ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন থানায় মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে বাঙালিদের জন্য সবচেয়ে বিষাদময় অধ্যায় হল গণহত্যা এবং লজ্জাজনক প্রসঙ্গ হল স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির ভূমিকা। কারণ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যতটা না ক্ষতি করতে পেরেছে, এ দেশীয় পাকিস্তানী দোসররা আরো বেশি ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানীরা ভিন্ন ভাষা-ভাষী, ভিন্ন ভূখণ্ডের। তাদের পক্ষে বাঙালিদের চিহ্নিত করা, তাদের তৎপরতার নজরদারি করা সম্ভবপর ছিল না। তখন এ দেশীয় কিছু মানুষ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা সাহয্যের জন্য বিভিন্ন নামে সংস্থা-সংগঠন প্রতিষ্টা করে। বাহ্যত উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের অখন্দতা রক্ষা করা। কিন্তু তাদের কারকলাপ মানবতার ইতিহাসে কলঙ্ক-দান এঁকে দিয়েছে। তাদের এ কর্মকাণ্ডের একটি দীর্ঘ প্রেক্ষাপট নিম্নে তুলে ধরা হল।
১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ও আশপাশ এলাকা পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত ছিল। এ সময়ে জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিবি), মুসলিম লীগ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারাও স্বাধীনতাকামী জনতা এবঙ মুক্তিবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। অনেকেই ব্যাক্তিগত চাঁদা, গরু-ছাগল, চাল-ডাল দিয়ে মুক্তিবাহিনীর রেশন যোগাতে সহায়তা করে। অবশ্য কেউ কেউ প্রথম থেকেই আত্মোগোপন করেছিল। কিন্তু ১৬ এপ্রিল পাকহানাদার কতৃক ব্রাহ্মণবাড়িয়া পতনের পরপরই তাদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। তারা পাকিস্তানী সামরিক সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। সুহিল্পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান, পৌরসভার সহ-সভাপতি মরহুম আজিজুর রহমান মোল্লা, পিডিবির মরহুম আবদুর রহমান (১৯৫৬-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সমবায় ও পাটমন্ত্রী), মরহুম হামিদুল হক টুক্কু প্রমুখ পাকিস্তানী পতাকাবাহী মিছিল নিয়ে হানাদার বাহিনীকে অভিনন্দন জানায়।
মে মাসের ১৪-১৫ তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শান্তি কমিটির উদ্যোগে লোকনাথ দীঘির মাঠে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় পাকিস্তানী বাহিনী, দালাল্ম রাজাকার ও বিহারিরা পাকিস্তানের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে অংশগ্রহণ করে এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা শহরতলীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে মিছিল নিয়ে আসে। মিছিলকারীদের শ্লোগান ছিল: ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ, শান্তি কমিটি-জিন্দাবাদ, ভারতের দাললরা-হুঁশিয়ার সাবধান, পাকিস্তান ফৌজ-জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান-জিন্দাবাদ, টিক্কা খান-জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান নিপাত যাক, ভারতকে খতম কর’ প্রভৃতি। মিছিলকারীদের হাতে ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান ও জিন্নাহর ছবি ছিল। এরপরই শান্তি কমিটির সদস্যদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করে। বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করে এরা জনগণকে রাজাকার বাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করে। আর কেউ রাজাকার বাহিনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে তার উপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হত। এরই মধ্যে শান্তি কমিটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী অফিসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই অফিসের জন্য স্থান হিসাবে ঠিক করা হয় শহরের কুমারশীল মোড়ে একটি হিন্দু বাড়ি। বাড়িটি দখল করে শান্তি কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘শান্তি ভবন’। এ অফিস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গণহত্যার নীল নকশা তৈরি করা হত। এখান থেকে আইডেন্টিটি কার্ড (ডান্ডিকার্ড) না পরিচয়পত্র প্রদান করা হত। এই কার্ড সংগ্রহ করা সবার জন্য বাধ্যতামুলক করা হয়। আইডেন্টিটি কার্ড-বিহীন কেউ রাজাকার বা হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃত হলে তাঁকে হত্যা করা হত। এই কার্ড সংগ্রহের জন্য গ্রামের লোকজন শহরে আসতেও সাহস পেত না। কারণ, পথিমধ্যে তল্লাশীর সম্মুখীন হিলে কার্ড প্রদর্শন করতে না পারলে নির্ঘাত মৃত্যু।
২১ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তান সামরিক সরকার রেডিও পাকিস্তান থেকে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সকল প্রতিষ্টানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। আর যারা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকবে, তাদের বাড়িঘর ও মালামাল ক্রোক করার ভয় দেখানো হয়। এই নির্দেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও কার্যকর করার জন্য মে-জুন মাসে শান্তি-কমিটি তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্ত অনেকেই কাজে যোগদান করে নি। আবার কেউ কেউ কাজে যোগদানের আবরণে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য-সহযোগীতা করার জন্য শহরে চলে আসে। মুষ্টিমেয় কিছু দালাল, রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য ছাড়া সকল বাঙালিই তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণ করে। আর যারা কাজে যোগদান করেনি, শান্তি কমিটির সদস্যরা তাদের নামের তালিকা তৈরি করে পাক-বাহিনীর কাছে জমা দেয়। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা তাদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। আবার অনেক লোক কাজে যোগদান করেও হত্যার শিকার হয়।
২০ মে প্রাদেশিক সরকার ঘোষণা করে যে, ২ আগস্ট থেকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্টান পুনরায় চালু করতে হবে। জুলাই মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের উপস্থিতি এবং নিয়মিত ক্লাস শুরু করার ব্যাপারে শান্তি কমিটি তৎপরতা চালায়। যে সকল শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী অনুপস্থিত থাকবে, তাদেরকে বাড়ি থেকে ধরে আনার ভয় দেখানো হয়। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে শান্তি কমিটির সদস্যরা স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা করার সময় যাদের বাড়িতে পাওয়া যায়নি, তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বলে রিপোর্ট করা হয়। তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। কারো কারো ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। কোন কোন শিক্ষক স্কুলে উপস্থিত থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এরই মধ্যে আগস্ট মাসে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এস.এস.সি) ও উচ্ছ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচ.এস.সি) পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়। শান্তি কমিটি এই পরীক্ষা সুষ্টূভাবে অনুষ্টানের সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করে। ২৭ জুলাই অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে এস.এস.সি পরীক্ষা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটির এক সভা অনুষ্টিত হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তি কমিটির আহবায়ক হাবিবুর রহমান ভূঁইয়াসহ শহরের শান্তি কমিটির সকল সদস্যবৃন্দ। অপরদিকে এই পরীক্ষা স্থগিত করার জন্য মুক্তিবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর নানা ভয়ে-ভীতিকে উপেক্ষা করে শান্তি কমিটির ওপর ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিত করানোর দায়িত্ব অর্পণ করে তারা পরীক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। পাকিস্তানী মেজর ইউসুফ নিজে উপস্থিত হয়ে শান্তি কমিটির উপর ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি করানোর দায়িত্ব অর্পণ করে। পরীক্ষা গ্রহণের প্রতিবাদে মুক্তিবাহিনী অন্নদা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূর আহম্মদের বিরুদ্ধে একটি চরমপত্র বিলি করে। এই চরমপত্র বিলি করে। এই চরমপত্রের মধ্যে উল্লেখ ছিল যে,
‘পরীক্ষা নেওয়া হলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে হত্যা করা হবে, পরীক্ষার হলে বোমা নিক্ষেপ করা হবে, প্রধান শিক্ষকের কল্লা থাকবে না’।
প্রধান শিক্ষকের নিকটও চরমপত্রের কপি পাঠানো হয়। কিন্ত সকল বাঁধা অতিক্রম করে মেজর ইউসুফ নিজে সকল প্রকার শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে পরীক্ষা গ্রহণের তাগিদ দেয়। মুক্তিবাহিনী প্রধান শিক্ষকের বাসায় ও অন্নদা স্কুল-সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গোপনে রাজাকার ক্যাম্পে উপর্যুপরি গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকেন। এই সময় রাজাকাররা আতঙ্কিত হয় এক্যাম্প ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। স্কুলের পিয়ন আব্দুস সালাম মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গ্রেনেড নিক্ষেপের সময় দেখে ফেলে। হুমায়ূন কবির সালামের পূর্ব-পরিচিত। তাই সালামকে এই ব্যাপারে মুখ না খোলার জন্য সতর্ক করে দিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করেন। সালামও ঘটনাটি কাউকে বলে নি। কারণ, ব্যাপারটি জানাজানি হলে হুমায়ুন কবির ও তার সাথীদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াসহ তাদের আত্মীয়-স্বজনকে নির্যাতন ও হত্যার সম্মুখীন হতে হত।
অন্যান্য স্কুলের মত আগস্ট মাসে অন্নদা স্কুলে পাকসেনাদের কোঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্ত এই পরীক্ষায় শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কারণ অধিকাংশ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আর ছাত্রীরা যারা দেশে ছিল, তারা রাজাকারদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয় নি। শুধু শান্তি কমিটি ও দালাল রাজাকারদের ছেলে মেয়েরাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এভাবে এস.এস.সি পরীক্ষার মত এইচ.এস.সি. পরীক্ষাও অনুষ্টিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসকল পরীক্ষা বাতিল করা হয়।
৬ সেপ্টেম্বর শান্তি কমিটির প্রচার সম্পাদক ফারুকুল ইসলামের উদ্যোগে পাকিস্তানী মেজর আশরাফ চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্টিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম পরিবর্তন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ‘নেজামে ইসলাম’ এর সহসভাপতি মওলানা তাজুল ইসলামের নামানুসারে ‘তাজুল ইসলাম নগর’ রাখা এবং ‘সংহতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। ‘সংহতি’ পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিল ফারুকুল ইসলাম আর সম্পাদকমণ্ডলির সদস্য ছিল তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী। এ পত্রিকা প্রকাশের সকল প্রকার খরচ সংগ্রহ করা হয় কয়েকটি হিন্দু বাড়ি নিলামে বিক্রি করে। অক্টোবরের সভায় এ নামও (তাজুল ইসলাম নগর) পরিবর্তন করে আল্লাহ্র ৯৯ নামের একটি ‘রহমান’ অনুসারে ‘রহমানবাড়িয়া’ রাখা হয়। এ নামের একটি ফলক ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন এ উন্মোচন করা হয়। শান্তি বাহিনী ও হানাদাররা ব্যাতীত সাধারণ জনগণ কখনও এ নাম ব্যাবহার করেনি।
পাকিস্তানী হানাদাররা এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের এক সভা আহবান করে। উক্ত সভায় পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস এবং হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তুলে ধরা হয়। শিক্ষকদের শিক্ষাঙ্গনে কেবল মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাকবাহিনী ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে এরা নির্যাতন ও গণহত্যায় মেতে ওঠে। এরই মধ্যে ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। মাওলানা ভাসানী ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষনায় জনমনে নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সর্বত্র ধর-পাকড় চলতে থাকে, শান্তি কমিটির তৎপরতাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পরিকল্পিত গণহত্যা ও গ্রেফতারের ষড়যনন্ত্রে লিপ্ত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা তৈরি করে। ২৭ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক লুৎফুর রহমানকে কলেজ থেকে গ্রেফাতার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়ার পূর্বে ৬ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী জেলখানা থেকে অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, অ্যাড.আকবর হোসেনসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে কুড়ুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে হত্যা করে। তবে পাকসেনাদের দোসরদের কাজ এখানেই সীমিত ছিল না। তাদের সাহায্য নিয়ে ১৬ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩টি নারী নির্যাতন ক্যাম্পে অসংখ্য নারী নির্যাতিত হয়েছে, ২৬টি স্থানে প্রায় ১২৭৯ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনী মহকুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিকল্পিত অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। নিম্নে থানা ওয়ারি এর কয়েকটি বিবরণ পেশ করা গেল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরঃ ১৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর পাকবাহিনী দখলের পর সুহিলপুর গ্রামের জামাতে ইসলামীর নেতা হাবিবুর রহমান ভুঁইয়াকে আহবায়ক ও কাজীপাড়ার সৈয়দ এ টি এম ওবায়দুল্লাহকে সদস্য সচিব করে ৫৫ সদস্য-বিশিষ্ট সদর-থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, এই কমিটির বেশির ভাগ সদস্য ছিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মসজিদের ইমাম। রাজনীতিকভাবে তারা ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-এর সদস্য বা সমর্থক। এরা পাকবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে। কিছুদিন পর সুলিহপুর মৌলভীপাড়ার আবুল কালাম চোউধুরীকে রাজাকার কমান্ডার করে ৯৪ সদস্য-বিশিষ্ট মহকুমা রাজাকার কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, এই কমিটির সদস্যগণ ছিল সমাজের নিম্ন শ্রেনীর, যেমন- দিনমজুর, রিক্সাচালক ও কৃষক। তাদের রাজনৈতিক কোন পরিচয় ছিল না। এই কমিটির মাধ্যমে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজাকার কমিটি গঠন করা হয়। এই সকল কমিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে পাকবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী তৎপরতাকে জোরদার করে।
১ মে মাছিহাতা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ তৎকালীন সভাপতি হামিদুল হক হামদু খবর সংগ্রহের জন্য আগরতলা থেকে বাড়ি আসেন। তার আগমনের সংবাদ পেয়েই রাজাকার কমান্ডার হাফিজ উদ্দিনের সাহায্যে পাকবাহিনী ২ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে রেলগাড়ির একটি ইঞ্জিন নিয়ে ভোর রাতে আটলা গ্রামে আক্রমণ চালায়। হামিদুল হকও পাকবাহিনীর সংবাদ পেয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামিদুল হককে না পেয়ে পরে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান (মনু মিয়া) ও খেলু মিয়ার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর আক্রমণে সেদিন আটলা গ্রামের আবদুল মান্নান (মনু মিয়া), খেলু মিয়া, আহমদ মিয়া, ওয়াহেদ বক্স, আমির হোসেন, আবদুল মোতালেব, সিদ্দিক মিয়া, আবদুল কুদ্দুস প্রমুখ শহীদ হন।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতগামী একদল ছাত্র তিতাস নদী অতিক্রম করার সময় সুহিলপুর গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম চৌধুরীর হাতে ধৃত হয়। রাজাকাররা তাদের সবাইকে হত্যা করে লাশ তিতাস নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
১৭ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরে পাকবাহিনী, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পশ্চিম এলাকা নাটাই, ভাটপারা, রাজঘর, খরিয়ালা, বিরাসার এই সকল গ্রামে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ২৩ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাকবাহিনীর দাতিয়ারা ওয়াপদা ক্যাম্পে আটকে রেখে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৮ আগস্ট তাদের মধ্যে থেকে ১৩ জনকে হাত ও চোখ বেঁধে দাতিয়ারা ওয়াপদা অফিসের পূর্ব দিকে মোউলভী আলী আজমের বাড়ির পাশে গুলি করে হত্যা করার পর মাটি চাপা দেওয়া হয়। আর বাকি ১০ জন দীর্ঘদিন নির্যাতন ভোগ করার পর শান্তি কমিটির সদস্য ও দালালদের মাধ্যমে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনী হামলা চালিয়ে নারীদের ওপর যে নির্যাতন করেছে তা রীতিমত ভীতিকর। রাজাকাররা নিজেদের প্রবৃত্তি-পুরণের লক্ষ্যে নারীদেরকে ধরে নিয়ে যেত। কখনো কখনো আবার তা পাকিস্তানী নারী-লোভীদেরকে সরবরাহ করত। এ সমস্ত ধৃত নারীদের উপর পালাক্রমে অত্যাচার করত। মোছাঃ চানুভান এমনই এক ধৃত নারী। বিধবা মাতার একমাত্র অবিবাহিত কন্যা। পত্তন ইউনিয়নে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা সর্বত্র লুন্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে। ১৭ জুলাইয়ের দিকে বানু মিয়া, চান মিয়া, সোনা মিয়া নামক রাজাকার গভীর রাতে চানুভানকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর কাছে অর্পণ করে। এর বিনিময়ে তারা প্রচুর মদ ও গ্রামে লুন্ঠনের অনুমতি লাভ করে। রাজাকারদের কাছে কান্নাকাটি করেও চানুভান মুক্তি লাভ করতে পারে নি।
চানুভাবনকে পেয়ে পাকসদস্যরা উল্লাসে নেচে ওঠে। চানুভান কাকুতি-মিনতি করে তাদের হাত থেকে মুক্তি চাইতে থাকে। কিনতি কোনোভাবেই তাদের হৃদয় গলানো সম্ভব হয় নি। তারা প্রথমে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর সংবাদের জন্য চাপ দিতে থাকে। সে এ ব্যাপারে অজ্ঞাত প্রকাশ করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রহার শুরু করে। পরবর্তীতে তাকে উপর্যুপরি অত্যাচার-ধর্ষণ করতে থাকে। তাদের পাশবিক অত্যাচারে সে জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলে। ১৮ জুলাই তার মা কেশবপুর গ্রামের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নজীর আহম্মেদের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে তিনি ২১ জুলাই পাক ও রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাকে উদ্ধার করে। এভাবে পাকবাহিনী ১৬ এপ্রিল থেকে শুরু করে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে অসংখ্য নারী পুরুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছে।
সরাইল থানাঃ ২০ এপ্রিল পাকবাহিনী সরাইল থানা দখলের পরপর স্থানীয় মুসলিম লীগ, পিডিবি, জামায়ের ইসলামীসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের উদ্যোগে ২৯ এপ্রিল মুসলিম লীগ নেতা মন্নাফ ঠাকুরকে আহবায়ক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে কমিটি ইউনিয়ন পর্যায়েও শান্তি কমিটি গঠন করে। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের সক্রিয় সহযোগিতা করে এবং নারী নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও মানুষ হত্যা করে।
৮ মে সরাইল থানার কালিকচ্ছ গ্রামে পাকবাহিনী হানা দিয়ে গিরীশ ডাক্তার ও গোপাল মাস্টারসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। সুহিলপুর গ্রামের গনি দালাল পাকবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করত। সে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর পাকবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করত। সে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর পাকবাহিনীকে চিনিয়ে দিত। হানাদাররা এ সকল বাড়ি ঘর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনকে ধরে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। গনি এলাকার মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সে প্রায় প্রতিদিন হিন্দুবাড়িতে হানা দিয়ে বাড়ি ঘর লুটপাট করত এবং হিন্দু লোকদের ধরে নিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করত। তার ভয়ে এলাকার লোকজন সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত থাকত।
২৫ মে শান্তি কমিটির সহযোগী সংগঠন হিসেবে শাহবাজপুর গ্রামের খোরশেদ আলীকে আহবায়ক করে ১৫ সদস্য-বিশিষ্ট রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এই দুই বাহিনী একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর মাধ্যমে সরাইল এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
পাক-সেনা ও তাদের তাঁবেদার বাহিনীর অত্যাচারে সরাইলবাসী অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁরা অনেক মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে আনন্দফুর্তি করত। তাদের হাত থেকে বৃদ্ধা ও গর্ভবতী মহিলারাও রেহাই পায় নি। এরা পিতা-মাতার সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে নির্যাতন করে। অনেক মহিলাকে প্রিয়জনের প্রাণ বাঁচাতে নরপশুর কাছে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে বাধ্য করে। তাদের শারীরিক ও পাশবিক অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে সরাইলবাসী এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামে, এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। মুক্তিবাহিনী, বুদ্ধিজীবী এবং স্বাধীনতার পক্ষ সমর্থনকারীদের নির্বিচারে হত্যা করে এরা সাধারণ মানুষের মালামাল লুট করে নেয়।
বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীকে ধরে এনে পাকবাহিনী সরাইল থানা ও কালীকচ্ছ ক্যাম্পে আটক রাখতো। কাউকে কাউকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লায় পাঠিয়ে দিতো। অনেককে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করতো। চুন্টা গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট করে। গ্রামের পরিমল দত্ত এবং মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের বাড়ি সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে ৩১ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে আটজন তিনদিন পর বাড়িতে ফেরত আসে, বাকিরা হত্যার শিকার হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নেওয়া ৪৭ জন গ্রামবাসীকে কলীকচ্ছের উত্তর দিকে ধর্মতীর্থ সড়কের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। পানিশ্বর বাজার এলাকায় পাকবাহিনী ২৫ জনকে হত্যা করা হয়। শাহবাজপুর এলাকায় তিতাস নদীর পাড়ে অগণিত মানুষ হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
২৫ অক্টোবর একদল পাকসেনা বুধল গ্রাম দিয়ে বেড়তলায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করার জন্য যাত্রা করে। এ দলেরই একজন পাকসেনা পথ ভুলে দলছুট হয়ে গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়ে হত্যার শিকার হয়। বুধল গ্রাম দিয়ে নেমে আসা সৈন্যের দল প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিটঘর, শিখনা, নাইলা এলাকার নিরপরাধ সাধারণ মানুষের উপর। ঘরে ঘরে ঢুকে ধরে আনে লোকজনকে। এলাকার সমস্ত লোকজন ঘরের বাইরে এনে একস্থানে জড়ো করে। তারা জানে না, তাদের কী অপরাধ। শুরু হয় তাদের প্রতি বেয়নেটের আঘাত আর বুটের লাথি। লোকজন বারবার বলতে থাকে তারা কিছু করে নি। শত কাকুতি-মিনতিতেও তারা ভ্রুক্ষেপ করল না। নিরপরাধ গ্রামবাসীদের লাইনে দাড় করিয়ে শুরু করে ব্রাশ ফায়ার-উপস্থিত সবাই একের পর এক মাটিতে ঢলে পড়ে। এ দিনের ঘটনায় ৭২ জন নিরপরাধ গ্রামবাসী বর্বর পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়। এরপর ২৭ অক্টোবর পাকবাহিনী কালীকচ্ছ বাজারের আশপাশ থেকে নিরপরাধ ১৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে বিলে নিয়ে হাত বেঁধে হত্যা করা হয়।
এভাবেই পাকবাহিনী সরাইল থানার বিভিন্ন এলাকায় নির্মম হত্যাকান্ড চালায়। ২ নভেম্বর শান্তি কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ-সহায়ক ব্যাক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকবাহিনীর কাছে জমা দেয়। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সেই তালিকা মোতাবেক শাহবাজপুর, চুন্টা, শাহদাপুর, অরুয়াইল, পাকশিমুল এই সব গ্রামে হানা দিয়ে ১০০ জন লোককে ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে। যাদের বাড়িতে পাওয়া যায় নি, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সরাইলের আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আকবর হোসেন (বকুল মিয়া) ও তার ছোট ভাই সৈয়দ আফজাল হোসেনকে (ছাত্র) ধরে নিয়ে কয়েকদিন কারাগারে রাখার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুড়ুলিয়ার খালে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এভাবে পাকবাহিনী সরাইল থানার বিভিন্ন গ্রামে অত্যাচার ও নির্যাতন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
আখাউড়া থানা (তৎকালীন কসবা থানা): আখাউড়া ছিল তৎকালীন কসবা থানার অন্তর্গত সীমান্তবর্তী এলাকা। পাকবাহিনী সর্বশেষ আখাউড়া দখল করে। আখাউড়া দখলের পর আখাউড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিবি) নেতা এম.এ. তাহেরকে আহবায়ক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এ শান্তি কমিটি আখাউড়ার আব্দুর রহমানকে রাজাকার কমান্ডার করে ৫৮ সদস্য বিশিষ্ট রাজাকার কমিটি গঠন করা হয়। পাকবাহিনী এই সহযোগি দুই বাহিনীর সাহায্য নিয়ে জনগণের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালায়।
আখাউড়ার পূর্বদিকের গ্রাম নারায়ণপুরের প্রায় সকল মানুষই মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কা করে। গ্রামটি ভারতের আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এদিক দিয়ে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। হঠাৎ করেই ৩/৪ মে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় নারায়ণপুর গ্রামে আক্রমণ করে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করে। লোকজন ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে। যারা পালাতে পারে নি, তাদের মধ্য থেকে সতের জনকে আটক করে। পাকবাহিনী তাদের কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানতে চায়। কিন্ত গ্রামবাসী কিছুই জানায় নি। ফলে গ্রামবাসীর ওপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। ধৃত সতের জনকে একসাথে বেঁধে নারায়ণপুর গ্রামের পাশে তারাগন খালের কাছে নিয়ে যায়। প্রাণে বাঁচার জন্য তারা পাকবাহিনীর কাছে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। তবু নিরীহ এ গ্রামবাসীদের খালের নিচে দাঁড় করিয়ে সকলকে এক সাথে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২২ আগস্ট বিকালে স্থানীয় শান্তিকমিটির সদস্য এবঙ রাজাকাররা পাকবাহিনীকে জানায় যে, আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাল গ্রাম দুটির প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই মুক্তিবাহিনীর লোক রয়েছে, গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে গেলেই মুক্তিবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানো সম্ভব হবে। ফলে পাকবাহিনী ঐ গ্রাম দুটিতে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৩০ জনকে ধরে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড় পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ও তার পাশে ছোট একটি মসজিদের ভেতর আটক রেখে নির্যাতন চালায়। পাকবাহিনী তাদের কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানতে চায়। কিন্ত গ্রামবাসী কিছুই জানে না বলে জানায়। যে মসজিদের ভেতর তাদের আটক রাখা হয়েছিল, সে মসজিদটি তখন খুবই ছোট ছিল। জায়গাটি এতো ছোট ছিল যে, এর ভেতর এতোগুলো মানুষের শ্বাস নেবার মতো অবস্থাও ছিল না। বারবার দব বন্ধ হয়ে আসছিলো। মানুষের উপরে মানুষ গাদাগাদি করে একদিন একরাত অনাহারে কাঁটায়। ২৩ আগস্ট রাতে তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে নিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ে সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড় করানো হয়। রাজাকাররা পাকবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিনিয়ে দেয়। সেখান থেকে গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চারজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৩ জন গ্রামবাসীকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। এলাকাবাসী ভয়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। নিহতদের সেখানেই গর্ত করে একসাথে মাটি চাপা দেয়া হয়।
কসবা থানাঃ কসবা থানার উত্তর-পূর্বদিকে আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি নিভৃত দুটি পল্লীগ্রাম চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ। আখাউড়া থেকে রেলে কুমিল্লা যাবার পথে ইমামবাড়ি স্টেশনের দক্ষিণ-পূর্বদিকে গ্রাম দু’টির অবস্থান। এখানেই একাত্তরে ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। গ্রাম দু’টির উত্তর পাশ দিয়ে সারপিলাকারে প্রবাহিত সিনাই নদী। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান দীর্ঘদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। দুর্যোগ মোকাবিলায় তারা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসেছে। কিন্ত একাত্তরের এ গ্রাম দু’টিতেও নেমে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম তাণ্ডব। এসময় এখানে নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।
সারাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে তখন ভৈরব ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক নারী-পুরুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে ত্রিপুরা যাওয়ার উদ্দেশ্যে চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ পর্যন্ত পৌঁছায়। রাত হয়ে যাওয়ায় এবং এলাকাটি শক্রমুক্ত থাকায় স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে তারা গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। পরদিন ২২ জুন সকালে ভারতে যাবার পথে রাজাকাররা তাদের উপর আক্রমণ করে। রাজাকারদের এলোপাথাড়ি আক্রমণে অনেকে আহত হয়। কেউ কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাদের মধ্যে থেকে অন্তত ২৫ জনকে বন্দি করে বন্দি করে রাজাকাররা কসবায় পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে টানা কয়েকদিন বন্দি নারীদের উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন এবং পড়ে তাদের হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
২৩ জুন পর্যন্ত কসবার পূর্বাঞ্চল চণ্ডীদ্বার ও হারিয়াবহ এলাকাটি দৃশ্যত মুক্তাঞ্চল ছিল। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দু-মুসলিম নারীপুরুষ স্থল ও জলপথে এসে আশ্রয় নিতো চন্ডীদ্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ভারতগামী শরণার্থীরা নৌকাযোগে সিনাই নদীর তীরে চণ্ডীদ্বার ও হারিয়াবহ গ্রামে আসতো। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরায় যেতো। এদিক দিয়ে তিনটি জলপথ ছিল। এগুলো হলো তিলকপীর-মনিয়ন্দ, তিলকপীর-নেমতাবাদ ও ব্রাহ্মণগাঁও-রাউথহাট। এসব জলপথে রাজাকাররা পাহারা দিত। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শরণার্থীরা ভারতের ত্রিপুরায় যাবার চেষ্টা করতো। অনেকে যেতে পারতো, আবার অনেকেই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়তো। শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু নর-নারী ও শিশু। প্রাণের ভয়ে তারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতো। রাজাকাররা তাদের টাকা পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যেত। যুবতী নারীদের আটক করে সরবরাহ করত পাকবাহিনীর নারী নির্যাতন ক্যাম্পে।
২৪ জুন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শরণার্থীরা আগরতলা যাওয়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়ে কসবার চণ্ডীদ্বার এলাকায় আসার পর আবহাওয়া খারাপ ছিল বিধায় তারা গ্রামের একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। শরণার্থীরা তখন খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং উদ্বিগ্ন। ছোট শিশুদের কান্না আর ক্ষুধার যন্ত্রনায় সকলেই অস্থির। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কেউ কেউ রওয়ানা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ রওয়ানা দিয়েছে। এরই মধ্যে কসবার তোফাজ্জল আলীর (টি.আলী) বাড়িতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর কাছে শরণার্থীদের অবস্থান সম্পর্কিত নিশ্চিত খবর পৌঁছে দেয় স্থানীয় রাজাকাররা। সকালের মধ্যেই পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এসে অতর্কিতে হামলা করলো শরণার্থীদের উপর। প্রথমেই তারা টাকা পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুট করে। তারপর শুরু হয়ে বেয়নেট চার্জ। নারীদের উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। প্রাণে বাঁচার জন্য সকলেই ছুটাছুটি করতে থাকে। চতুর্দিকে হাহাকার আর নারী-পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকার। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষও প্রাণের ভয়ে গ্রাম ত্যাগ করে। শিশু ও নারীদের উপর এ আক্রমণ ছিল ইতিহাসের এক বর্বরতম ঘটনা। প্রাণের ভয়ে সবাই পালাবার চেষ্টা করল। কিন্ত অনেকেই পালাতে পারেনি। গুলির শব্দে সারা এলাকা প্রকম্পিত। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এলাকাটি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়।
চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহে নারী নির্যাতন এবং গণহত্যার ঘটনা এখানেই শেষ নয়। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে নভেম্বর মাস প্রায় পাঁচ মাস ধরে এখানে জঘন্যতম নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। চণ্ডীদ্বার বাজারের উত্তর পাশে একটি হাঁট ছিল। এটির আশপাশে প্রায় প্রতিদিনই মানববধের যজ্ঞ চলতে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে এখানে তাদের হত্যা করা হতো। পাঁচ মাসে এখানে পাঁচ শতাধিক নর-নারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ গ্রামের মাটি খুঁড়লে এখনো বেরিয়ে আসে মানুষের কঙ্কাল। একটি পুকুর খননের সময় এখানে অসংখ্য নরমুণ্ডু ও কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ দুটি গ্রামেই যেন একটি বৃহৎ গণকবরে পরিণত হয়েছে। পুরো এলাকাটিই ছিল বৃহৎ একটা বধ্যভূমি। হরিয়াবহরে মুরশিদ মিয়ার বাড়ির চৌকির নিচে শিশু বাচ্চাসহ লুকিয়ে থাকা ভাটি অঞ্চলের এক মহিলাকে চুল ধরে টেনে বের করে ঘরের ভেতর রাজাকাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তার কোলের শিশু বাচ্চাকে মাটিতে আছড়ে মায়ের সামনে হত্যা করে। পর্যায়ক্রমিক ধর্ষণের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উক্ত মহিলাও ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
হরিয়াবহের শফিক মিয়া ও ইউনুছ খাঁর বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এসব ক্যাম্পে প্রতিদিনই নারী নির্যাতন হত। বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে আটক রাখা হত। রাজাকাররা পাকবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও বাংকারে নারী সরবরাহ করত। ইউনুছ খাঁর বাড়িতে গরু জবাই করে রাহাকাররা আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকত। তার বাড়ির পেছনে একটি কুঁড়েঘর ছিল। রাজাকাররা সেখানে নারীদের আটকে রেখে নির্যাতন করত। ইউনুছ খাঁর বাড়ির উত্তরে বিশাল গর্ত ছিল। রাজাকারদের হাতে নিহত অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ এ গর্তে ফেলা হত। শেয়াল কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয় এসব লাশ।
নরসিংদীর একটি হিন্দু পরিবারকে আগরতলায় যাবার পথে রাজাকার কমান্ডার ইকবাল খান নৌকা থেকে ধরে আনে। পরিবারের তিনজনকে হত্যা করে একজন মহিলাকে তারা চণ্ডীদ্বার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। চণ্ডীদ্বার মসজিদের পাশে একটি দোকানে নিয়ে তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। গোপীনাথপুরের ফজলুর রহমান তখন দোকানের পাশেই পাকবাহিনীর খনন করছিল। কয়েকজন পাকিস্তানী সৈনিক এবং এদেশীয় রাজাকার অট্টহাসিতে উল্লাস করছিল। বাংকার খননকারী ফজলুর রহমান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে। চানমোড়ায় দৃত এ মহিলাকে তিনদিন পর্যন্ত সেখানে আটক রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। তার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়েছিল। তিনদিন পর গোসলের জন্য তাকে পানিতে নামানো হয়। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানী সৈনিক ও রাজাকাররা ধর্ষণের আনন্দে উল্লাস করে। গোসল করানোর পর মহিলাকে পুনরায় প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে। তখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তিনদিনে মহিলাটি কয়েকবার অজ্ঞান হয়, কিন্ত সেসবার অজ্ঞান হবার পর তার জ্ঞান আর ফিরে নি। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার সাথে জড়িত রাজাকাররা ছিল আকসিনা, শাহপুর, বকাবাড়ি ও আড়াইবাড়ি গ্রামের। এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীরাও এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। চণ্ডীদ্বার ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে ভয়ানক চেহারার এক পাকিস্তানী দাতাল অফিসার ছিল। বন্দি মহিলাদেরে দিয়ে সে গায়ে তেল মালিশ করাতো। প্রকাশ্যে দিবালোকে নারীদের ধর্ষণ করে পুকুরে গোসল করত। পাকিস্তানী অফিসারের অনুরূপ রাজাকাররাও এমন আচরণ করত। পানপুরের ১৩ জন লোককে ধরে নিয়ে হরিয়াবহে সোনামিয়ার বাড়িতে আটক রাখা হয়। বাড়ির পূর্বপাশে পুকুরের উত্তর কোণে তাদের দিয়ে দু’টো গর্ত খনন করানো হয়। তারপর সেখানেই তাদের হত্যা করে একসাথে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
হারিয়াবহের জজু মিয়া পানপুরে ধরা পড়েন। নওগাঁর আবন মিয়া, মুকুল হোসেন ও আলী হোসেন পূর্ব থেকেই হরিয়াবহে সোনা মিয়ার বাড়িতে বন্দি ছিলেন। আবনের পরনে খাকি রঙের শার্ট ছিল। প্রচণ্ড ক্ষ্যাপা ও পাগলা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। তাই মুক্তিযোদ্ধা ভেবে পাকিস্তানীরা তার গাঁয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন। অন্য একজনে দু’টো গাছের সাথে বেঁধে নিচের দিকে ঝুলিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। আবুল হোসেন ও আলী হোসেন দুজন সহোদর ভাই তাদেরও হত্যা করে একসাথে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
বাঞ্ছারামপুর থানাঃ পাকবাহিনী বাঞ্চারামপুর আসার পূর্বেই বড় ভেলানগরের চেয়ারম্যান আজহারুল হক নসু মিয়াকে সভাপতি, আসাদনগরের মোঃ মীর সুলতান আহম্মদকে সাহদারন সম্পাদক করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই কিমিটি এবং পার্শ্ববর্তী হোমনা থানা থেকে আগত রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনের সহায়তায় পাকবাহিনী এ এলাকায় অত্যাচার ও নির্যাতনের তাণ্ডব চালায়। ১৭ জুলাই ১৯৭১ বাঞ্ছারামপুর থানার থানা-কম্পাউন্ড, থানা-সংলগ্ন তিতাস নদী, হাসপাতাল ও বালিকা বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় নারী-নির্যাতন ও গণহত্যা চলে। ঢাকার সুত্রাপুর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রায় দেড় শ’ নারী-পুরুষ দুটি লঞ্চযোগে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যাবার সময় বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন তাদের আটক করে, পার্শ্ববর্তী হোমনা থানায় পাকবাহিনীকে খবর দেয়। খবর পেয়ে একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন রাজাকারসহ প্রায় এক শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে বাঞ্ছারামপুর পৌঁছায়। এরপরই শুরু হয় আটককৃত দেড় শ’ নর-নারীর উপর অমানবিক নির্যাতন। এই দলে প্রায় ৩৫ জন যুবতীসহ শতাধীক নারী ও শিশু ছিল। পুরুষদের থানায় আটক করে রেখে হাসপাতাল ও বালিকা বিদ্যালয়ের ভেতরে চালায় নারী নির্যাতন। রাতভর নারীদের ওপর চালানো হয় পাশবিক অত্যাচার। ১৮ জুলাই বিকেল পর্যন্ত তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এরপর তাদের সকলকে লঞ্চযোগে হোমনা নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
উক্ত ঘটনার পর ১ আগস্ট মুক্তিবাহিনী এ এলাকাবাসী বাঞ্ছারামপুর থানা আক্রমণ করে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে থানা থেকে পাল্টা আক্রমণ চালায়। পুলিশের গুলিতে সেদিন বাঞ্ছারামপুরের হোসেন আলী নিহত এবং আব্দুর রাজ্জাক আহত হয়। এ ঘটনার পরদিন ২ আগস্ট বিকেলে পাকবাহিনীর একটি দল হোমনা থেকে বাঞ্ছারামপুরে এসে এলোপাথারি গুলি চলাতে থাকে। তাদের গুলিতে সেদিন বাঞ্ছারামপুরের সুরুজ মিয়া নহত হয়। গ্রামের অন্যান্যরা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। পাকবাহিনী বাঞ্ছারামপুরের মোল্লাবাড়ি, ফজলু মাস্টারের বাড়ি এবং আবদুর রহমানের বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেদিন থেকে পাকবাহিনী বাঞ্ছারামপুরে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। এলাকায় তাদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। অক্টোবরের শেষ দিকে পার্শ্ববর্তী হোমনা, নরসিংদী ও বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা কয়েক শ’ লোককে কৃষ্ণনগর কাছারির সামনে হত্যা করে তিতাস নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এছাড়াও ২৫ অক্টোবর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা উজানচর, কৃষ্ণনগর ও নালাদক্ষিণ গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে চারজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। যারা এখানে হত্যার শিকার হন তারা হলেনঃ উজানচর গ্রামের মোহর আলী (৪০), হাতেম খাঁ (৪০), হোরা গাজী (৫৫), ইদ্রিছ মিয়া (৩৬), আব্দুল হালিম (৪০), ইদ্রিছ আলী (৩০), আব্দুল মালেক (২৫) , বুধাই সরকার (৬০), সতীন্দ্র সাহা (৫৫), কৃষ্ণনগরের আলী মিয়া (৫০), মহব্বত আলী (৪৫), লিল মিয়া (৩৫), সুরিয়া বেগম (৩০), জয়মঙ্গল সরকার (৩৫), দেবেন্দ্র চন্দ্র সরকার (৭৫), নালাদক্ষিণ গ্রামের মুন্সী হযরত আলী (৩৭), নূরু মিয়া (৪০), ছাদত আলী (৪৩), গোলাম নজির (৩৫), নজরুল ইসলাম (৩২), আব্দুল খালেদ (৩০), আব্দুল হালিম (৩০), হাছন উদ্দিন (৩৫), ওয়াহেদ আলী (৪৫), বাদশা মিয়া (৩০), রাজা মিয়া (৬৫), মঙ্গল মিয়া (৫০), আহম্মদ আলী (৩০), রূপা মিয়া (৫৬), আবদুল মতিন (৪০), ইসমাইল মোল্লা (৫৫), আবিদ আলী (৪৫), আকরামউদ্দিন (৬৬), ও আলী মিয়া (৩৬), যেসব মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হয়েছেন তারা হলেন হাবিবউল্লাহ (বাঞ্ছারামপুর), শাহজাহান মিয়া (দেবিদ্বার), ফকরুল ইসলাম (দেবিদ্বার), মজিবুর রহমান (মুরাদনগর)।
বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাব হোসেনসহ (ফরিদপুর) কয়েকজন পুলিশ তখন পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। এলাকায় তারা নির্যাতন ও গণহত্যার তাণ্ডব চালায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনী দুর্গাপুরে ১২ জন, দশদেনায় ১৫ জন এবং রূপসী ও ভেলানগরের কয়েকজনসহ এলাকার বহু নারী-পুরুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে। নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে পরবর্তী সময়েও মৃত্যুবরণ করে।
মোঃ আবু মুসা
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত