You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.11 | মেহেরপুর মুক্ত অভিযান - সংগ্রামের নোটবুক

মেহেরপুর মুক্ত অভিযান

সেক্টর কমান্ডার এম. এ. মঞ্জুর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেই মেহেরপুর শহরকে শত্রুমুক্ত করার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বেতাই সাবসেক্টরের অধিনায়ক এ.আর.আজম চৌধুরীকে বলেন। ক্যাপ্টেন চৌধুরী এই লক্ষ্যে তাঁর অধীনস্ত নিয়মিত বাহিনী ‘সি’ কোম্পানির ৭,৮ ও ৯ নং প্লাটুনকে মেহেরপুরের পশ্চিমে গবরার খড়ের মাঠে অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে থাকবে গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী যোদ্ধারা। কমরউদ্দীন (বাজিতপুর), ইউনুস আলী (কোলা) এবং আবদুল ওহাব (আমঝুপি) এই পাঁচ জন গেরিলা কমান্ডারের মাধ্যমে তাঁদের গ্রুপের (১২x৫)= ৬০ জন গেরিলা যোদ্ধাকে গবরার মাঠে অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হলো। নিয়মিত বাহিনী এবং অনিয়মিত বাহিনীর এই সদস্যরাই সম্মুখযোদ্ধা বা ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে থাকবে যুদ্ধের সম্মুখ ভাগ। তাঁদের গোলন্দাজ সহায়তা (আর্টিলারি সাপোর্ট) করার জন্য পেছনে অবস্থান গ্রহণ করবে ভারতীয় ডোগরা বাহিনীর একটি সুসজ্জিত কোম্পানি। তাঁদেরও গবরার মাঠে অবস্থানের জন্য বলা হয়। এই মাঠ থেকে পাকসেনাদের অবস্থান মাত্র মাইলখানেক দূরে। যাদবপুরে কলিমউদ্দীনের দোতলা বাড়ি এবং গোরস্থানের পাশে তাঁদের অবস্থান। মাঝখানে পিরানী বিলে টইটুম্বর পানি। ঢেলাই পীরের দরগার কাছে পাকুড় গাছে অবজারভেশন পোষ্ট বা ওপি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল বাহিনী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই গবরার খড়ের মাঠে মজবুত বাঙ্কার তৈরি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বেতাই সাবসেক্টর হেড কোয়ার্টারে বসে সেক্টর কমান্ডার এম.মঞ্জুর, সাব সেক্টর কমান্ডার এ.এর. আজম চৌধুরী এবং মিত্রবাহিনীর প্রতিনিধি কর্নেল ডি.এস. কাটোয়ারি- এই তিনজন সম্মিলিত আলোচনায় আক্রমণের লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ, ডিউটি-বিতরণ, অস্ত্রগোলাবারুধ বন্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গবরার মাঠ থেকে আক্রমণের জন্য শত্রু অবস্থানের যে স্থানগুলো লক্ষ্যস্থল হিসেবে নির্ধারণ করা হয় সেগুলো হচ্ছেঃ মেহেরপুর কলেজ, মেহেরপুর ভকেশনাল, দুর্লভ পাগলদের বাগান, কয়লার বেড়, বামুনপাড়ার পন্ডের ঘাট কালাচাঁদপুর ক্যাম্প, যাদবপুর কলিমদ্দিনের দোতলা বাড়ি, যাদবপুর গোরস্থান। এই সব অবস্থানেই ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন গবরার খড়ের মাঠে মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কার তৈরি এবং ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে, সে সময়ে ৪/৫ তারিখের দিকে এ.আর.আজম চৌধুরীর নির্দেশে যাদবপুরের আল আমিন এবং গৌরীনগরের আব্দুর রশীদ ভৈরবের পশ্চিম পারের গ্রামগুলোতে আসে পাকসেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেবার উদ্দেশ্যে। খড়ের মাঠ পেরিয়ে রাধাকান্তপুর গ্রামে নিহাজ ডাক্তারের বাগানের পুর্ব দিকে গিয়ে তারা খবর নিয়ে জানতে পারে যে বন্দর ও শ্মশানগাহট এলাকায় পাকবাহিনী টহলে নেই। এরপর নদীর তীর ধরে রাজাপুরের মুচিপাড়ার ঘাঁটে এসে পৌঁছে। সেখান থেকে বাঁশবাগানের মধ্য দিয়ে বন্দরের শ্মশান ও বামুনপাড়ার হালদাপাড়ার নিচে এবং পণ্ডের ঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ পর্যবেক্ষণ করে রাজাপুর হয়ে গবরার খড়ের মাঠে ফিরে আসে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আল আমিন ও আব্দুর রশীদ বাড়িবাঁক মসজিদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সাদিক হাসান রুমী এবং একজন ভারতীয় ক্যাপ্টেনকে অবস্থান করতে দেখে। তারা দু’জন বিশেষ দায়িত্ব পালন করছিলেন। যাদবপুর গোরস্তানের কাছে পাকসেনা অবস্থান এবং গাছের মাথায় অবস্থিত ওপির ওপর শেল নিক্ষেপের জন্য তারা দূরত্ব নির্ধারণ করে ভারতের নাটনা ক্যাম্পে সংকেত পাঠাচ্ছিলেন। ভারতীয় ক্যাপ্টেন ওয়ারলেসে নির্দেশ দেবার পরপরই নাটনা থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের নিক্ষিপ্ত শেল এসে যথাস্থানে না পড়ে বুড়িপোতা মাঠের মধ্যে পড়ে। ক্যাপ্টেনের ভুল নির্দেশের কারণেই মর্টারের শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে এটা আল আমিন বুঝিয়ে বললে ভারতীয় ক্যাপ্টেন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ বিছিয়ে মেহেরপুরের অবস্থান দেখে নেন। তারপর মেহেরপুরের ম্যাপ বের করে তাদের লক্ষ্যস্থল যাদপুর গোরস্থান এবং ওপির অবস্থান ঠিক কোন জায়গাটায় সেটা জানতে চান। আল আমিন সঠিক অবস্থান এবং দূরত্বের ধারণা দিলে ক্যাপ্টেন আবার ওয়ারলেসে নাটনা ক্যাম্পে নির্দেশ দেন। এরপর তিনটি শেল নিক্ষিপ্ত হয়। প্রথমটি এসে পড়ে ঢেলাইপীরের দরগায় গাছের ওপর। অবজারভেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত পাকসেনা নিহত হ্য, গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে। দ্বিতীয় এসে পড়ে যাদবপুর গোরস্থানের পূর্ব পার্শ্বে বাঙ্কারের খুব কাছেই। ২ জন পাকসেনা এবং রাজাপুরের ৩ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। তৃতীয় শেলটি গোরস্থানের উত্তর দিকে পতিত হলে ১ জন পাকসেনা নিহত এবং ১ জন আহত হয়। আল আমিন ও রশিদ এরপর এ.আর. আজম চৌধুরীকে সমস্ত পরিস্থিতি রিপোর্ট করার জন্য বেতাই ফিরে যান। ভারতীয় ক্যাপ্টেন এবং সাদিক হাসান রুমী শালিকা নবীনগর হয়ে ফিরে যযান নাটনা। বেতাই থেকে সেই দিনই সন্ধ্যা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলে আসে বাড়িবাঁকা গ্রামে। গবরার মাঠে বাঙ্কার তৈরির কাজ যদিও শেষের পথে, তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা সে রাত কাটায় বাড়িবাঁকা গ্রামে মানবশূণ্য পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে এবং ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে। পরদিন সকালে সকলের ডিউটি বন্টন করে দেয়া হয়। মতিন পাটোয়ারী এবং রহমতুল্লাহ কাহ্ন সেনা একটি প্লাটুন নিয়ে চলে যায় রাধাকান্তপুর বাগান, রাজাপুর মুচিপাড়ায় ঘাট এলাকার দায়িত্বে। হাবিলদার আব্দুর রউফ এবং আল আইন ফ্লায়িং ডিউটিতে এসে রাজাপুর বর্তমান প্রাইমারি স্কুলের কাছে মানিক মিয়ার আমবাগানে গাছের আড়াল থেকে দেখতে পায়-যাদবপুরের আনন্দ মণ্ডলের আমবাগানে পাকসেনারা চলাফেরা করছে। খবরটি দ্রুত নিহাজ ডাক্তারের বাগানে মতিন পাটোয়ারীকে জানানো হয়। মতিন পাটোয়ারী তার দলবলসহ মানিক মিয়ার বাগানে অবস্থান গ্রহণ করার পর উভয় পক্ষের গুলিবিনিময় শুরু হয়। কোনো পক্ষের কেউ হতাহত হয় না। এ রকম গুলিবিনিময়য় প্রতিদিনই চলতে থাকে। এ রকম অবস্থা চলে আরও দশ দিন-একেবারে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। গাংনী থানায় সংঘটিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে ৪ নভেম্বর রামদেবপুর মাঠের যুদ্ধ বা পাগলার পুলের যুদ্ধ সবচেয় উল্লেখযোগ্য। এক কোম্পানি পাকসেনারা বিরুদ্ধে সামান্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার বিজয় সূচিত হয়েছিল এ যুদ্ধে। বামুন্দী কাম্প থেকে এক কোম্পানি পাকসেনা তেতুলবাড়িয়া অভিযানে রওনা হবে- এ খবর সংগ্রহের পর জোড়পুকুরের হারুন উর রশীদ (হারু বিশ্বাস) খুব সকালে পৌঁছে দেন মথুরাপুরের মুক্তিযোদ্ধা কাম্পে। এখব পাবার পর আবদুল হান্নান এবং আজগর আলীর নেতৃত্বে দুটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ তেতুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় টহলে আসে। নুরূল হুদা চেয়ারম্যান এসে সার্বিক সমন্বয় করেন। তেতুলবাড়িয়া থেকে গরীবপুর পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পজিশন গ্রহন করে বাদিয়াপাড়ার আব্দুর রহমান, মাহবুবুর রহমান মজনু, হাবিবর, জালাল, আকছেদ, হোগল্বাড়িয়ার ইদ্রিস, রহমান, ধাঙ্খোলার কদম আলী, মকছুদ হোসেন, মঠমুড়ার গনি, হিজল্বাড়িয়ার‍্য দেলোয়ার। গরীবপুর এলাকায় মোফাজ্জেল হোসেনের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর সদস্যরাও অবস্থান গ্রহন করে। এ দলে ছিল করমদির মখলেসুর রহমান, আবদুল কাদের, মিনাপাড়ার মকবুল হোসেন, আশরাফুল ইসলাম, সহবাড়িয়ার মুছাবউদ্দিন, বেতবাড়িয়ার মনিরুল ইসলাম, কাজীপুরের আশরাফুল ইসলাম। তেতুলবাড়িয়ার চেয়ারম্যান বাড়ির কাছে অবস্থান গ্রহন করে সিদুরকৌটার নজরুল ইসলাম, হিন্দার মুনতাজ আলী, কামাল উদ্দিন, সাহারবাটির পাতান আলী, ফকির মোহাম্মদ, আলেহীম (কুমারীডাঙ্গা), কামরুজ্জামান (নওদা মঠমুড়া), ফেরদৌস (গাড়াবাড়িয়া), মোস্তফা কামাল (মোহাম্মদপুর) চৌগাছার আবদুল বারেক, মহসিন আলী এবং গফুর (গাংনী)। প্রধান আক্রমণকারী দল মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে করমদি ও পলাশীপাড়ার মাঝে পাগলার পুলের পাশে রামদেবপুর মাঠের নিচু জলাভুমিতে পজিশন নেয়। শিমুল গাছের আড়ালে এলএমজিস্যান মোজাম্মেল হক। দেবীপুরের আব্দুল বাকি করমদির ইয়ামিন এসএমজি হাতে পাশেই। দুটি এসএলআর এবং ৪টী ৩০৩ রাইফেল নিয়ে গ্রুপের অন্যান্য যোদ্ধাঃ আব্দুল কুদ্দুস (হাড়াভাঙ্গা), সাকবান আলী (বালিয়াঘাট), আবুবকর (সাহেবনগর) হারেজ উদ্দীন (কড়ুই গাছি), শহিদুল হক (দেবূপুর)। ১০টার পর পাকসেনা বহর পায়ে হেঁটে পাগলার পুল অতিক্রম করে। ৩ ইঞ্চি মর্টার পার হয়ে জায়। কিন্ত মার্টারের শেল বহনকারী সৈনিক পুল পার হবার আগেই মোজাম্মেল হকে এলএমজি গর্জে ওঠে। ব্রাশ ফায়ারে ৫/৬ জন পাকসেনা খতম হয়। এর পরপরই তারা পজিশন নিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। শিমুল গাছ লক্ষ করে অনেকক্ষণ গুলি চালায়। কিন্ত মজাম্মেল হক আত্নরক্ষার্তেই তখন সেখান থেকে সরে আসে। পলাশীপাড়ার কাদেরের বাড়ির পাশে থেকে কয়েকজন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার পস্তুতি নিচ্ছে দেখে মোজাম্মেল হক এবং তাঁর সঙ্গিরা এক যোগে আক্রমণ চালায়। সেখানেও ২/৩ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। কিন্তু এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর যে আক্রমণ শুরু হয়, তা প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু পিছনে-ডানে-বামে শুধু পানি। এদিকে গোলাগুলি ফুরিয়ে আসে। একজনকে ঝুঁকি নিয়েই শিকারপুরে পাঠানো হয়। কিন্তু সাহায্য আসে না। অবশেষে দু’ঘন্টা যুদ্ধ চালানোর পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে জোলের পানিতে নেমে পিছু হটে আসে। ইতিমধ্যে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামপুর সমবেত হলে ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী আবার একটি শক্তিশালী দল পাগলার পুলে পাঠান এবং তিনি নিজেও ছুটে আসেন। কিন্তু ততোক্ষণে যুদ্ধ শেষ।
নম্ভেম্বরের ৯ তারিখে মোনাখালিতে পাকসেনা ক্যাম্পে এক সফল অভিযান পরিচালিত হয়। ভৈরবএর এক দিকে পাকসেনা, অন্য দিকে মুক্তিযোদ্ধা। ক্যাপ্টেন এ.আর. আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বিদ্যাধরপুরে সন্তোষ মণ্ডলের বাড়ীতে এবং সরানের মাঠে অবস্থান গ্রহণ করে। এই মাঠে ভারতীয় গোলন্দাজ সহায়তাকারী দলকে তত্ত্বাবধান করেন কাইয়ুম চৌধুরী। নাগালের মধ্যে একত্রে অধিসংখ্যক পাকসেনাকে পাবার পর আজম চৌধুরীর নির্দেশে এলএমজি থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করে হাবিলদার মতিন পাটোয়ারী। একবারের ব্রাশ ফায়ারেই কমপক্ষে ৭/৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর সকল মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র এক সঙ্গে গর্জে ওঠে। মোনাখালি থেকে পাকসেনারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ২ ঘন্টা যুদ্ধ চালানোর পর রণে ভঙ্গ নিয়ে অবশেষে তারা মোনাখালি থেকে ক্যাম্প তুলে নিয়ে মেহেরপুরে চলে আসে। যুদ্ধের পর পাকসেনা ক্যাম্প থেকে বেশি কিছু অস্ত্র ও রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ১১ নভেম্বর মেহেরপুর-নাটুদা সড়কের কোলা মানক স্থানে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে মোষেল গাড়িতে পরিবহণরত পাকসৈন্যের রেশন সামগ্রী সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। নভেম্বরের ১২ তারিখে কুষ্টিয়া জেলার ধর্মদহের কাছে ব্যাংগাড়ির মাঠে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শিকারপুর সাবসেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ যুদ্ধ মেহেরপুর জেলার বহু মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি অংশগ্রহণ করে। মোফাজ্জল মাস্টারের নেতৃত্বে মকবুল হোসেন, মছুয়াবউদ্দীনসহ গাংনী থানার মুজিববাহিনীর সকল সদস্য, আবদুল ওহাব, আবদুল রহমান, আবদুল হানিফের নেতৃত্বে পৃথক তিনটি গেরিলা গ্রুপ কাজীপুর হয়ে ধর্মদহ এলাকায় গিয়ে যুদ্ধে যুক্ত হয়। এ ছাড়া বামুন্দী ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা যাতে ধর্মদহের দিকে যেতে না পারে, সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ রামনগরে এবং ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ কাজীপুর প্রস্তুত থাকে। এ গ্রুপে ছিল আলী হোসেন, নাসির উদ্দীন, মারজেল হোসেন, আবুল কাশেম, মজনু, জলির, আমি হামযা, আমিরুল, কোরবান আলী, জহুরুল হক প্রমুখ। ব্যাংগাড়ি মাঠের এ যুদ্ধ ভোর চারটায় শুরু হয়ে সকাল সাড়ে নয়টা শেষ হয়। ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহৃত। এ যুদ্ধে মেহেরপুরের মোনাখালি গ্রামের ওলিউল বারি শহীদ হন। রাইপুরের সিরাজুল ইসলাম আহত অবস্থান পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে অনেক নির্যাতনের পর পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এদিনই প্রথম মুক্তিবাহিনীর মর্টার থেকে নিক্ষিপ্ত শেল এসে পড়ে মেহেরপুর শহরের অভ্যন্তরে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা সামরিক অবস্থানে না পড়ায় অসামরিক জানমালের ক্ষতি হয়ে যায়। হোটেলবাজার পুরাতনপাড়ার শামসুর শেখের দুটি শিশু কন্যা (রুবি ও বুলবুলি) শেলের আঘাতে প্রাণ হারায়। এদিকে গবরার খড়ের মাঠ থেকেই ভৈরবের পশ্চিম দিকের গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনী চলাচল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র অবস্থায় পাশাপাশি গ্রামগুলোতে টহল দেয়, দূরে কোথাও পাকসেনার উপস্থিতি দেখলেই আক্রমণ চালায়। ১৩ নভেম্বর খড়ের মাঠে খবর এলো পাকসেনারা রাজাপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলেছে। রাজাপুরে সেদিন ডিউটি ছিল হাবিলদার আবু তৈয়ব এবং আনসার কমান্ডার সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্ব এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রান্ত হবার খবর শুনে হাবিলদার আব্দুর রউফ, নায়েক শামসু ইসলাম, আল আমিন এবং আব্দুর রশিদ খড়ের মাঠ থেকে বারাকপুরের ভেতর দিয়ে রাজাপুরে মানিক মিয়ার বাড়ির সামনে পাঁচ রাস্তার মোড়ে এসে পাকসেনার অবস্থানের কথা জানায়। এ দিকে মতিন পাটোয়ারী তাঁর দলবল নিয়ে মেঠোপথ ধরে উত্তরে ফকির মোল্লার পুকুরপাড়ে উপস্থিত হয়। পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার এলএমজি থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয় দলের ব্যবধান তখন মাত্র ১০০/১৫০ গজ। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় মানিক মিয়ার বাগানে তখন পাকবাহিনী। উভয় পক্ষের মধ্যে দেড় ঘন্টা গুলিবিনিময়ের পর পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা আবার মানিক মিয়ার বাগানে অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রচুর রক্তের ছাপ দেখতে পায়। কমপক্ষে দুজন নিহত এবং একাধিক আহত পাকসেনাকে তারা সরিয়ে নিয়ে গেছে। এই যুদ্ধের পর পাকসেনার আর ভৈরব পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণধীন এলাকায় হামলা চালাতে সাহস পায়নি। এমন কি যাদবপুরের কলিমউদ্দীনের বাড়ির ক্যাম্পটিও এ দিন উঠিয়ে নিয়ে যায়। ফলে নভেম্বর মাঝামাঝি থেকেই ভৈরবের পশ্চিমের যাদবপুর, গোভীপুর, রাধাকান্তপুর, কামদেবপুর, বুড়িপোতা, শালিকা প্রভৃতি গ্রাম শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। এ সব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অবাধে চলাফেরা করে। কিন্তু গোভীপুরে আওলাদ রাজকার যাদবপুর ঘাটের মাঝি থাকায় এপারে মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই ওপার থেকে ৮/১০ জন পাকসেনা এনে এপারে পৌঁছে দিতে থাকে। এটা চলতে থাকে আরও দিন দশেক। তবে, পাকসেনারা এসে যাদবপুর ঘাটে তাঁদের বাঙ্কারের কাছে টহল দিয়ে চলে যায়।
এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষও চলতে থাকে। নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ গণবাহিনির গেরিলাদের অনেকেই সীমান্ত এলাকার মুক্তিযোদ্ধা- কাম্প ছেড়ে দেশের ভেতরে চলে আসে। পাকবাহিনীর চলাচল ও টেলিযোগাযোগ বিঘ্নিত করে তোলার জন্য মরিয়া ওঠে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে গ্রামের তরুণ-যুবকদের ডেকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষনের আয়োজন করে। রাজাকারদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয় নতুন যোদ্ধাদের দেয়। করিমদের মোফাজ্জেল মাস্টার, মিনাপাড়ার আশরাফুল ইসলাম, মকবুল হোসেন, হেমায়েতপুরের আজিজুল হক, হিন্দার আব্দুল হান্না, আজমাইন হোসেন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অতিদ্রুত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে তোলেন, এরই মধ্যে ১৬ নভেম্বর বামুন্দী কাম্প থেকে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তেতুলবাড়িয়ায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাকবাহিনীর আক্রমণ করে। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা পূর্বেই উক্ত অবস্থানে পাকবাহিনীর আক্রমণ করে। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা পূর্বেই উক্ত অবস্থান থেকে সরে এসে প্রতিআক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। আব্দুল হানিফ, আব্দুল ওহাব ও আব্দুল রহমানের নেতৃত্বে গণবাহিনীর গেরিলারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কুমারীডাঙ্গার আব্দুল গণি, চৌগাছার শামসুল হক সোনাসহ অনেকে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তবে ভারতীয় সাহায্যকারী ইউনিটের শেলিং-এর মুখে টিক্তে না পেরে কিছুক্ষণের মদ্ধেই পাকবাহিনী ফিরে আসে। এদিকে মেহেরপুরের বাইরে থেকে সকল কাম্প গুটিয়ে আনার পর পাকসেনারা মেহেরপুর শহরের মদ্ধেই বিউভিন্ন জায়গায় তাঁদের টহল জোরদার করে। শহরের চতুর্দিকে অত্যন্ত মজবুত ট্রেঞ্চ খুঁড়ে তৈরি করে নিরাপত্তা বেষ্টনী। কোর্ট বিল্ডিং-এর পূর্বে দুর্লভ পাগলদের বাগান, মুন্সেফ বাংলোর সামনে সি এন্ড বি ডাকবাংলো কালাচাদপুর প্রভৃতি স্থানে এক প্লাটুন করে ন্সইন্ন মোতায়েন রেখে ভৈরবের পশ্চিম থেকে পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে নদীর পূর্বপার থেকে পাকসেনারাও টহলরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এই অবস্থা চলে থাকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। কিন্ত এরই মাঝে ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী নির্দেশ দেন-মেহেরপুর শত্রুমুক্ত করার প্রস্তুতি নিতে হবে, প্রয়োজনবোধ সকল বাধা অতিক্রম করেই শহরে প্রবেশ করতে হবে। নির্দেশ অনুযায়ী ২৩ নভেম্বর মতিন পাটোয়ারী এবং রহমুতুল্লাহ খান সোনার নেতৃত্বে দুটি মুক্তিযোদ্ধা দল নদী পেরিয়ে বামুনপাড়া মোড়ে পৌঁছে। তাঁদের লক্ষ্য সি এ্যান্ড বি বাংলো এবং দুর্লভ পাগলদের বাগানে অবস্থানরত পাকসেনাদের আঘাত করা পাকসেনাদের দুটি অবস্থানই মুক্তিবাহিনীর নাগালের মধ্যে হঠাৎ ওয়াপদা মোড় থেকে পাকসেনাদের নিক্ষিপ্ত মর্টার শেল এসে পড়ে বামুনপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের খুব কাছেই। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ঐ অবস্থান থেকে আক্রমণ চালানো সুবিধাজনক মনে না করায় অতি দ্রুত নদী পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ে চলে আসে এবং গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময় চলে দেড় ঘন্টা ধরে। পরদিন সকালে ঐ একই এলাকায় আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় হাবিলদার আবু তৈয়ব এবং আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলকে। তাদের লক্ষ্য সি এ্যান্ড বি বাংলোর সামনে এবং কোর্টের পূর্বে দুর্লভ পাগলদের বাগানে পাকসেনা অবস্থান। গবরার খড়ের মাঠ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে রওনা হয়ে যাবার পর খবর পাওয়া গেল রাজাকার আওলাদ মাঝির সহযোগিতায় পাকসেনারা যাদবপুর ঘাট পার হয়ে ভৈরবের পশ্চিম তীর ধরে আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্র হাবিলদার মতিন পাটয়ারী তার সৈনিকদের নির্দেশ দেন পাকসেনাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য। এদিকে মেহেরপুরের পাকসেনা কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়ারলেসে ক্রসকানেকশন হয়ে যাওয়ায় মতিন পাটোয়ারী উর্দুতে কমান্ড দিয়ে পাকসেনাদের মধ্যে তথ্য বিভ্রান্ত ঘটিয়ে দেন। ফলে তারা শুধু বিভ্রান্ত নয়, ভীত হয়ে পড়ে। নদীর দু’পাড় থেকে ঘন্টাখানেক প্রবল গুলিবর্ষণ চলে। অবশেষে পাকসেনারা নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। পাকসেনাদের আরও এক ধাপ পশ্চাদপসারণের ফলে বন্দর, বামুনপাড়া এলাকা অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে যায়। প্রয়োজনে মুক্তিবাহিনী সহজেই এপারে চলে আসে এবং মুক্তাঞ্চলের সুবিধামতো স্থানে বাঙ্কার খুড়ে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে শুরু করে। এ সময় ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখেঃ মুজিবনগর, ২৪ নভেম্বর-কুষ্টিয়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ মেহেরপুর শহরটির চারিদিকে এখন মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। হোটে যাবার মুখে পাকসৈন্যরা গোলাবর্ষণ করছে। প্রকৃতপক্ষে গেরিলাযোদ্ধারা নভেম্বরের শেষসপ্তাহে মেহেরপুরের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। মেহেরপুর-নাটুদা সড়কের মোনাখালি, দারিয়াপুর, কেদারগঞ্জ, বাগোয়ান এবং মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের আমঝুপি, বারাদি, পাটকেলপোতা প্রভৃতি স্থানে গেরিলা ওঁৎ পেতে থাকে। এরই মাঝে চলতে থাকে দালাল-রাজাকার-বিরোধী তৎপরতা। মেহেরপুরের উত্তরাংশে ভৈরব নদীর পশ্চিমে ইছাখালি, কামদেবপুর গ্রামে হাবিলদার আবু হোসেনের নেতৃত্বে বাহিনীর সি কোম্পানির একটি প্লাটুন ন্যস্ত করা হয়। তাদের দায়িত্ব কালাচাঁদপুরে পাকসেনা অবস্থানে আক্রমণ করা। মেহেরপুরের দক্ষিণে মোনাখালি এবং পশ্চিমে যাদবপুরের পতনের পর কালাচাঁদপুরের পাকসেনাদেরও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। সেখানে একটি পুরো কোম্পানি না রেখে পালাক্রমে এক প্লাটুন পাকসেনা এবং কিছু রাজাকারকে যাদবপুর ক্যাম্প রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকসেনারা দিনের বেলায় টহলে গেলেও মাঝে মধ্যেই মেহেরপুর চলে আসে। আক্রমণের মুখে ঠেলে দেয় রাজাকারদের। হাবিলদার আবু হোসেনের নেতৃতবাধীন নিয়মিত বাহিনী এবং লুৎফর রহমান লালা ও আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনী ২৫ ও ২৬ নভেম্বর পরপর দুদিন কালাচাঁদপুরের ক্যাম্পটিও উচ্ছেদ হয়। ২৫ নভেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী প্রতিদিনই মেহেরপুরের ওপর প্রবল আক্রমণ করতে থাকে। দিনেরাতে যে কোনো সময়ই চলে গুলিবর্ষণ। সেই সঙ্গে মর্টার থেকে শেল নিক্ষেপ পাকসেনাদের অত্যন্ত ভীতসস্ত্রস্ত করে তোলে। ফলে এ সময় থেকে তাদের অনেকেই আশ্রয় নেয় মাটির তলে; কালাচাঁদপুর থেকে বামুনপাড়া পর্যন্ত গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা ট্রেঞ্চে। তবু ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কেবলমাত্র দিনের বেলায় শহরের কোথাও কোথাও গুটিকতক পাকসেনা এবং রাজাকারকে টহল দিতে দেখা যায়। ২৫ তারিখে মুক্তিবাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাতে পৌর এলাকার রিকশাচালক আইনাল হকের স্ত্রী হাওয়া বিবি মারা যায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬ নভেম্বর লেখা হয়ঃ.. মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোর লড়াই চলছে। এদিনে গাংনী থানাতেও নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে গ্রামে সংগঠিত হতে থাকে এবং গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখে। কাজীপুরের আব্দুর রহমান এবং আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিজ এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। বেতবাড়িয়রা আব্দুল হানিফ এবং হাড়ভাঙ্গার মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ বামুন্দী এলাকায় চলে আসে। বাদিয়াপাড়ার আজগর আলীর নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিজ এলাকায় দায়িত্ব নেয়। হোগলবাড়ি-মোহাম্মদপুর এলাকায় তাহাজের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা তৎপরতা চালাতে থাকে। হেমায়েতপুরের আজিজুল হক, ষোলটাকার হজরত আলী, কুঞ্জনগরের আব্দুল মতিন, করমদির আবু বকর, হিন্দির আব্দুল হান্নান নিজ নিজ গ্রুপ নিয়ে গাংনী শহরের পূর্ব দিকে গাংনী-আলমডাঙ্গা রাস্তার দু’ পাশের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে। আবুল কাশেম কোরাইশির গ্রুপ ২৯ নভেম্বর ভারতের পাকশিতে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নূরুল হক সাহেবের কাছ থেকে সর্বশেষ নির্দেশনা গ্রহণ করে গাংনীর উদ্দেশ্যে রওয়া দেয়। এ গ্রুপে ছিল চৌগাছার আব্দুল জলিল, মসলেম, নবীছদ্দি, মুলুকচাঁদ, ভরাটের ইয়ারুল, আব্দুল হাই, নজরুল, ধানখোলার কদম আলী, জয়নাল হক, গাংনীর দোয়াত আলী, রামনগরের হাশেম আলী, মুন্দার আলতাফ, হিন্দার মঙ্গল, চিৎলার আইজদ্দি, রাইপুরের রুহুল আমিন, খাসমহলের ইব্রাহিম। এসব গ্রুপ তেতুলবাড়িয়া-ভরাট তেরাইল-জোড়পুকুর হয়ে কাষ্টদহে রাত্রিযাপন করে। ঐ রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা বানিয়াপুকুর, রাইপুর , শিশুতলা, জোরপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সহড়াবাড়িয়াতে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গম ঘাঁটি। তাদের সাথেও যোগাযোগ হয়। পরদিন কড়ুইগাছিতে খবর পাঠালে হিন্দার হান্নান, কামাল, সুলতান এসে শিমুলতলায় রফিকুল্লাহর বাড়িতে একত্রিত হয় এবং গাংনী দখলের পরিকল্পনা করা হয়। এরই মাঝে খবর পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ভাটপাড়া ক্যাম্পের পাকসেনারা ক্যাম্পের অদূরের কালভার্টটি ৩০ তারিখে নিজেরাই ধ্বংস করে দিয়েছে। ডিসেম্বর-১৯৭১ গাংনী থানার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট গেরিলা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং অভিন্ন আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। মোহাম্মদপুরের তাহাজ তার গ্রুপ নিয়ে চলে যায় আকবপুর হোগলবাড়িয়া এলাকায় প্রধান সড়কের আশেপাশে অবস্থান গ্রহণের জন্য। ভাটপাড়া-নপড়া এলাকার দায়িত্ব মহিবুল- দেলোয়ারের। কাজীপুরের আঃ রহমান, আব্দুল লতিফ হানিফ-গ্রুপের সঙ্গে বামুন্দী এলাকার দায়িত্বে। বাদিয়াপাড়ার আজগর আলীর গ্রুপের দায়িত্ব হলো মালশাদহ ব্রিজ ধ্বংস করা। তারা ৩ ডিসেম্বরে গোপালনগরের কালভার্ট ধ্বংস করে। সকল গ্রুপকেই গাংনী আক্রমণের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ইতিমধ্যে শিকারপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী সহড়াবাড়িয়া হয়ে মানিকদিয়া পৌছেছেন শুনে আবুল কাশেম কোরেশী এবং আব্দুল হান্নান তাদের দলদল নিয়ে মানিকদিয়ার মোজাম্মেল হকের বাড়িতে গিয়ে গাংনী আক্রমণের বিষয়ে ক্যাপ্টেন চৌধুরীর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেন। ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী গাংনী থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ২ তারিখেই আলমডাঙ্গা থানার বাঁশবাড়িয়াতে চলে যান। এ দিন মঠমুড়ার মারজেল হোসেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বাওট প্রাইমারি স্কুলের রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ১৩ জন রাজাকারের অস্ত্র কেড়ে নেয়। এ অভিযানে মুজিব বাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত ছিল বলে জানা যায়। হোগলবাড়িয়ার কোরবান আলীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ৩ ডিসেম্বর খলিশাকুণ্ডি ঘাটের পশ্চিমে প্রধান সড়কে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকসৈন্যের একটী গাড়ি ধ্বংস সাধন করে। এতে কমপক্ষে ৫/৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিষেধ উপেক্ষা করে রাস্তায় ওঠার কারণে একটি ঘোড়াগাড়িও ধ্বংস হয় এবং চালক নিহত হয়। এ অভিযানে অংশগ্রহণ করে মঠমুড়ার ফজলুর রহমান, নাসির উদ্দীন, আকবপুরের কুতুব আলী, হোসেন, জহুরুল, মোহাম্মদপুরের আমিরুল, হোগলবাড়িয়ার জহুরুল মুলক এবং খরিশাকুণ্ডির আব্দুর রহমান। ডিসেম্বরের ৩ তারিখের মধ্যে মেহেরপুর শহরের চতুর্দিকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করে। আমঝুপি, বারাদি, বন্দর, মোনাখালি, যাদবপুর, গোভীপুর, উজলপুর, মনোহরপুর, দীঘিরপোড়া, গোপালপুর-এই সব গ্রামে অবস্থা নিয়ে মেহেরপুর কলেজ ও ভকেশনাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আস্তানায় একযোগে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ৩ তারিখে কলকাতার খবরে মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী কলকাতার মাঠ থেকেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করবেন বলে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু বাসতে তেমনটি হয়নি। পাকিস্তান পশ্চিম সেক্টরে ভারত আক্রমণ করায় এ দিন থেকে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। পরদিন জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দীন ক্যাপ্টেন এ.আর.আজম চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করে একে প্লাটুন ইপিআর এবং ২০ জন গেরিলা, মোট ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে বেতাই থেকে মেহেরপুরের আমঝুপি বারদি এলাকায় প্রেরণ করেন। তারা ঐ দিন রওনা হয়ে রাতে এসে টঙ্গি-গোপালপুরের মোহাম্মদ খরিশের বাড়িতে কাটায় এবং পরদিন পাটকেলপোতা এলাকায় মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দক্ষিণে অ্যাম্বুশ পেতে বসে থাকে। ৫ ডিসেম্বর কড়ইগাছি, রাইপুর শিমুলতলা, কুঞ্জনগর, ঝোরপাড়া, সহড়াবাড়িয়া প্রভৃতি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা গাংনী অভিমুখে রওনা হয়ে গোপালনগরে একত্রিত হয়। কিন্তু গাংনী বাজারে কিংভা ভাটপাড়া ও বামুন্দী ক্যাম্পে পাকসেনাদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য জানতে না পারায় এদিন গাংনী অভিযান স্থগিত রাখা হয়। তবে পরিকল্পনা নেয়া হয় উত্তর-দক্ষিণ বিস্তত সেউটি নদীর তীরে পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেবে এবং সবাই একযোগে গাংনীতে প্রবেশ করবে। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে মেহেরপুরের উপকণ্ঠে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে ৭ নং ভারতীয় ব্রিগেডের অধীনে ৫ নং রেজিমেন্ট সমবেত হয়। মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জৈল সিং ৬ তারিখে মেহেরপুর শহরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মেহেরপুরের উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনীর উপস্থিতির খবর মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গার পাক সেনাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা তখন দর্শনা, জীবননগর, ঝিনাইদহ থেকে তাড়া খেয়ে চুয়াডাঙ্গা ঘাঁটিতে একত্রিত হয়ে কুষ্টিয়া অভিমুখে পালানোর পথ খুঁজছিল। পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর হয়ে কুষ্টিয়া যাবার পরিকল্পনা পাকসেনাদের গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে চেষ্টা করে। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। দীর্ঘ ন মাস দেশত্যাগী বাঙালিদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দিয়ে উদার মানবিকতা দেখিয়েছে যে ভারত, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ছাত্রযুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধাত্রীপনা করেছে যে ভারত, এদিন সেই ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের গত ও প্রকৃতিতে বিরাট পরিবর্তন আসে। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল হয়ে ওঠে আকাশ্চুম্বি, অন্যদিকে পাকবাহিনীর মনোভাব হয়ে ওঠে অত্যন্ত ভীত ও পলায়নপ্রবণ। শিকারপুর এ্যাকশন ক্যাম্প থেকে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল একটি দল ৬ ডিসেম্বর কাজীপুর সাহেবনগর হয়ে এগিয়ে এসে বামুন্দী ক্যাম্পে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে শেল নিক্ষপ করলে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। অতঃপর সন্ধ্যার পরপর তারা বামুন্দী থেকে আস্তানা গুটিয়ে খরিমাকুণ্ডি হয়ে কুষ্টিয়ার পথে রওনা হয়। পথিমধ্যে গুকরকান্দিতে তাহাজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হঠাৎ আক্রমণ করলে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং কমপক্ষে দু’জন পাকসেনা নিহত হয়। এ দিন ভাটপাড়া ক্যাম্পের পাকসেনারাও রাতের আঁধারে চলে আসে মেহেরপুরে কিন্তু এ সব খবর গাংনী বাজারে পূর্ব্দিকে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা মোটেই জানে না মালশাদহের আব্দুল কাদের গোপালনগর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আনে। তবু মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান এবং দোয়াত আলী বাজার এলাকা রেকি করে গিয়ে জানায়, বাজারে বা থানা পরিষদে পাকসেনা নেই, তবে পিস কমিটি অফিসে মিটিং হচ্ছে, সেখানে বেশ কিছু রাজাকারকে দেখা গেছে। এরই মধ্যে ধানখোলার মকছুদ হোসেন এবং বাদিয়াপাড়ার আজগর আলী থানায় গিয়ে দারোগা-পুলিশদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিলে তারা সেটা মেনে নেয় এবং জানমালের নিরাপত্তা দাবি করে। দুই প্রতিনিধি ফিরে গিয়ে ডাকবাংলোর পিছনে অপেক্ষারত মুক্তিযোদ্ধাদের এ খবর জানালে রাতের আঁধারে চিরে সবাই চিৎকার করে ওঠে জয় বাংলা। যে ধ্বনি এই জনপদে প্রকাশ্যে উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ, সেই আবেগময় রণধ্বনি বিস্ফোরণে জেগে ওঠে জনগণ। নেমে আসে পথে। চোখে মুখে আনন্দ এবং উদ্বেগ-দুইই। মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশাল বাহিনী থানায় গিয়ে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। দারোগা-পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিযোদ্ধা কমদ আলী ও মকসুদ হোসেন তাদের ধানখোলায় নিয়ে যান। ঐ রাতে মুক্তিযোদ্ধারা থানায় উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। হান্নানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পিস কমিটির অফিসে এসে দেখে পিসকমিটির নেতারা এবং রাজাকাররা পালিয়েছে। তালা ভেঙ্গে অফিসের ভেতরে স্বাধীনতার পক্ষে ৩৭৬ জন বিশিষ্ট মানুষের নামের তালিকা সংবলিত একটি রেজিস্টার খাতা আবিষ্কার করে মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলয়াম। ওই তালিকার অনেকগুলো নাম লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া, অর্থাৎ ইতিমধ্যেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। সময় সু্যোগের অভাবে সকলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারেনি ঐ ঘাতকেরা। চুয়াডাঙ্গা থেকে ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর ঝিনাইদহের কিছু পূর্বে মাধুহাটিতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হবার পর আলমডাঙ্গা-পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়া অভিমুখে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। মেহেরপুর পাকসেনারাও চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য রাত আটটার পর নিশছদ্র অন্ধকারের মধ্যে মেহেরপুর ত্যাগ করে। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে মুক্তিবাহিনী পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণের ভয়ে তারা পায়ে হেঁটে রওনা হয়। শূন্য মোটরযানগুলো ধীর গতিতে আগে আগে যায়। হেড লাইট বন্ধ। তার পিছনে কয়েকজন বাঙালি বন্দির মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে। বিছানাপত্রের বোঝা এবং গুলির বাক্স। তারাও পিছনে সারিবদ্ধভাবে চলছে পাকসেনার দল। যতোটা সম্ভব নীরবে নিঃশব্দে এই পদযাত্রা, যাতে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা এলাকাবাসী জানতে না পারে। মুক্তিবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে পিছন থেকেও ধাওয়া করতে পারে এই আশঙ্কায় তারা আমঝুপি পৌছনোর পর আমঝুপি ব্রিজটি ডিনামাইট চার্জ করে উড়িয়ে দেয়। তারপর আবার সবাই আগের মতো চলতে শুরু করে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে। অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একটি জিপ কেবল দাঁড়িয়ে থাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে। ব্রিজ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং সম্ভাব্য হামলা ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে। ব্রিজ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং সম্ভাব্য হামলা ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে। ব্রিজ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধই ছিল রিকয়েললেস রাইফেল সজ্জিত জিপটির আমঝুপি অবস্থানের উদ্দেশ্য। এদিকে পাক সৈন্যবহর দীনদত্ত ব্রিজের কাছাকাছি পৌছুনোর পর অন্য একটি জিপ আমঝুপির দিকে দ্রুত গতিতে ফিরে আসে। এ সময় আমঝুপিতে অপেক্ষায়মান জিপটীও রওনা হয়। দুটি-জিপের হেডলাইট ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত আলো। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতে আমঝুপির কাছে এ দুটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। আহত-নিহতদের তুলে নিয়ে একটি জিপ আবার চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা হয়। বিধ্বস্ত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় একটি জিপ ও একটি মোটরসাইকেল (মোটরসাইকেলটি কিভাবে এলো সে রহস্যের আজো কিনারা হয়নি।) আমঝুপ হাটের কাছে পড়ে থাকে। পাকসেনাবহ দীন দত্ত ব্রিজ পার হবার পর আবার ডিনামাইট চার্জ করে এ ব্রিজটিও ধ্বংস করে। এবার আর এখানে কোনো জিপ না রেখে সবাই এগিয়ে চলে একযোগে। পাটকেলপোতার কাছাকাছি এসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয়। সুবেদার মালেকের নেতৃত্বে ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে রাস্তার দক্ষিণে অ্যাম্বুশ পেতে অপেক্ষায় ছিল সম্মুখভাগে ছিল গণবাহিনীর ২০ জন গেরিলা, দেড় শ’গজ পিছনে কাভারিঙ্গের দায়িত্বে ছিল ৩২ জন ইপিআর। চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে পাকসেনাদের গাড়িগুলো চলে যেতে দেখে মুক্তিযোদ্দারা অধৈর্য হয়ে ওঠে। সুবেদার মালেকের নির্দেশের বিলম্ব দেখে জমিরুল (আমঝুপি) তার এসএলয়ার থেকেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। এরপর রমজান আলীর (আমঝুপি) এলএমজির ব্রাশ ফায়ার। সঙ্গে সঙ্গে মতিয়ার রহমান, আব্দুর রশিদ, মোহাম্মদ খরিশসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র একযোগে গর্জে ওঠে। মজার বিষয় হচ্ছে পাকসেনারা এ আক্রমণের কোনো জবাব না দিয়ে রাস্তার উত্তরে পজিশন নিয়ে আত্মরক্ষা করে মাত্র। প্রায় আধ ঘন্টাব্যাপী গুলিবর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধারা টুঙ্গি গোপালপুর দিকে চলে যায়। এরই মাঝে একজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বন্দি বাঙালীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে পাকসেনারা পজিশন থেকে উঠে আবার হাঁটতে শুরু করে। এভাবেই পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী রাতের আঁধারে মেহেরপুর থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় চুয়াডাঙ্গা এবং সেখান থেকে কুষ্টিয়ায়। এদিকে ব্রিগেডিয়ার জৈল সিং-এর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ৫ নং জাঠ রেজিমেন্ট এবং ক্যাপ্টেন এ.আর. আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বিশাল বহর ৭ ডিসেম্বর সকালে মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে। শত্রুমুক্ত শহরের প্রধান সড়ক ধরে আসার সময় স্বাধীনতাবিরোধী আওলাদ কন্ট্রাক্টরেরে বাড়ির দেয়ালে সাঁটা পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ জিন্নাহর একটি ছবির প্রতি ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মুক্তিযোদ্ধা এ.আর. আজম চৌধুরী জিন্নাহ সাহেবের দুই চোখে পরপর দুটি গুলি ছুঁড়ে বাঙালির লক্ষ্যভেদী অব্যর্থ নিশানা সম্পর্কে ব্রিগেডিয়ারকে অবহিত করেন। এরপর শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র থেকে আকাশমুখী ফাঁকা গুলিবর্ষণ মেহেরপুর শহর জেগে ওঠে। বিজয়ের আনন্দে। অবরুদ্ধ শহরবাসী রাস্তায় নেমে বুকে জরিয়ে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সবার মুখে হাঁসি, চোখে অশ্রু। এরই মাঝে মুহুর্মহু গগনবিদারী রণধ্বনি জয়বাংলা। ক্যাপ্টেন এ. আর. আজম চৌধুরী নিয়মিত বাহিনীর সি কোম্পানির একটি প্লাটুন নায়েক সুবেদার মালেকের নেতৃত্বে মেহেরপুরে রেখে অবশিষ্ট দুটি প্লাটুন এবং মিত্রবাহিনিকে সঙ্গে ন্নিয়ে পায়ে হেঁটে চলে যান চুয়াডাঙ্গা; উদ্দেশ্য ঝিনাইদহ হয়ে কুষ্টিয়া অভিমুখে পাকবাহিনীকে ধাওয়া করা। এই একই উদ্দেসশ্যে ঝিনাইদহ ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীও আলমডাঙ্গা হয়ে রওনা হন। অবশ্য এক কোম্পানি ভারতীয় সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন ইয়াদু মেহেরপুর কলেজে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে অবস্থান গ্রহন করেন। নায়েক সুবেদার মালেক নিয়মিত বাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অবস্থান নেন সি এ্যান্ড বি ডাকবাংলাতে। আন্সার ক্যাম্পে নজরুল ইসলাম ভোদার নেতৃত্বে গেরিলাবাহিনি এবং হাদু বাবুর বাড়িতে কাজী মুমিনুল হক বাচদচু, লুৎফর রহমান লালা, সাদিক হাসান রুমি প্রমুখ গোরিলা কমান্ডাররা অবস্থান নিয়ে মেহেরপুরের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গাংনীতেও গেরিলা কমান্ডার আজমাইন হোসেন থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসাবে ডাকবাংলোতে অবস্থান নিয়ে গাংনী থানার বেসামরিক প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহন করেন। তারা সবাই আনন্দে আপ্লুত জনসাধারণকে রাস্তাঘাটে পুঁতে রাকাহা মাইন সম্পর্কে সচেতন করার এবং আত্মগোপনকারী স্বাধীনতাবিরোধী লোকজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এরই মাঝে ভারতপ্রবাসী মানুষেরা ঘরে ফিরতে শরু করে, নেতৃবৃন্দও ফিরে আসেন। নিজ নিজ এলাকায়। জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মোঃ সহিউদ্দীন এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব মোঃ নূরুল হক দেশে ফিরে এসে যথাক্রমে মেহেরপুর এবং গাংনীর প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহন করেন। জনজীবনে ধীরে ধীরে নেমে আসে স্বস্তি। আনন্দ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রহর গোণে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য। এই আনন্দঘন দিনগুলোতে চোখে পড়ে অন্য এক দৃশ্য। সজন হারানো শোকার্ত মানুষ পাগলের মতো ছুটে আসে মেহেরপুর কলেজের পিছনে বিস্তৃত বধ্যভয়মিতে, কালাচাদপুর, ভাটপাড়া, বামুন্দী, নাটুদা প্রভৃতি পাকসেনা ক্যাম্পে। বিকৃত চেহারা অসংখ্য লাশ সরিয়ে সরিয়ে খুঁজে ফেরে সজনের মুখ। সামান্য একটু পোশাকের চিহ্ন কিংবা চুলের দৈর্ঘ্য দেখে শনাক্ত করে আপনজনকে, পরক্ষণেই ভুল বুঝ্রে পেরে গলিত লাশের ওপরে আছড়ে পড়ে কান্নায়। অবশেষে কলেজের পিছনের বধ্যভূমিতে থেকে অসনাক্তযোগ্য লাশ এবং মাটির ওপরে জেগে থাকা হাড়গোড় একত্রিত করে কলেজের দক্ষিণে মেহেরপুরে চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাশে গণকবরে সমাহিত করা হয়।
[১০৩] রফিকুর রশীদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত