You dont have javascript enabled! Please enable it!

বোরহানউদ্দিনে সম্মুখ যুদ্ধ, ভোলা

পুকুরপাড় থেকে বিলের দিকে এবং উভয় পাশ ভালো করে দেখা যায়। মকছু ভাইয়ের পেছনে আমরা শোয়া অবস্থায়, সামনে চোখ ক্রমাগত সোজা, ডানে-বাঁয়ে ঘুরছে। তালুকদার বাড়ির শাহজাদা (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), জাহাঙ্গীর, হারুন, বারেক খসরু, গনি, রফিক। লোকমান, হাবিব এসব দলের সাথে অংশ নেয়।
এর মধ্যে এক এক করে খবর আসতে লাগল। খেয়াঘাট থেকে নেমে তারা বেশ কিছু এলোপাতাড়ি গুলি করে। পাকবাহিনী আসার পথে যত বাড়িঘর পড়েছে প্রায় সবকটিতে আগুন লাগিয়ে সামনে এগোচ্ছে। তাদের সঙ্গে আছে এলএমজি চাইনিজ রাইফেল এবং রাজাকারদের। পাকবাহিনী বোরহানউদ্দীন থেকে শান্তি কমিটির সেক্রেটারি মতি সিকদারকেও ধরে এনেছে। তাঁর মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে গুলির বাক্স।
পাকবাহিনীর অটোমেটিক রাইফেলের শব্দে গ্রামের নারী-পুরুষ, বুড়ো, শিশু যে যেদিকে পারছে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে বাগানে, ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবে চৌধুরী বাড়িতেও আগুন লাগিয়ে কয়েক পশলা গুলি ছোড়ে এবং সামনে এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে। সর্বশেষ গুরিন্দা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে এগোতে থাকে তালুকদার বাড়ির দিকে। বিলের দক্ষিণ পাশে এসে পড়েছে, এখনই বিলের মাঝ দিয়ে রওনা হবে। পাকবাহিনীর ফরমেসন ছিল এ রকম-প্রথমে রাজাকার, এরপর পাক মিলিশিয়া এবং শেষে পাক আর্মি। বেলা তখন ১১টার মতো হবে। আমরা সবাই দেখছি ওদের এগিয়ে আসা, হঠাৎ মনে হলো এক নিঃশব্দ পরিবেশ। পাখিদের ডাক পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। বিলের মাঝের পথে এসে দ্রুত নয়, হালকা গতিতে এক লাইনে এগিয়ে আসছে। শ্বাসরুদ্ধ করে বসে আছি, পেটের মধ্যে সবকিছু যেন শক্ত হয়ে গেছে। মকছু ভাই আস্তে আস্তে বলছে, আসুক, আরো আসুক। সবাইকে তোতা পাখির মতো পড়ানো হয়েছে কেউ যেন বিলের অর্ধেক না পেরিয়ে এলে গুলি না করে এবং প্রথম গুলিটি করবে মকছু ভাই। দক্ষিণ দিক থেকে গুলি হলেই পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে গুলি শুরু হবে।
সেদিনও দেউলার ল্যান্স নায়েক ছিদ্দিকুর রহমান পাকবাহিনীর পুরো দলটি তখনো অর্ধেকও আসেনি, পশ্চিম দিক থেকে ফায়ার করে বসে। আর চিৎকার করতে থাকে হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ বলে। বাধ্য হয়ে তখন সব দিক থেকে গুলি শুরু হয়। তবে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এরই মধ্যে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় পেয়ে যায়। তারা লাফিয়ে পড়ে ধানক্ষেতে। পাকবাহিনীর মেশিনগানার ছিল পেছনে, ওরা কিছু সময় পর ফায়ার শুরু করে। এখন চারদিক থেকেই গুলি চলচহে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান খুবই ভালো। গাছের আড়াল থেকে তারা গুলি করছে। মেশিনগানের কভারিং ফায়ারের আড়ালে পাকবাহিনী আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও অবস্থান বদল করে পূর্ব দিকে যারা ছিল তারা আরো উত্তর এবং পশ্চিমে যারা ছিল তারা আরো পশ্চিমে-উত্তরে ক্রমাগত ক্রলিং করে এগোতে থাকে এবং গুলি চলতে থাকে। এই অবস্থায় পুকুরপাড় থেকে মকছু ভাই, ছিদ্দিক (বাংলা বাজার), ওয়াহিদসহ আমরা দক্ষিণ পাশ থেকে উঠে পূর্ব দিকে চলে আসি।
পাকবাহিনী ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছিয়ে যাচ্ছে। মাথা তোলার অবকাশ নেই। যারা একেবারে পেছনে ছিল তারাই ক্রমাগত গুলি করছে, বিশেষ করে চারটি এলএমজি থেকে ক্রমাগত গুলি চলছেই, তবে কোনোটিই টার্গেট পাচ্ছে না। ওদেওর তখন একটাই চেষ্টা, কভারিং ফায়ার দিয়ে সহযোগীদের নিয়ে পেছনে পালিয়ে যাওয়া। ওই দিন কচিয়ার আব্দুল আজিজ, হযরত আলী, আবদুল মান্নান ও আবদুর রহমান বেলা ১১টার দিকে পোলগোড়ায় বসে চা খাচ্ছিল। হঠাৎ শুনল অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজ। শব্দ শুনেই বুঝল পাক আর্মি দেউলায় এসে গেছে। ওই সময় তাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তা সত্ত্বেও আমাদের সাহায্যে দ্রুত খাল পেরিয়ে দেউলার এপারে চলে আসে। তারা যখন এপারে পৌছাল তখন দেখতে পেল লোকজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছেলেমেয়ে নিয়ে পূর্ব দিকে পালাচ্ছে।
এদিকে প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে হাবিলদার সামসু, গিয়াসউদ্দিন, আচমত ও আলম চৌকিদার পূর্ব দিক থেকে ক্রমাগত পশ্চিম-উত্তরে এগিয়ে পাকবাহিনীর মেশিনগানারের ওপর গুলি করতে থাকে। আচমত (চেয়ারম্যান) ক্রলিং করে সামনে এগোতে গিয়ে পা কেটে রক্ত পড়া অবস্থায়ও সামনে এগিয়ে যায় এবং গুলি চালাতে থাকে। আক্রমণ অব্যাহত থাকে প্রায় দেড় ঘন্টার মতো। ল্যান্স নায়েক ছিদ্দিকুর রহমান, আমির হোসেন, জেবল, নাসির, ছাদের সবাই আরো পশ্চিম-উত্তরে এগিয়ে আসে এবং গুলি চালাতে থাকে। মকছু ভাই, ছিদ্দিক ও ওয়াহিদ একপর্যায়ে পাকবাহিনীর পেছনের দিকে চলে আসে এবং গুলি করে। পাকবাহিনী সম্পূর্ণ ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়।
এর মধ্যে হযরত আলী ও আজিজুল হক শেষের দিকে পূর্ব দিকে এসে ক্লান্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে দুটি রাইফেল ও গুলি নিয়ে অত্যান্ত সাহসিকতার সঙ্গে গাছের আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকে। পাকবাহিনী ক্রমান্বয়ে পিছু হটতে হটতে একপর্যায়ে বাগানের ভেতর ঢুকে যায়।
পাকবাহিনী নিহতদের লাশ পেছনে কোনোমতে আহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি এক সুবেদার গুলি করতে করতে পেছনে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখে তার চাইনিজ রাইফেলের গুলি শেষ হয়ে গেছে। উপায়ন্তর না দেখে সে ভুলে উত্তর দিকে না গিয়ে পূর্ব দিকে দৌড় দেয়। হযরত আলী পালিয়ে যাওয়া সুবেদারটির পিছু ধাওয়া করে এবং আরো পূর্বে এসে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলে। এদিকে পাকবাহিনী দৌড়ে এসে খেয়াঘাটে উপস্থিত হয়।
ইতিমধ্যে স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ স্বউদ্যোগে যেসব নৌকা করে পাকবাহিনী এপারে এসেছিল তাঁর মধ্যে দুটি নৌকা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে আসা পাকবাহিনী রাইফেলের মুখে আশপাশ থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে আনে এবং বেঁচে যাওয়া রাজাকারদের দিয়ে ডোবানো নৌকাগুলো উঠিয়ে বোরহানউদ্দিনের এ পাড়ে চলে আসে। সুস্থ রাজাকারদের বোরহানউদ্দিন থানায় রেখে আহতদের নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে সরাসরি ভোলা সদরে ওয়াপদা ক্যাম্পে চলে আসে।
এই যুদ্ধে আটজন রাজাকারসহ মোট ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরে খবরে জানা যায়, পালিয়ে যাওয়া আহতদের সংখ্যা ছিল ২২ জন।
দেউলার এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুধু ভোলা দ্বীপে নয়, দেশের অন্য কোথাও ১৬টি ৩০৩ রাইফেল দিয়ে চারটি লাইট মেশিনগান, চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেলসহ সুসজ্জিত, আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাত সেনাবাহিনীকে এভাবে পরাজিত করেছে-এ ধরনের ঘটনা আমার জানা নেই।
ওই সময়ের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেয়া যায়, পাকবাহিনী অথ্য সংগ্রহ করেই আক্রমণে এসেছিল; কিন্তু অল্প কয়টি রাইফেল নিয়ে ৮০ জনের একটি আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত দলকে আক্রমণ করবে এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। একদিকে তারা দেউলা প্রবেশের পড়ে তালুকদার বাড়ি পর্যন্ত কোথাও কোনো রেসিস্টেন্স না পাওয়ায় আক্রমণের আশঙ্কা তাদের মন থেকে সরে যায়। ফলে আক্রান্ত মুহূর্তে তারা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের প্রধান কারণ হলো তাদের অ্যাম্বুশের অবস্থান। অত্যান্ত উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশই মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে পাঁচগুন বেশি, ৮০ জনের আধুনিক অস্ত্র ও প্রচুর গুলি থাকা সত্ত্বেও পাকবাহিনী বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আরো একটি দিক হলো মুক্তিযোদ্ধারা অসম সাহসিকতায় স্থান বদল করে ক্রমাগত বিভিন্ন অবস্থান থেকে আক্রমণ করায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুমানে ব্যর্থ হয়ে মনোবল হারিয়ে পালিয়ে যায়। ভোলায় গিয়ে পাকবাহিনী যে রিপোর্ট করে তাতে তারা কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলে উল্লেখ করে।
এই যুদ্ধে পাঁচটি গুলিবিহীন চাইনিজ রাইফেল, আটটি ৩০৩ রাইফেল ও এক পেটি ৩০৩ রাইফেলের গুলি পাওয়া যায়।
সেদিন সন্ধ্যায় উত্তর-পূর্ব দিকে এক চাষীর বাড়িতে ঘরের মাচায় পাওয়া যায় এক পাক মিলিশিয়াকে। গোলাগুলির সময় সে প্রাণভয়ে অস্ত্র হারিয়ে পালিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওই বাড়ির লোকজনও তখন গোলাগুলির শব্দে পালিয়ে বাড়িছাড়া। খালি বাড়িতে সে ঢুকে এক ঘরের মাচায় উঠে বসে থাকে। ওই মিলিশিয়ার পায়ে গুলি লেগে আহত হয়েছিল। শেষ বিকেলের দিকে বাড়ির লোকজন ঘরে ফিরে আসে। এক সময় তারা মাচার ওপর নড়াচড়ার শব্দ পায়। ব্যাপার কি দেখার জন্য উপরে উঠে দেখে এক পাকসেনা। ভয়ার্ত চিৎকারে বাড়ির লোকজন লাঠি, ডদা, বল্লম নিয়ে একত্র হয়। তাদের চিৎকারে আশপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন ধরে উঠানে নিয়ে আসে। আহত হওয়ার কারণে আগেই অর্ধমৃত ছিল। গণপিটুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। এমনও শোনা যায়, ওই বাড়ির এক বুড়ি হাতের কাছে কিছু না পেয়ে খুন্তি দিয়েও দুই-চার ঘা দেয়। এ ঘটনা থেকে তৎকালীন সময়ের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল এটাই তার বহিঃপ্রকাশ। রাতের মধ্যেই পাকবাহিনী ও রাজাকারদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
দেউলা যুদ্ধের এই ঐতিহাসিক বিজয়ে সারা মহকুমা আলোড়িতে হয়ে ওঠে। মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অসংগঠিত মুক্তিকামী যোদ্ধারা ক্রমান্বয়ে দেউলা ক্যাম্পে উপস্থিত হতে থাকে। ক্যাম্পে তখন ৬০-৭০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। দেউলার স্থানীয় যোদ্ধারা নিজ নিজ বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলে অন্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে পড়তে হয়। পড়ে এমসিএ মোতাহার মাস্টার, মোখলেছুর রহমান চেয়ারম্যান, এমসিও রেজাই করিম, সৈয়দ ডাক্তার, ভোলার আবদুর জব্বার হাওলাদার, মানিক মিয়া, হোসেন চৌধুরী, বশির মিয়া চেয়ারম্যান, মাহবুব হাওলাদার, বুলু ভূঁইয়া, ছাদেক ভূঁইয়াসহ অনেকেই কমবেশি টাকা, পয়সা, চাল, ডাক পাঠাতে শুরু করে।
দেউলার পরাজিত পাকবাহিনী ওই দিকে ভোলা ওয়াপদা ক্যাম্প আরো দুর্ভেদ্য করে তোলে। নতুন করে কংক্রিটের বাঙ্কার আর ছাদের ওপর ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ভোলাতে কয়েক দিন পরেই এক প্লাটুন পাকসেনা উপস্থিত হয়।
দেউলার এই যুদ্ধের পর ক্রমাগত মুক্তিকামী যোদ্ধারা দেউলা আসার পর লোকবলের তুলনায় অস্ত্রের পরিমাণ দাঁড়ায় তিনজনের একটি রাইফেল। পাকবাহিনী পুনরায় ব্যাপকভাবে আক্রমণ করতে পারে আশঙ্কায় আমরা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠি। তখন হোসেন চৌধুরী, মকছু ভাইকে মোতাহার মাস্টার ও মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে আমরা পূর্ব আলোচনার কথা জানালাম। দেউলার যুদ্ধের পরদিন হেলালউদ্দিন ফারুককে মোতাহার মাস্টার এমসিএর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একদিন অপেক্ষার পর মোখলেস মিয়ার সঙ্গে হেলালউদ্দিন ফারুকের দেখা হয়। সেদিনও তিনি একই কথা বলেন-যেদিন লালমোহন থানা আক্রমণে যাব তার একদিন আগে যেন তাকে খবর পাঠাই। এই খবর নিয়ে ফারুক মিয়া দেউলা চলে যায়। আমরা আঁচ করি, এমসিএ মোতাহার মাস্টার ও মোখলেছুর রহমান চেয়ারম্যানের কিছু খাস লোক যারা রাজাকার হিসেবে লালমোহন থানায় যোগ দিয়েছে, থানা আক্রমণের সময় নিষ্ক্রিয় থাকবে।
আমরা ছিদ্দিকুর রহমান ও হাবিলদার নাসিরকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বললাম। যদিও কোথায় আক্রমণ করা হবে সে সময় জানানো হয়নি। বর্তমানে আমাদের হাতে আছে ২৫টি ৩০৩ রাইফেল এবং ৯০০টি গুলি। সেদিনের যুদ্ধে ৪৫০ রাউন্ড গুলি ব্যবহার হয়। চাইনিজ রাইফেলের গুলি না থাকায় সেগুলো অকেজো হয়ে থাকে।
২১ সেপ্টেম্বর। বিভিন্নভাবে খোঁজখবর নিয়ে অবশেষে জানা গেল, এমসিও রেজাই করিম চুন্নু মিয়া তার শ্বশুরবাড়িতে আছেন। আমরা সেদিন বিকেলেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাই বলে লোক পাঠিয়ে খবর জানালাম। দেউলার এপারে এসে হোসেন চৌধুরীর মোটরসাইকেলে আমি আর তোফাজ্জল মিয়া রাত দশটায় চুন্নু মিয়ার শ্বশুরবাড়িতেই (মজু চেয়ারম্যানের বাড়ি) এমসিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। এমসিও মোতাহার মাস্টার, মোখলেছুর রহমানের কথা জানালাম এবং শিগগিরই লালমোহন থানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্তের কথা বললাম। তাকে অনুরোধ করা হলো, তিনি এমসিএ হিসেবে দেউলা ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করে এলে সবার মধ্যেই একটা অনুপ্রেরণা আসবে। টাকা-পয়সার অনটনের কথাও তাকে জানানো হলো। কথাবার্তা শেষে তিনি জানালেন, এই মুহূর্তে তার নিরাপত্তার খুবই অভাব, তাই এখন তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবে বোরহানউদ্দিনের সৈয়দ ডাক্তারের কাছে সংগ্রাম পরিষদের টাকা জমা আছে, সেখান থেকে ক্যাম্পে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। তিনি আমাদের বললেন, আপনারা লালমোহন থানা আক্রমণে যান, আপনাদের প্রতি আমার দোয়া রইল।
কথাবার্তা শেষে আমরা সেখান থেকে ওই রাতে হোসেন চৌধুরীর বাড়ি চলে যাই। পরদিন দেউলা পৌঁছে হাবিলদার আবদুল আজিজ, হাবিলদার হযরত আলীদের পরবর্তী এক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে খবর পাঠাই। খবর পাঠানো হয় লিয়াকত-মিজান গ্রুপে কাছে। অন্যদিকে ভোলাতেও ছিদ্দিকুর রহমান ভ্রাতাদ্বয়ের কাছে খবর পাঠানো হয়। আমরা ২৪ সেপ্টেম্বর লালমোহন থানা আক্রমণ করব যেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করি। ভোলার পাকবাহিনীর শেষ খবরাখবর যতদূর পারা যায় জানার জন্য নজিবকে সেখানে পাঠানো হয়। ২২ সেপ্টেম্বর হেলালউদ্দিন ফারুককে পাঠিয়ে দেয়া হয় এমসিএ মোতাহার মাস্টারকে জানানোর জন্য যে, আমরা ২৪ সেপ্টেম্বর লালমোহন থানা আক্রমণে আসছি। অন্যদিকে তফাজ্জল মিয়াকে পাঠানো হয় লিয়াকতদের ক্যাম্পে।
২৪ সেপ্টেম্বর। মকছু ভাই, হোসেন চৌধুরী, আমি, ছিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার শামসুদ্দিন, হাবিলদার নাসির, গিয়াসউদ্দিন, আচমত, মুচু ছিদ্দিক, মিন্টু মিয়া, ছাদেক, সানু, আলম চৌকিদার, কাঞ্চন, আমির হোসেন, গিয়াস, জেবল, নাসির ছিদ্দিক (বাংলা বাজার), ওয়াহিদ, জাহাঙ্গীর, হারুন, রতন, শহজাদা, গনি, রফিক, লোকমান, কাজল, হাবিব, মোজাম্মেলসহ প্রায় ৪৫ জনের একটি গ্রুপ লালল্মোহনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই।
এই রাতেই চরফ্যাশন থেকে লিয়াকত, মিজান, খোকন, হিরণ, হাসান, তোফাজ্জল মিয়া, অনুজ, ছায়াকান্ত, জাকির, বিশ্বম্ভর, কাদের, রুহুল আমিন গোলদার, মিন্টু, আইচারাম দাস, ফরিদ, আবদুল জলিল, নজির আহমদ, হিরণ, মাসুদ হেলালী, ইব্রাহীম, নীলধর, জেবল মস্টার, কালাচাঁদ, সুধাংশু, নরধন, হরিহর, করুনা, করিমসহ সবাই এসে উপস্থিত হয়। ভোর থেকে থানার চারদিকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে অবস্থান গ্রহণ করা হয়।

[৬৩] মাহফুজুর রহমান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!