You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | বোয়ালিয়া গ্রামে যুদ্ধ, খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

বোয়ালিয়া গ্রামে যুদ্ধ, খুলনা

বর্তমান পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিনের একটি গ্রাম বোয়ালিয়া। এর পশ্চিম সীমান্তে প্রবাহিত কপোতক্ষ নদ এবং নদীর ওপারে রাডুলি ইউনিয়ন। পাইকগাছা সদর ও তৎসংলগ্ন এলাকার সাথে এ ইউনিয়নের সংযোগ রক্ষা করত বোয়ালিয়া খেয়াঘাট। এ খেয়াঘাটটি এ এলাকার একমাত্র সংযোগ পয়েন্ট হওয়ায় খেয়াঘাট এলাকা ও তৎসংলগ্ন রাস্তাসমূহ যথারীতি ব্যস্ত থাকতো। তখন খুলনার সাথে পাইকগাছার সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পাইকগাছা-রাড়ুলী-সাতক্ষীরা হয়ে সড়ক পথে খুলনায় আসতে হতো। এ অবস্থায় রাড়ূলী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি ছিল। আর তাই বোয়ালিয়া খেয়াঘাটের বিপরীত পাড়ের বাঁকা গ্রাম প্রতিষ্টিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের যোদ্ধারা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাড়ূলী ইউনিয়নটি কপোতাক্ষ নদী বেষ্টিত হওয়ায় বাকারায় মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি দল এভাগ হয়ে যথারীতি টহল দিত এবং গোপনে শক্রপক্ষের অবস্থান ও নদীপথে তাদের চলাচলের খোঁজ-খবর রাখতো। ১৭ সেপ্টেম্বর বাঁকা ক্যাম্প কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ গোপন সূত্রে খবর পান যে, কপিলমুনি নামক স্থানে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকার রাড়ুলী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁকা ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য লঞ্চযোগে বোয়ালিয়া খেয়াঘাটের দিকে আসছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে বাঁকা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আবুল কালামের নেতৃত্বে বোয়ালিয়া খেয়াঘাটের বিপরীতে শালিকা ঘাটে এসে অবস্থান নেয়। এ দলের অন্যান্যর মধ্যে আইন উদ্দিন গাজী, মাস্টার আফছার আলী, কামরুল ইসলাম খোকন, মোকসেদ আলী, আবদুল হান্নান, সোহরাব, আকামত হোসেন, নুরুদ্দিন (নূর মোহাম্মদ), কালাম মোড়ল, আজিম, আব্দুল রশীদ খাঁ, মজিদ গোলদার, আবুবক্কর বাকু, গৌরিপদ, আশোক রায় প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক এরা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শালিখা খেয়াঘাটের নিকটবর্তী ওয়াপদা বেড়িবাধের আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বেলা ১০/১১ টার দিকে উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ কপিলমুনি দিক থেকে একটি লঞ্চ বোয়ালিয়া ঘাটের দিকে দ্রুতবেগে আসতে থাকে। নাগালের মধ্যে আসার সাথে সাথে লঞ্চটি শালিখা ঘাটে থামানোর জন্য কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ লঞ্চের সারেংকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্দেশ উপেক্ষা করে লঞ্চটি আরো অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে কমান্ডার তার আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ফায়ার করে। এর প্রতিউত্তরে লঞ্চ থেকেও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে রাজাকাররা। সাথে সাথে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা যার যার অবস্থান থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকে ফলে দ্রুত লঞ্চটি ঘুরিয়ে বোয়ালিয়া ঘাটের কিছু উত্তরে কেওরা গাছের জঙ্গলের আড়ালে থামিয়ে রাজাকাররা লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে এবং সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ কর এগুলি ছুঁড়তে থাকে। এভাবে অন্তত দুই ঘন্টার অধিক সময় গুলি বিনিময়ের পর রাজাকাররা হঠাৎ গুলি ছোড়া বন্ধ কর এদিয়ে পায়ে হেঁটে কপিলমুনিতে চলে যায়। নদীর পূর্ব তীর থেকে অর্থাৎ রাজাকারদের কাছ থেকে আর কোনো গুলি না আসায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ পজিশন থেকে বেরিয়ে এসে নৌকাযোগে লঞ্চের কাছে যায়। তারা জানায় যে, রাজাকাররা তাদের জোর করে এনেছে। তারা আরও জানায় যে ৪-৫ জন রাজাকার নিহত হয়েছে এবং তাদেরকে নিয়ে বাকিরা কপিলমুনির দিকে চলে গেছে। অতপর মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে বিজয়ের বেশে ক্যাম্পে ফিরে আসে। বাঁকার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় আক্রমণকারী রাজাকাররা রাড়ুলী বা বোয়ালিয়ায় প্রবেশ করতে না পারার কথা এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে বাঁকা ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই অঞ্চলের সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। স.ম. বাবর আলী এ যুদ্ধকে রোমাঞ্চকর যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত