You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | ‘বোয়ালিয়া-চৌডালা’ পাক ডিফেন্সে আক্রমণ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ - সংগ্রামের নোটবুক

‘বোয়ালিয়া-চৌডালা’ পাক ডিফেন্সে আক্রমণ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর, রবিবার রাত সাড়ে ৩টা-৪টার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সুসজ্জিত দল পাক হানাদার বাহিনীর চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের বোয়ালিয়া-চৌডালা-নন্দলালপুর –আরাগাড়াহাট ডিফেন্সের ওপর আকস্মিকভাবে ত্রিমুখী হামলা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শক্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এই অভিযান ছিল ৭নম্বর সেক্টরের উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা। এই হামলায় অনুষ্টিত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সফলতা অর্জন করে। তবে মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী যোদ্ধা ইপিআরের ল্যান্স নায়েক হাফিজুদ্দিন শাহাদাৎ বরণ করেন। মুক্তিবাহিনীর ঝাটিকা অভিযানে বোয়ালিয়া-চৌডালা-নন্দলালপুর-আড়গাড়াহাট পাক ডিফেন্স বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত পাকিফৌজ মুকিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে পিছু হটে এবং জীবন রক্ষার তাগিদে লঞ্চ, ষ্টীমার, নৌকা ও মটরের টিউব ভাসিয়ে মহানন্দা নদী পার হয়ে রহনপুরে পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় বেশ কিছু সংখ্যক পাকিফৌজ হতাহত হয় এবং আতঙ্কগ্রস্ত শক্রদের বেশ কিছু পলায়নপর ফৌজ নদী পার হবার সময় স্রোতের তোড়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। এরপর হানাদার বাহিনী সংগঠিত হয়ে এদেশীয় দালাল রাজাকারদের সহায়তায় আবার নদী পার হয়ে এসে পূর্ববর্তী স্থানে ডিফেন্স পাকাপোক্ত করে এবং বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অনুপ্রবেশ করে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। সেদিন পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষণ, হত্যা চালিয়েছিল তা শুধু মানবতার ইতিহাসেই বর্বরতার কালিমা লেপন করেনি, স্বাজাতির ধর্মীয় বন্ধনকে রীতিমত প্রহসনে পরিণত করেছে। হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ৩ নম্বর সাব-সেক্টর সদর দফতর মোহদীপুরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিশের সাথে এক গোপন বৈঠকে অভিযান পরিকল্পনার বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর এই বিশাল অভিযান ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ৩দিক থেকে একই সাথে সাঁড়াশি হামলা শুরু হবে এবং শক্র অবস্থানের ওপর ‘নেট ফায়ারিং’ চলবে। এইকে ভারতের গান্ধীনগর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়ার জন্যে ম্যাসেজ পাঠান হয়। অভিযান পরিচালনার বিষয়বস্তু ছিল, বিএসএফ গান্ধীনগর ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনীর রহনপুর এবি হাই স্কুল অস্থায়ী সেনাছাউনি ও মকরমপুর ঘাটে আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করবে। মুক্তিবাহিনীর আলীনগর ডিফেন্স ও কাশিয়াবাড়ী থেকে ও ৮১ মিঃ মিঃ মর্টারের শেল নিক্ষিপ্ত হবে; যেন পাকফৌজ ও রাজাকাররা মনে করে যে, মূল আক্রমণ হচ্ছে রহনপুর সেনাছাউনির ওপর। এই কৌশলে হানাদার বাহিনীকে দিশেহারা করে তাদের মনোবল ভেঙে দিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে উচ্ছেদ করাই ছিল এই হামলা পরিকল্পনার লক্ষ্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান বোয়ালিয়া শক্র প্রতিরক্ষা ব্যূহ হামলা করবেন। ৩ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মোহনদীপুর থেকে কলাবাড়ী হয়ে সাহাপুর গড় দিয়ে অনুপ্রবেশ করে পাক ডিফেন্সের মধ্যবর্তী অবস্থান গৌরীপুর, কাউয়াভাসা ও চৌডালা এবং ক্যাপ্টেন ইদ্রিশ একই পথে এসে আড়গাড়ার শক্র ডিফেন্সকে আঘাত হেনে নন্দলালপুর অভিমুখে অগ্রসর হবেন। এই রণ কোউশলের মাধ্যমে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মুক্তিবাহিনীর এই তিন গ্রুপ শক্রবাহিনীর ওপর নেট ফায়ারিং গড়ে তুলবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, দলদলী কম্পানি কমান্ডার লেঃ রফিকুল ইসলাম অসুস্থতাজনিত কারণে কম্পানি হেডকোয়ার্টারে দলদলীতে অবস্থান করছিলেন। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান মোহদীপুর সাব-সেক্টর মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সে আগমন করেন। এখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত করেন। গভীর রাতে সেক্টর কমান্ডার তার কাছে থাকা পিআরসি-৭৭ ওয়ারলেশ সেটে মোহদীপুর থেকে কলাবাড়ীতে রণ প্রস্তুত দুঃসাহসী বীর সেনানী ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিশের সাথে কথা বলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে অগ্রসর হয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স থেকে সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ৩৫ জন সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। এই দলে ছিলেন কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স কমান্ডার নজরুল ইসলাম। অন্যান্য ট্রুপস ও সেকশন কমান্ডাররা ছিলেন, ল্যান্স নায়েক মনির আহমেদ, হাবিলদার গিয়াস আহমেদ, ল্যান্স নায়েক হাফিজুদ্দিন, আনসার পিসি সৈয়দ আঃ রাজ্জাক, রাজা মিয়া, গোদাগাড়ীর আনসার অ্যাডজুট্যান্ট গোলাম মোস্তফা প্রভৃতি। সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তার অধীনস্থ সুসজ্জিত প্রায় ৬০ জন যোদ্ধা নিয়ে নৌকাযোগে সাহাপুর গড়ের পশ্চিমে নামলেন। এই পথ দিয়ে তিনি বোয়ালিয়া-চৌডালা পাকবাহিনীর ডিফেন্সের মধ্যবর্তী অবস্থান গৌরীপুর, কাউয়াভাসা ও চৌডালা হামলা করেন। ক্যাপ্টেন ইদ্রিশ প্রায় ৬০ জন সুসজ্জিত যোদ্ধা নিয়ে কলাবাড়ী হয়ে আড়গাড়াহাট শক্রবাহিনীর ডিফেন্সে মুক্তিবাহিনী ঝটিকা অভিযান চালিয়ে শক্রদের ছত্রভঙ্গ কর এপিছু হটিয়ে দিয়ে তাদের ধাওয়া করে নন্দলালপুরে অনুপ্রবেশ করেন। অপ্রস্তুত হতবিহবল শক্রবাহিনীকে প্রতিহত করে ক্যাপ্টেন ইদ্রিশের নেতৃত্বাধীন বাহিনী চৌডালা অগ্রসর হন। এই রণ কোউশলে মুক্তিবাহিনীর তিনটি গ্রুপ বোয়ালিয়া-চৌডালা শক্রবাহিনীর ডিফেন্সের ওপর নেট ফায়ারিং শুরু করেন। এদিকে ভারতের গান্ধীনগর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে রহনপুর, মকরপুর ও গোমস্তাপুর থানা কার্যালয় লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্তভাবে হেভি আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করা হয়। এছারা আলীনগর ও কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স থেকেও ৮১ মিঃ মিঃ মর্টারের শেল নিক্ষিপ্ত হয়। অপরদিকে রহনপুর থেকেও জবাবে হানাদার বাহিনী সাহাপুর গড়, কাশিয়াবাড়ী ও আলীনগর মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের ওপর আর্টিলারি ফায়ার দেয়। কিন্ত শক্রবাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলসমূহ মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ডিঙ্গিয়ে বিল এলাকায় পানিতে পতিত হয়। মুক্তিবাহিনীর সুগঠিত ও সুসজ্জিত যোদ্ধাদের আকস্মিক হামলায় শক্রবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বহু সংখ্যক শক্রসৈন্য হতাহত হয়। তারা মুক্তিবাহিনীর রণ কৌশলের ঝাটিকা অভিযানে ঘায়েল হয়ে পড়ে এবং শোচনীয় পরিস্থিতির কবলে পতিত হয়ে ছত্রভঙ্গ পাকফৌজ প্রাণ রক্ষার্থে লঞ্চ, ষ্টীমার, নৌকা ও মোটরের টিউব ভাসিয়ে নদী পার হয়ে রহনপুরে পলায়ন করে। আতঙ্কগ্রস্থ সৈনিকদের অনেকেই দ্রুত নদী পার হবার সময় স্রোতের তোড়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। হানাদার বাহিনীকে মহানন্দা নদীর পশ্চিম এলাকা বোয়ালিয়া-চৌডালা ডিফেন্স থেকে বিতাড়িত করে তাদের বোয়ালিয়া হাই স্কুল ক্যাম্পের নরকপুরী থেকে ১৪/১৫ জন নারীকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেন। ওই সব যুবতীরা ছিল বোয়ালিয়া, গোমস্তাপুর ও কাজীগ্রাম এলাকার। লম্পট পাকফৌজ তাদের প্রতিনিয়ত পালাক্রমে ধর্ষণ চালাত। এছাড়া মুক্তিবাহিনী হানাদারদের কিছু হাল্কা অস্ত্র জব্দ করে এবং খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য মান-সামান ধ্বংস করে। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ত্রিমুখী অভিযানে মুক্তিবাহিনী সফলতা অর্জন করেন। তবে ১ জন বীরযোদ্ধা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য শাহাদৎ বরণ করেন। তিনি ইপিআর বাহিনীর ল্যান্স নায়কে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুদ্দিন। বোয়ালিয়া হাই স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রচণ্ড লড়াইয়ের এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর চাইনিজ এসএমজি’র ব্রাশ তার গলা ও বুকে ভেদ করলে ল্যান্স নায়েক হাফিফউদ্দিন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজউদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এসে সেরাজ বিশ্বাসের বাড়ীর পূর্ব পাশে যথাযথ সামরিক মর্যাদায় দাফন করেন। মুক্তিবাহিনী সফল অভিযান শেষে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাশিয়াবাড়ি ডিফেন্সে ফিরে আসে। লক্ষ্য অর্জন শেষে মোহদীপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহুউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিশ আপন অধীনস্ত বাহিনী নিয়ে গন্তব্যে ফিরে যান। সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে রওয়ানা হন, এদিকে পরাজয়ের গ্রানি ও বিতাড়িত হবার জ্বালা সইতে না পেরে হানাদার বাহিনী ভয়ানকরুপে সজ্জিত হয়ে রাজাকারদের প্রত্যক্ষ মদদে সকাল প্রায় ১০টার দিকে আবার মহানন্দা নদী পার হয়ে অগ্রসর হয়। রাজাকাররা হানাদার বাহিনীকে সংবাদ দেয় যে, মোহদীপুর ও কলাবাড়ী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা স্ব-স্ব স্থানে ফিরে গেছে এবং কাশিয়াবাড়ীতে পূর্ব নির্ধারিত মুক্তিযোদ্ধারাই অবস্থান করছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে হানাদার বাহিনী আবার আক্রমণ করে। তারা তাদের পূর্ব স্থাপিত ডিফেন্স পুনঃদখল করে এবং বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ১১টি গ্রামে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও জ্বালাও-পোড়াও করে। যা ইতিহাসে জঘন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। হানাদার বাহিনীর নিষ্টুর-নরখাদক সেনা অফিসার মেজর ইউনুস এই নৃশংস অপকর্ম সংগটনে নেতৃত্ব দেয়। পাকি হানাদার বাহিনী এই দিন যে বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালায় তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। নিষ্টুর পাকিসেনারা কোলের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেয়নি। শিশুদের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দূরে নিক্ষেপ করেছে এবং বুটের আঘাতে ফুটবলের মতো এদিক-ওদিক পদাঘাত করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ৪/৫ বছরের বালক বালিকাদের হাত-পা ভেঙ্গে ও চোখ উপড়ে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করে। নরঘাতকরা মা-বাবার সামনেই আগে শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর নবালিকা-তরুনী-যুবতী নারীদের নিষ্টুরভাবে ধর্ষণ করে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে বেয়নেট চার্জ ও ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। বহু নারী নির্মম ধর্ষণের শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে মারা যায়। পাক বর্বর বাহিনী এই দিন অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল এবং গোটা এলাকা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খাড় করেছিল। তারা লাশ গুলো যত্রতত্র মাটিতে পুঁতে দেয় এবং বহু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বহু লাশ শিয়াল-কুকুর, কাক-শকুনের খোরাক হয়।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত