সৈন্যদের নামিয়ে দেয় এবং আমার বামদিকের রক্ষব্যূহ ভেঙ্গে ফেলে। ক্যাপ্টেন মতিন লালপুরে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে। অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় বুঝে পেরে সন্ধ্যার দিকে রেলপথে হেঁটে ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌঁছে। তখন শহরটি জনশূন্য। ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলের পথ ধরে সেখানে পৌঁছে দেখে সরাইলেও আমাদের কোনো সৈন্য নেই। দীর্ঘ রাস্তায় দ্রুতবেগে মার্চ করে সৈন্যরা ক্লান্ত। তাঁদের বিশ্রাম প্রয়োজন। তারা তৃষ্ণার্ত। কিন্তু সরাইল তাদেরকে উচ্ছ্বাসহীন স্বাগত জানায়। আগের দিন সরাইলবাসীরা যে ভাবাবেগ প্রদর্শন করেছে এখন তা আর নেই-শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আমরা জনগণের অনুভূতি বুঝতে পারি। আমাদের ওপরে তাঁদের বড় প্রত্যাশা ছিল। আমরা আশুগঞ্জের তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আরও ৮ মাইল দূরে-তিতাসের তীরে-শাহবাজপুরে আমার সৈন্যদের নিয়ে পৌছি। শেষ রাতে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান প্রবল শত্রুর আঘাতে পরাস্ত। মেঘনা সেতু এবং নদী পারাপারের পথ রুদ্ধ। উত্তর দিকে রেল রাস্তার ওপর দিয়ে সে কুলিয়ার চরে পৌঁছে। পরবর্তী সময় চাতালপাড় দিয়ে আমার সাথে মিলিত হয়। মেঘনা নদীতে সংঘটিত লড়াই হচ্ছে মুক্তি সংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতিমূলক লড়াই। এর মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর অস্ত্র ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ করা সম্ভবপর হয়। শত্রুপক্ষ আকাশ এবং নৌপথে কতোটা স্বচ্ছন্দ বিচরণে সক্ষম তাও বোঝা যায়। শত্রুরা আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনা এবং অস্ত্র ব্যবহারে অধিকতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। গতিশীলতা এবং যুদ্ধাস্ত্রের অভাব নিয়ে কোনো সেনাপতিই সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে না। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর পরিস্থিতি হচ্ছে ভিন্ন ধরনের। যা ছিল তাই নিয়ে আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আমরা শুধু এ কথা জানি যে, আজকের পরাজয় ভবিষ্যতের বিজয় নিশ্চিত করবে। The first set-piece battle- এ প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধে সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই, সিপাহী কফিল উদ্দিন এবং সিপাহী আবদুর রহমান সরকার বহু সৈন্য প্রাণ হারায়।
[৫২] কে.এম, সফিউল্লাহ, বীর উত্তম, মেজর জেনারেল

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত