বৈকারীর যুদ্ধ, সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, কুশখালী বিওপি’র ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ও তালগাছা বিওপি থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা বৈকারী। এলাকাটির দক্ষিণে রয়েছে দাঁতভাঙা বিল। বৈকারী থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা মাত্র শ’-দুই মিটার পশ্চিমে অবস্থিত। ইছামতি নদীর মুখ সোনাই নদী বৈকারীর পশ্চিমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর। এই বৈকারীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বৈকারী বিওপি সম্পূর্ণ দখলে নেয়। তারা এক কোম্পানী সৈন্য ও প্রায় ৩০ জন রাজাকার নিয়ে বৈকারী বিওপি’র উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দুই কিলোমিটার এলাকা জুরে ত্রিমুখী প্রতিরক্ষা তৈরি করে। অপরদিকে আনুমানিক এক কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ দাতভাঙ্গা বিলের পাশে এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে এক কোম্পানি যোদ্ধা বৈকারী ক্যাম্পের উত্তরে কিজুরী গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন।
জুন মাসের প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী বৈকারী বিওপি আক্রমণের পরিকল্পনা করে। জুন মাসের মধ্যভাগে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ছত একটি দল বৈকারী বিওপি’র প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে রেকি করার উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং বিওপির সন্নিকটে বটগাছের উপরে চুপিসারে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বটগাছের আশেপাশে এন্টি পার্সোনাল মাইন ও বটগাছ থেকে বিওপি ফেরার পথে মাইন স্থাপন করা হয়। এ সময়ে বটগাছের কাছের মরচার কোনো পাহারা না থাকায় এই কাজ অনায়েসে সম্পন্ন হয়। পতাকা লাগানোর পেছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করে তা হলে। মুক্তিবাহিনীর দলের সাহহ ও মনোবল দখলদার বাহিনীকে বুঝিয়ে দেওয়া এবন গবটগাছটি সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় পতাকা নামানোর প্রচেষ্টাকালে পাকবাহিনীর সদস্যদের ঘায়েল করা। মুক্তিযোদ্ধাদের এই পরিকল্পনা কাজে লাগে এবং পাকসেনারা তাড়াহুড়া করে পতাকা নামাতে গেলে সোনাই নদীর পশ্চিম পাশের শ’-দুই মিটার দূরত্বে গাছের নীচে স্থাপন করা মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি গর্জে ওঠে। ফলে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। অতঃপর ভীতসন্ত্রস্ত পাকসেনারা বিওপি’তে দ্রুত ফিরে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হলে আরও কয়েকজন নিহত হয়।
জুলাই মাসের শেষ দিকে এবং আগস্ট মাস জুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও জনবল বৃদ্ধি পায়। এসময় আবার বিওপি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন শফিউলাহ’র নেতৃত্বে একটি রেকি পার্টি রাত দশটার দিকে হাকিমপুর থেকে তাকের ডিঙি নৌকা করে সোনাই নদী পার হন এবং কাতুন্দা খলিলনগর এলাকায় শক্রবাহিনীর টেলিফোন সংযোগের তার কেটে সাতক্ষীরা সদরের সাথে তাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হন।
ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ তার দলসহ রেকি সম্পন্ন করে ইটিন্ডা ফিরে যান। দিন ১৫ পর (অক্তোবরের প্রথম সপ্তাহ) পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ মূলদল নিয়ে ইটিন্ডা থেকে ইটিন্ডা-বৈকারী রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়ে বৈকারী সীমান্ত চৌকির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান নেন। অপর দলটি ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে কইজুরী এলাকায় অবস্থান ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সীমান্তের পশ্চিম প্রান্তে সোনাই নদীর পশ্চিমে বটগাছের নীচে মুক্তিবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থাপন করা হয়। এবং অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করার পর আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে বৈকারী বিওপ’র প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করা হয়। রাৎ প্রায় এগারোটার দিকে আর্টিলারি ফায়ারের ছত্রছায়ায় কইজুরী গ্রাম এলাকা থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং বৈকারী গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ’র দল এগিয়ে যায়। দখলদার বাহিনী পাল্টা ফায়ার করলে দু’দলের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এ সংঘর্ষে দখলদার বাহিনী টিকতে না পেরে সীমান্ত চৌকি থেকে পশ্চাদপসরণ করে। পরের দিন বৈকারী বিওপি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। বৈকারী বিওপি’তে দখলদার বাহিনীর ১০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বৈকারী বিওপি শক্রমুক্ত হয়।
[৫৭] ইকবাল জাফর খন্দকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত