You dont have javascript enabled! Please enable it!

বেলুনিয়া ও শালদা নদীর যুদ্ধ, ফেনী

ফনীর মুক্কতিযুদ্ধের ইতিহাসে দুটো ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ-(১) বেলুনিয়া এবং (২) শালদা নদীর যুদ্ধ। বেলুনিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারটি মুক্তি বাহিনী ও পাকবাহিনী উভয়ের জন্য রণকৌশলগত কারণে জরুরী ছিল। বেলুনিয়া ফেনী থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত। পাকবাহিনী মে মাস থেকে এই স্থানটি দখলের চেষ্টা চালায়। মুক্কতিসেনারা একদিকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে বন্দুয়াতে (ফেনী থেকে দুই মাইল দূরে ) এবং ল্যাফটেন্যান্ট ইমামুজাম্মানের নেতৃত্বে অপরদিকে প্রতিরোধ বুহ গড়ে তোলে। মুন্সিরহাটে (বন্দুয়া থেকে চার মাইল দূরে ) মুক্তি বাহিনীর মজবুত একটি ঘাঁটি ছিল। মুন্সিরহাটে মুহুরি নদীর পশ্চিম পাড় থেকে শুরু করে পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা পর্যন্ত এই প্রতিরক্ষা বুহ ছিল ৪ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বেলুনিয়া থেকে মুন্সিরহাট এই ১২ মাইল ছিল পুরুপুরি মুক্ত এলাকা। পাকবাহিনী সর্ব প্রথম বেলুনিয়া প্রবেশ করে ৭ জুন। ১০ জুন থেকে তারা ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। তারা ধ্বংস প্রাপ্ত বান্দুয়া সেতুর ওপর বাঁশের সেতু তৈরি করে পার হওয়ার চেষ্টা করছিল , মুক্তিবাহিনী সেই মুহুর্তে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে সেতুর ওপরের ৫০ জন পাওসেনা গুলির আঘাতে পানিতে পড়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনী তাঁদের গোলন্দাজদের সহায়তায় আবার আক্রমণ চালায়। এবারও পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে মুক্তি বাহিনী। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকবাহিনীর আক্রমণ ব্যাপক হওয়ার কারণে মুক্তি বাহিনী মুন্সিরহাটে সম্বেত হয়। এবার পাকবাহিনী সাফল্য লাভ করে এবং সাম্নের দিকে বেলুনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তাঁরা মুক্তি বাহিনীর মূল ঘাঁটির উপর বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করে চলে। এই অবস্থায় কিছু সংখ্যক পাকসেনা নদীর পাড় ধরে মুক্তি বাহিনীর কাছাকাছি চলে আসে। আর কিছু সংখ্যক নদী পাড় হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। তিন জায়গায় মুক্তি বাহিনীর মর্টার ও মেশিঙ্গানের আঘাতে প্রচুর পাকসেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে মুক্তি বাহিনীর পাতা মাইনফিল্ডের মুখে এসে পড়ে পাকবাহিনী। তাঁদের পায়ে চাপে একটা পর একটা মাইন ফাটতে থাকে। পাকসেনাদের দেহগুলো মাইনের আঘাতে আঘাতে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় পাক বাহিনীর একটি দল মুক্তি বাহিনীর বাঙ্কারে কাছে চলে আসলে মুক্কতিবাহিনীর গ্রেনেডে আঘাতে পাকবাহিনী সমুলে ধ্বংস হয়। এমনি এক বিপর্যয়কর এক অবস্থার মধ্য পাকবাহিনী পশ্চাপদকরণ করে পালাতে থাকে। মুক্তি বাহিনী পলায়নরত শ্ত্রুদের উপর ব্যাপক মর্টার ও মেশিনগানের আঘাত হেনে শত্রুসেনাদের অধিকাংশকেই হত্যা করতে সক্ষম হয়। অবশিষ্টরা আর্টিলারি গোলার কভারে আনন্দপুর পাঁকঘাটিতে পালিয়ে যায়। এই সংঘর্ষ পর পাকসেনাদের ৩শ’ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাকবাহিনী বেলুনিয়ায় নিজেদের এই চরম বিপর্যয়ের ফলে বড় রকমের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ এ ধরনের আশঙ্কা থেকে মুক্তিবাহনীকেও প্রস্তুত করতে থাকেন। এ পর্যায়ে মন্দভাগ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপেটন চতুথ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাহায্যের জন্য বেলুনিয়ায় সমবেত হন। ১৭ জুলাই রাত ৮ টায় পাকবাহিনী মুক্তিবাহনীর উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানীরা তিনটা হেলিকপ্টারযোগে মুক্তিবাহনীকে ঘেরাও করে ফেলে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম,ল্যাপটেন্যান্ট ইমামুজাম্মান এবং ক্যাপ্টেন গাফফার দল পাকবাহিনী মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পাকিস্তানীদের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে মুক্তিবাহিনী পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়। ১৮ জুলাই পাকবাহিনীর হাতে বেলুনিয়ার পতন ঘটে। বিখ্যাত বেলুনিয়ার যুদ্ধ পুনরায় সংঘ টিত হয় নবেম্বর মাসে। ১৮ জুলাই পাকবাহিনীর হাতে বেলুনিয়ার পতনের পর থেকে তা ছিল তাঁদের দখলে। পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুল্গাজি, মুন্সিরহাঁট, বেলুনিয়া ফেনির অশংবিশেষ ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। ইতিমধোয় ২/৩ নবেম্বর লাতুমুরায় মেজর আইনউদ্দিন তাঁর নবম ইস্ট বেঞ্জল রেজিমেন্ট নিয়ে পাকসেনাদের উপর তীব্র আক্রমণ করে বসেন। পাকবাহিনী আপ্রান চেষ্টা করেও লাতুমুরায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। তবে এই সংঘর্ষ মুক্তিবাহনীর প্রচুর ক্ষতি হয়। এখানে ৩ জন অফিসার ৪০ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬০ আহত হন। সেক্টর খালেদ মোশারফ , ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম কে তাই বেলুনিয়া থেকে ফেনী স্টেশন পর্যন্ত সব শত্রুঘাঁটি ধবংস করার দায়িত্ব দেন। এ অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন দ্বিতীয় বেঞ্জল একটি কোম্পানিকে, যার নেতৃত্ব ছিলেন ক্যাপ্টেন মোরশেদ। মিলিত বাহিনী ৮ নবেম্বর বেলুনিয়া আর পরশু রামের পাহবাহিনী উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী ছাড়াও এই অভিযানে মিত্রবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। জাফর ইমামের নেতৃত্বে এই বাহিনী বেলুনিয়া থেকে ফেনী রেল্লাইনের রাস্তায় বেশকিছু বাঙ্কার গড়ে তুলে। পাকবাহিনীর সঙ্গে এই পতে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী বিমান থেকে গুলিবর্ষনের মাধ্যমে আক্রমন রচনা করে। মুক্তিবাহনী এইখানে এম,এম,জির সাহায্য একটি বিমান ধ্বংস করে। বাকি দুটো বিমান পালিয়ে যায়। তবে পাকবাহিনীর মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। শত্রু সেনাবাহিনীর শতকরা ৮০ জনেই এই যুদ্ধে মুক্তিবাহনীর হাতে নিহত হয়। ৯ নবেম্বর তারিখেই মুক্কতিবাহিনীর দখলে পরশুরাম ও বেলুনিয়া চলে আসে। শত্রু সৈন্যদের বাঙ্কারে ৪৯ জন পাকসেনাকে পাওয়া যায়। এ বিপর্যয়ের ফলে শত্রু পক্ষ ভেঙে পড়ে। চিতলিয়া ঘাঁটের পাক সেনারা পালিয়ে মুন্সির হাঁটে চলে যায়। তখনও শত্রু পক্ষের দখলে বহু এলাকা ছিল। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্ব মুক্তি বাহিনি পিছু হটে চিতলিয়া থেকে ফুলগাজি পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে মিলিত হয়। ফুলগাজি ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীর চাপ বৃ্দ্ধি পাওয়ায় পাকবাহিনী বন্ধুয়া রেলস্টেশন কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে। দক্ষিণে চেনাগাজিতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছিল। এভাবে তিন দিক দিয়ে পাকবাহিনী চাপের সম্মুখীন হয়। তবে চেনাগাজিতে গেরিলারা ছিল ফাঁদ পেতে। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাধ্য হয়ে পাকবাহিনী যখন এ পথ দিয়ে পালাবে তখন আকস্মিক আক্রমণ করে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করা। বাস্তবে পাকবাহিনী এই পথে না গিয়ে নোয়াখালির বেগমগঞ্জ হয়ে লাকসামে পালিয়ে যায়। ফলে ফেনীর একটা বড় অংশ , বিশেষ করে বেলুনিয়া মুক্ত হয়। বেলুনিয়ার এই বিখ্যাত যুদ্ধের বিবরণ , এর রণকৌশলগত দিক এবং বিজয় নেপথ্য মুক্তি বাহিনীর আত্নদানের ইতিহাস ইত্যাদি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে স্টাফ কলেজে পড়ানো হয়। ১৯৭৩ সালে এই রনাঞ্জনে পরিদর্শনে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন রাস্ট্রের ২১ জন ব্রিগেডিয়ার ও মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার। ফেনীর অপর গুরুত্বপূর্ণ ছিল শালদা নদীর উপর যুদ্ধ। শালদা নদী ও শালদা রেলস্টেশন ছিল পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর জন্য রণকৌশলগত ভাবে গুরুত্বপর্ণ এলাকা। পাকবাহিনী এই পথে রসদ ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করত। তাই এই স্থান্টির দখল নিয়ে মুক্তি যুদ্ধকালে উভয়পক্ষের মধ্য বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। ১৮ই জুন বেলা আড়াইটায় শালদা রেলস্টেশনের কাছে উভয়পক্ষের মধ্য যুদ্ধ হয়। সুবেদার ওয়াহাব এই অভিযানে কৃতিত্ব দেখান। এখানে মুক্তিবাহিনীর গোলার হামলায় পাকবাহিনীর অস্ত্রভর্তি ট্রলিতে আগুন ধরে যায়। একান থেকে মুক্কতিবাহিনী বেশকিছু গোলাবারুদ স্নগ্রহ ও খাদ্যসম্ভারও নিজেদের হস্তগত করে। ১৮ জুলাই শালদা নদীতে আসার সময় শত্রু বাহিনীর একটি স্পীডবোটের ওপর আক্রমণ রচনা করে সুবেদার ওয়াহাবের দলটি ৮ জন পাক অফিসার ও ৪ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। স্পীডবোটটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ৩২ রেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির উপর শালদ নদীপথে মন্দভাগে সুবেদার নেতৃ্ত্বাধীন দলটি আক্রমণ চালায়। এতে ৬০ জন পাকসেনা নিহত হয়। নিহত হয় ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কাইয়ুম এবং ৫৩ গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার এবং বহু হত্যা কান্ডের নায়ক কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারী। শত্রু সেনারা শালদা নদীতে তাঁদের এই বিরাট বিপর্যয়ের পর নিজেদের বাহিনীকে হটিয়ে কুটিতে নিয়ে যায়। ফলে মন্দভাগ ও শালদা নদীতে মুক্তি বাহিনীর অবস্থান আরো শক্তশালী হয়। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ খুটিতে পাকবাহিনী ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁর সাবসেক্টর মন্দভাগের অবস্থান আরও এগিয়ে বাজারে নিয়ে গিয়ে তাকে আরও জোরদার করে। শত্রু সেনারা বেল্লচ রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি সামনে রেখে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেম গাফফার দলটি অর্তকিত আক্রমণ চালালে শত্রু সেনাদের দুটো কোম্পানি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু ঘন্টাখানেক পর পাকসেনারা শালদা নদীর দক্ষিণ তীরের মুক্তি বাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। সুবেদার ওয়াহাব এই পথে এমবুশ পজিশনে ছিলেন। ফলে তাঁদের হাতে অগ্রসরমান পাকবাহিনীর দলটি বিপর্যয় ঘটে। তারপরেও ক্যাপ্টেন গাফফার ও সুবেদার ওয়াহাবের দলটি মার খেয়ে পশ্চাদপসরণরত পাকসেনাদের পেছনে ধাওয়া করেন। সামনে ছিল ধানক্ষেত , খানা ডোবা ভরা পানি। শত্রু সেনাদের অনেকে সেই পানিতে ডুবে এবং গুলির আঘাতে নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে এখানে [আক বাহিনীর ১২ জনের লাশ পাওয়া যায়। এই যুদ্ধের ফলে ৮ টি মেশিনগান, ১৮ টি হালকা মেশিনগান, দেড়শ রাইফেল, একটি রকেট লঞ্চার, ২টি মর্টার ও অজস্র গোলাবারুদ মুক্তি বাহিনীর করতলগত হয়। নিহত পাক সেনাদের মধ্য ছিল একজন ক্যাপ্টেন, একজন ল্যাফট্যান্ট ও কয়েকজন জুনিয়র কমিশন অফিসার। পাকবাহিনীর এই বিপর্যয়ের পর তাঁর নদী পথে লঞ্চ , স্টিমার ও স্পিডবোর্টের সাহায্য নিতে শুরু করে। তারা শালদা নদী ও মন্দভাগে ক্যাপ্টেন গাফফার ও মেজর সালেকের বাহিনীকে বারবার আঘাত করতে থাকে। পাকবাহিনী ২৬ জুলাই শালদা নদীর অবস্থান থেকে মথরো সেতুর কাছে এসে সমবেত হয়। তারা সেতুর চারদিকে বাঙ্কার তৈরি প্রস্তুতি নেয়। ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর দলটি আগরতলার কাছে এসে অবস্থান নেয় এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার নিক্ষপ করে। পাকবাহিনী যুদ্ধে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। শালদা নদীতে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধ সারা জুলাই মাস ধরে চলে। ক্যাপ্টেন গাফফার নেতৃত্বে শালদা শত্রু অবস্থানের উত্তর দিকে চতুর্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। দক্ষিনদিকে আগরতলা ও কাঠমোড়ায় মেজর চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানি দিয়ে পাকসেনাদের শালদা নদীর অবস্থানের চাপ সৃষ্টি করেন। পাকসেনাদের পেছন থেকে সরবরাহের রাস্তা একমাত্র নদী ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। নদীপথেই গোপনে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানে রসদপত্র সরবরাহ করা হত। এই সরবরাহ পথে পাক সেনাদের এ্যামবুশ করারা জন্য মেজর সালেক একটি প্লাটুন গোপনপথে শত্রুসেনাদের অবস্থানের পেছনে পাঠিয়ে দেন। এ প্লাটুন্টি ১ অগাস্ট রাতে শালদা নদী পশ্চিমে নদীর উপর এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১ টায় ১৫০ জন সৈন্য ও অন্যান্য সরবরাহসহ পাকসেনারা তাঁদের শালদা নদীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের সৈন্য ও রসদসহ নৌকাগুলো এ্যামবুশ অবস্থানের ভেতরে আসে, তখন সালেকের প্লাটুনটি মেশিঙ্গান ও হাল্কা মেশিনগানের সাহায্য গুলি চালাতে থাকে। আধ ঘন্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে পাসসেনাদের ৬০/৭০ জন হতাহত হয় এবং ৪/৫ টি নৌকা ডুবে যায়। মুক্তিবাহিনীর ৪ জন শহীদ হয় এই যুদ্ধে। এরপর ক্যাপ্টেন সালেক ১০ অগাস্ট একটি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে কুমিল্লস সি এন্ড বি রোডের কাছে শিদলাই গ্রামের কাছে ঘাঁটি স্থাপন করেন। মুক্তিবাহিনীর অন্য দলগুলো এরই মধ্য শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে ফেলে। শালদা নদী, মন্দভাগ এবং চারদিকে মুক্তিবাহিনী প্রায়ই আক্রমণ রচনা করতো। ফ্লে পাকবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছিল। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনীর অন্তত ৬০ শালদা নদীর যুদ্ধে নিহত হয়। বাধ্য হয়ে শ্ত্রুরা শালদা ছেড়ে নয়ানপুর গ্রাম ও শালদা নদীর গোডাউনে তাঁদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। মন্দ ভাগেও শত্রু অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনীর গোলার আক্রমণে পাকসেনাদের প্রায় ১৫০ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা অবস্থান ত্যাগ করে ব্রাক্ষণ পাড়ায় আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনী ১১ আগস্ট সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন সালেকের বাহিনী নাগাইশ গ্রামে ১৫ আগস্ট তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। এ যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের তিনটি নৌকা সেদিনই শালদা নদী থেকে ব্রাক্ষণপাড়ায় যাওয়ার সময় শালদা গ্রামের কাছে আক্রান্ত হয় এবং ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৬ আগস্ট পাকসেনাদের শক্তিশালী দুটি প্লাটুন নাগাইশের দিকে অগ্রসর হয়। সুবেদার নজরুল ও সুবেদার মুনিরের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী নাগাইশ পৌঁছার আগেই তাঁদের উপর আকস্কিক আক্রমণ চালালে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৯ আগস্ট দুপুরে পাকসেনারা তিনটি নৌকাসহ শালদা নদী থেকে ব্রাক্ষণপাড়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় নাগাইশের কাছে মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে পাকবাহিনীর দুটো নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা তীরে নেমে মুক্তি বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে। প্রায় চার ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছুহটে যায়। ঐদিনই মুক্তি বাহিনীর কামানের আঘাতে শালদা নদীর নিকটবর্তী গুদামে অবস্থিত পাক সেনাদের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে তাঁদের ৮ জন সৈন্য ঘটনাস্থলে নিহত হয়। ২৩ আগস্ট শালদা নদী এলাকায় আবার যুদ্ধ হয়। সেনেরবাজারে উভয়পক্ষের মধ্য এই যুদ্ধে পাকসেনাদের ৭ জন নিহত হয়। ২৬ আগস্ট ব্রাক্ষণপাড়ার কাছে পাকসেনাদের ৬ নৌকার উপর মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে বেশ কয়েক জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকটি নৌকা নিয়ে পাকবাহিনী পালিয়ে নাগাইশে গেলে সুবেদার নজরুলের নেতৃত্বে মুক্কতিবাহিনী তাঁদের উপর আক্রমণ রচনা করে। এতে ১৮ জন পাকসেনা ডুবে মারা যায়। এই যুদ্ধে ছাত্র গেরিলা আব্দুর মতিন শহীদ হন। ২৭ আগস্ট পাকসেনারা শশীদল গ্রামের কাছে সৈন্য সমাবেশ করে সেনের বাজারে দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটি মর্টারে গোলার সাহায্য সেনের বাজারে উপর আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিনব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শত্রু বাহিনীর গুলি বিনিময় চলে। শেষে পাকবাহিনী সন্ধ্যার দিকে পিছু হটতে থাকে। এই যুদ্ধে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৮ আগস্ট পাকবাহিনী ব্রাক্ষণপাড়া থেকে পাঁচটি নৌকায় চেপে শালদা নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তি বাহিনীর বাঁধার মুখে তাঁদের পাঁচটি নৌকা ডুবে যায়। এখানে একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এর ফলে পাকসেনাদের জন্য নদীপথে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া একইদিনে পড়শুরাম থানার কাছে পাকবাহিনীর একটি টহলদার গ্রুপের উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ৭ জন পাকঅসেনাকে হত্যা করে। দুঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকসেনারা মর্টারের সাহায্য আক্রমণ চালিয়ে গেরিলাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আরেকটি মুক্তিসেনার দল ফনী বেলুনিয়া সড়কের উপর হাসানপ্পর সড়কটি ধ্বংস করে দেয়। শুধু তাই নয়, শালদা নদীর কাছে একটি পাকবাহিনীর টহলদার দলের দুইজন সদস্যকে তারা গুলি করে হত্যা করে। এদের একজনের নাম হাবিলদার আজিজ এবং অন্যজনের নাম হাবিলদার রহমান গুল। আগস্টের শেষ নাগাত বিমান হামলায় মুক্তি বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ফ্লে শালদা স্টেশন পাকবাহিনী দখল করে নেয়। এদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ শালদা স্টেশন পুনরুদ্ধারে মুক্তি বাহিনীর শক্কতি বৃদ্ধি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ক্যাপ্টেন গাফফারের কমান্ডে শালদা নদীর উত্তরে বায়েকে একটি কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি নয়নপুর সড়কে এবং ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি শালদা রেলস্টেশনে পশ্চিমে মোতায়েন করেন। ক্যাপ্টেন পাশার কমান্ডে আর্টিলারি কোম্পানি মন্দভাগে অবস্থান নেয়। মর্টার সেকশন সুবেদার জব্বার বায়েকের পিছনে সাপোট সেকশন হিসেবে পজিশন নেন। এই অভিযানের সার্বিক কমান্ডে থাকেন স্বংয় মেজর খালেদ মোশাররফ। সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে পাওসেনারাও বেলুনিয়া ও শালদা নদী এলাকায় তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ৬ সেপ্টেম্বর পাকসামরিক বাহিনী নয়নপুরে বিপুল সৈন্যসমাবেশ করে। রাত তিনটায় পাক বাহিনীর দুটো প্লাটুন সিলোনিয়া নদী অতিক্রম করে। মুক্তি বাহিনীরা আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জনকে হত্যা করে। অবশিষ্ট সৈনরা মর্টারে শেলবর্ষণ করে করার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরদিন বিকাল ৪টায় পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল পশ্চিমে মুহুরি নদী অতিক্রমের চেষ্টা করে। মুক্তি বাহিনী বাঁধা দিলে একজন অফিসারসহ ১৫ জন নিহত হয়। পাকসেনারা তাঁদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং মুক্তি বাহিনী টিকে থাকতে না পেরে পিছু হটে যায়। পাকবাহিনী তাঁদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। পরে মুক্তি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১০ সেপ্টম্বর মুহুরী নদী পাড় হয়ে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। সমস্ত দিনের যুদ্ধে মুক্তি বাহিনী এ আক্রমণ প্রতিহত করে। তবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও মুক্তি সেনারা পাকবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। শত্রুদের উপর মুক্কতিবাহিনী চাপ অব্যাহত রাখে। ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি দল কামানের সাহায্য পরসুরামের পাকঘাটিতে আক্রমণ চালিয়ে ৭ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। পাকবাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে ফেনীর দক্ষিণে কামান সজ্জিত অবস্থান গড়ে তোলে। সেখান থেকে মুক্তি বাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। মুক্তি বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীও পাক্সেনাদের অবস্থানের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। দুইঘন্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১০ জন নিহত এবং তারা তাঁদের নিজেদের অবস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর যথেস্ট ক্ষয়ক্ষতি এবং তারা গোলাগুলি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর পাকবাহিনীর ফেনীতে মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। পরে শালদা নদীর পাকঘাটিতে মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর ক্ষতি সাধন করে। এ যুদ্ধে ২০/২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। শালদা অবস্থান থেকে বিতাড়নের পর মুক্তিবাহিনী পড়শুরামের পাক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এতে ১০ জন পাকসেনা আরও কয়েকজন আহত হয়। এর একদিন পর অনন্তপুর গ্রামের অবস্থানের ওপর মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করে। ২৯ সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের নয়নপুর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন পাশা পাকবাহিনীর ওপর প্রথম আর্টিলারি গোলানিক্ষেপ করেন। শুরু হয় চারদিক থেকে পাক বাহিনীর ওপর থেকে আক্রমণাভিযান। ক্যাপ্টেন আশরাফের উদ্যগ আর নেতৃত্বে নয়নপুরে শত্রু বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী নয়নপুর ছেড়ে শালদা নদীর রেল স্টেশনের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। ফলে নয়নপুর মুক্তি বাহিনীর দখলে চলে আসে। ক্যাপ্টেন গাফফারকে শালদা নদী স্টেশন দখলে দায়িত্ব দেয়া হয়। অক্টোবর রাত এগারোটায় পাকবাহিনীর মুন্সিরহাট অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যথেস্ট ক্ষয়ক্ষতি করা হয়। পাক্সেনাদের জন্য বেলুনিয়া সেক্টরে মুন্সিরহাট অত্যন্ত গুরুতেপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। ২ অক্টোবর পরশুরাম ওপর মুক্তি বাহিনী চাপ সৃস্টি করলে এখান থেকে শত্রু সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলে মুহুরি নদী অতিক্রম করে পরশুরামের অনেকগুলো অবস্থান মুক্তি বাহিনী ত্যাগ করে। মুক্তি বাহিনী ২ অক্টোবর শালদায় পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালালে ৯ জন পাক্সেন নিহত হয়। পাকসেনারা তাঁদের অবস্থানগুলোকে রক্ষা করারা জন্য ২ ও ৩ অক্টোবর ফেনী থেকে মুন্সিরহাট ও চিতলিয়াতে এক সৈন্যসমাবেশ করে। ৩ অক্টোবর পাকবাহিনীর একটি দল মুক্তি বাহিনীর ও ধানকুন্ডা পুনদর্খল করে। পুনদর্খলের এই লড়াইয়ে মুক্তি বাহিনীদের হাতে পাকসেনাদের ৪০/৫০ জন হতাহত হয়। মুক্তি বাহিনীর একজন মাত্র সদস্য এখানে শহীদ হন। ৪ অক্টোবর পাকবাহিনীর চিতলিয়া ঘাঁটের ওপর মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালায়। আধ ঘন্টা স্থায়ী এই আক্রমণাভিযানে প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। ৬ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত মুক্তি বাহিনী পরশুরাম, চিতলিয়া এবং নোয়াপাড়া উপর আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। ১১ অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর অনন্তপুর ঘাঁটির উপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তি বাহিনী তাঁদের আক্রমণ প্রতিহত করে। এখানকার এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। ১৪ অক্টোবর সালধরের কাছে পাকবাহিনীর দুটো প্লাটুন মুক্তি বাহিনীর প্রতিরক্ষা মাইনের শিকার এবং ১৮ জন সৈন্য নিহত হয়। ১৬ অক্টোবর শালদার অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালালে উভয়পক্ষের মধ্য সংঘঠিত যুদ্ধে৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ঐদিন বিকেলে মুক্তি বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানে হামলা চালিয়ে তাঁদের ১০ জনকে হতাহত করে।
শালদা নদীর পাক ঘাঁটির ওপর বড় ধরনের অভিযান হয় নভেম্বরে। এ অভিযানের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় মুক্তি বাহিনী। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রেলওয়ে ও উঁচু রেললাইন সংলগ্ন শত্রু ঘাঁটিকে তিনদিক থেকে আক্রমণ করা হবে। ক্যাপ্টেন গাফফার ও নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন শালদা নদী রেলস্টেশ্নের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি প্লাটুন শালদা নদীতে শত্রু ঘাঁটির বিপরীতে অবস্থান নেয়। সুবেদার ওয়াহাবের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি নিরাপত্তামূলক অবস্থা গ্রহন করে। ১৫ নভেম্বর রাতে পাকসেনাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য শ্ত্রু ঘাঁটির উপর হাল্কা আক্রমণ চালানো হয়। পাক বাহিনী এর পাল্টা জবাব দেয়। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি শালদা নদীর গুদামঘরের পরিখায় অবস্থানরত শ্ত্রুদের উপর এবং নায়েক সুবেদার রিয়াজ পূর্বদিকের পাহাড়ি এলাকার অবস্থান থেকে ওই একই অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। নায়েক সুবেদার মুহাম্মদ, হোসেন সুবেদার বেলায়েতের অবস্থান থেকে নদীর অপর তীরের পরিখাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে চারটি পরিখা ধ্বংস করে দেয়। সুবেদার বেলায়েত তাঁর দলের প্রচন্ড আক্রমণে শালদা নদীর তীরবর্তী এলাকা শ্ত্রু মুক্ত হয়। ফলে শালদা নদী রেলস্টশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রচন্ড আক্রমণে ঠিক্তে না পেরে গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর রেলস্টেশনে দিকে পালাতে থাকে। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি গুদামঘর এলাকা দখল করে নেয়। সবেদার বেলায়েত ও নায়েক সুবেদার সিরাজের প্রচন্ড আক্রমণে শালদা নদী রেলস্টশনে অবস্থাকারী পাকসেনারা পালিয়ে নয়নপুরের দিকে চলে যায়। দুপুর নাগাদ সমস্ত শালদা নদী এলাকা শ্ত্রু মুক্ত হয়ে মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে আসে। পাকসেনারা নয়নপুর ঘাঁটি থেকে মর্টার ও কামানের আক্রমণ চালায় এবং শালদা নদীর গুদামঘর দখল করা চেষ্টা চালায়। সুবেদার বেলায়তের পাল্টা আক্রমণে শ্ত্রু সেনারা পালিয়ে যায়। কিন্তু দুভাগ্যজনক যে, সুবেদার বেলায়েত এই যুদ্ধে শহীদ হন। শালদা নদী এলাকা দখল একটি দুঃসাহসিক অভিযানের অংশ ছিল। বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন গাফফার ও শহীদ বেলায়তকে যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ডিসেম্বর প্রথম দিকে ‘কে ফোর্স’ ছাগলনাইয়া ও ফনী উপকন্ঠে পাকসেনাদের উওর পশ্চিম দিক থেকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলে এবং পাকসেনাদের অবস্থানের উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। এই প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা ভীত হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে ৬ ডিসেম্বর পাকসেনারা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর সেতু হয়ে চট্রগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এও তারিখে মুক্তি বাহিনী ফেনী দখল করে নেয়। ফলে সেদিন ফেনী শহর মুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর নোয়াখলী সদর মুক্ত হয়। নোয়াখালী সদরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী তীব্র আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই বাহিনী সমগ্র নোয়াখালী মুক্ত করে ৯ ডিসেম্বর।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!