You dont have javascript enabled! Please enable it!

বোরহানউদ্দিনের সম্মুখ যুদ্ধ-২, ভোলা

বাংলাবাজারের ৮-১০ কিলোমিটার দক্ষিণেই বোরহানউদ্দিন থানা। বাংলাবাজার যুদ্ধের মাত্র দুইদিন পড়ে অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর বিভীষিকাপূর্ণ এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যদিও বোরহানউদ্দিন থানা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এবং ভোলা মুক্তিযুদ্ধে পুরো টিম বোরহানউদ্দিনে অবস্থান করছিল, তবু ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তারা দুর্দর্শ পাক আর্মি দ্বারা আক্রান্ত হবে, সে রকম কোনো প্রস্তুতিই তাদের ছিল না। কিংবা পূর্ব থেকে কোনো ইনফরমেশনও তারা পায়নি। ফলে পাকবাহিনীর তোপের মুখে তারা দাঁড়াতেই পারলো না। যুদ্ধের একদিন আগ থেকেই মুক্তিবাহিনীর দুটি দল বোরহানউদ্দিন হাইস্কুলে অবস্থান করছিল। এর একটি গ্রুপের নেতা ছিলেন চরফ্যাশনের আবুল কাশেম। এই দলটি ভারত থেকে আসা এবং অথাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত। তারা পশ্চিম দিকের নদী পথে এসে বোরহানউদ্দিন ওঠে। এখানে আসার পর তারা তৎকালীন সি.ও. আজিজুল ইসলাম সাহেবের কাছে চরফ্যাশন যাবার জন্য একটি গাড়ি চায়। কিন্তু সি.ও সাহেব গাড়ির ক্রটির কথা জানিয়ে তাদের একটি ট্রাক্টর প্রদান করে। এই ট্রাক্টর যোগে তাদের ক’জন চরফ্যাশন যাবার পথে মনিরামের কাছে অ্যাক্সিডেন্ট করে যথারীতি আবার বরহানউদ্দিন স্কুলে ফিরে আসে। তাদের কাছে ছিল ভারতীয় ও রাশিয়ান এস এল আর, লাইট মেশিনিগান, রকেট লাঞ্চার। ওপর দলের নেতা ছিলেন হাবিলদার মুজিবুর রহমান। তার দলের সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। তারা অবস্থান করছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারা মূলত যুদ্ধ করতো বরিশাল সেক্টরে শাজাহান ওমরের নেতৃত্বে। এছাড়া হাকিম সিদ্দিকের নেতৃত্বে যে চার পাঁচশ যোদ্ধা ছিল তারাও বোরহানউদ্দিনের চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করছিল। এরমধ্যে পঞ্চাশ জনের একটি দল শামসুল হকের নেতৃত্বে বাজারের পশ্চিমে ছিটু ব্যাপারীর বাড়িতে অবস্থান করছিল। কমান্ডার সিদ্দিকের নেতৃত্বে বড় দলটি বাজারের মধ্যকার থানা ও তার আশ পাশে অবস্থান করছিল। এভাবে অবস্থান নেয়ার কারণ, পাকবাহিনী যাতে খুব সহজে বাজারে হামলা চালাতে না পারে। শহর রক্ষাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া তখন পাকবাহিনী কেবল ভোলা শহরে কেন্দ্রীভূত। হামলা যদি আসে সেটা আসবে কেবল উত্তর দিক থেকেই। আর সেদিকে তো কাশেম ও মুজিবরের নেতৃত্বে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বড় আকারের দুটি দল মোতায়েনই করা আছে। কিন্ত তারা মোটেও ভাবেনি পশ্চিম দিকের নদী পথে এসে পাকআর্মি কোনো হামলা চালাতে পারে। অথচ সেই আক্রমনটাই ছিল ভয়াবহ এবং সেটাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যই সড়ক পথে ভোলা থেকে কয়েক গাড়ি আর্মিকে মার্চ করিয়ে দেয়া হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা খুব দ্রুত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ভরবেলায় ফজরের নামাজ পড়ে সবাই পায়চারী করছিল। ততক্ষণে পাকআর্মির গানবোট বাজারের পশ্চিমে শিকদার চরের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে। ছবদী হাওলাদার বাড়ির আইয়ুব আলী ও তার ছোট ভাই বাশার দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পাকবাহিনীর আগমনের সংবাদ দেয়। আইয়ুব আলী এমনভাবে দৌড়াচ্ছিল যে, তার গায়ের চাদর মাটির সাথে লেপ্টে যাচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল ছিল না। সংবাদ পাওয়া মাত্র জুলফিকার প্রথমে শামসুল হককে জানাল। পড়ে সে কমান্ডার সিদ্দিক সাহেবকে জানানোর জন্য বাজারে ছুটে গেল। বাজারে এসে দেখেন সিদ্দিক সাহেব দক্ষিণ দিক থেকে বাজারের মধ্যকার রাস্তা ধরে উত্তর দিকে যাচ্ছেন। তিনি তখন পর্যন্ত শক্রর আগমন সংবাদ পাননি। জুলফিকারের কাছে সংবাদ পেয়ে দ্রুত দক্ষিণ দিকে ধাবিত হলেন। যাতে তার নিজস্ব বাহিনীকে তৈরি করে শক্র বাহিনীর আগমন প্রতিরোধ করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে সিটি মেরে সকলকে সতর্ক হওয়ার আহবান জানালেন। জুলফিকার চিৎকার দিয়ে আর্মির আগমন সংবাদ দিয়ে দ্রুত নিজ দলের কাছে ফিরে গেল। পাকবাহিনী তখন দু’দলে বিভক্ত। একদল গানবোট নিয়ে দক্ষিণে খেয়া ঘাটের দিকে চলে গেল। আরেকটি দল শিকদার চরে নেমে ধানক্ষেতের আড়ালে বাজারের দিকে পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছিল। সুবেদার শামসুল হক তার অনুগত পঞ্চাশ জন নিয়মিত যোদ্ধা নিয়ে তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেন। ওপর গানবোটটি ততক্ষণে জেলেবাড়ি গোডাউনের কাছাকাছি চলে এসেছে। মিলিটারি ভারী অস্ত্রের সাহায্যে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে ভয়াবহ শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহবল হয়ে পড়ে। ফলে সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের বাঁধা দেয়ার কোনোই সুযোগই পায়নি তারা। ওদিকে ছোট মনিকার দিক থেকে গানবোট থেকে নেমে পাকআর্মির যে অংশ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এসে বোরহানউদ্দিন বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছিল তাদেরকে শামসুল হকের বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় মাঝি বাড়ির পুকুরের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ে। কেউ অবস্থান নেয় গাছের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধারা একটা গুলি চালালে তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি চলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা নিশানা করে গুলি ছুড়লে তারা ধানগাছের আড়ালে মাথা নিচু করে। যখন গুলি বন্ধ হয় অমনি তারা সামনে এগুতে থাকে। যোদ্ধাদের কিছু গুলি ধান গাছের উপর দিয়ে চলে যায়। এ অবস্থায় পশ্চিম দিকের বাহিনীকে প্রায় এক ঘন্টা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। পড়ে যখন মুক্তিযোদ্ধারা টের পেলো যে, পিছনে বাজারের দিকে ভয়াবহ ফায়ারিং হচ্ছে এবং পুরো বাজার মিলিটারির কব্জায় চলে গেছে তখন আত্মরক্ষার জন্য তারা আরো উত্তর দিক দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করে। ক্রলিং করে তারা ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছোট মানিকার দিকে চলে যায়। এবং অবস্থান নেয় তিন কিলোমিটার দূরের একটি ধানক্ষেতে। সেখান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা বরহানুদ্দিন বাজার জ্বলতে দেখল। বিকেল আনুমানিক তিনটার দিকে রফিক চৌধুরী, তোফাজ্জল শিকদার ও মজিবুর রহমান সেখানে গিয়ে তাদের সাথে মিলিত হল।
[৩৭] কালাম ফয়েজী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!