বৈকালী সিনেমা হল এলাকার যুদ্ধ, খুলনা
খুলনা শহরের অদূরে বয়রা। বয়রায় তখন ব্যাপক প্রস্তুতি, যশোর রোড দিয়ে যদি পাকসেনারা খুলনাভিমুখে অগ্রসর হয় তবে প্রতিরোধ করবে। ২৭ মার্চ হঠাৎ খবর এল যশোর সেনানিবাস থেকে বিরাট এক কনভয় খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সাথে সাথে নোয়াপাড়া, ফুলতলা ও দৌলতপুরের সাথে যোগাযোগ করে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হলো। নোয়াপাড়া থেকে সেনাবাহিনী যাতে কোন প্রকারে খুলনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য যশোর রোডের উপর গাছ কেটে ফেলা হয়, ইট যোগাড় করে ব্যারিকেড দেয়া হল এবং দু’তিন জায়গায় কালভারট ভেঙ্গে গাছপালা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। নোয়াপাড়ার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে যে ব্যারিকেড দিয়েছিল সেনাবাহিনীর কনভয় সে সব উপেক্ষা করে রাস্তার ব্যারিকেড পরিষ্কার করে চলে আসে ফুলতলায়। এডভোকেট কাজী আবদুস সালাম, কাজী তবারক হোসেন (তাবু কাজী), খোকন কাজী সহ অন্যান্য শত শৎ লোক একত্রিত হয়ে বেজের ডাঙ্গা সরদার বাড়ির কাছে ফুলতলা বাজার থেকে বালিকা বিদ্যালয় পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়েছে। ইতিমধ্যে ফুলতলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান কাজী আঃ সালাম ও তাবু কাজীর নিকট ৩০টা রাইফেল ও কয়েক বাক্স গুলি দিয়ে দেন। সেনাবাহিনী ক্রেন সহ ফুলতলায় আসে, শুরু হয় যুদ্ধ। ফুলতলা ব্যাংকের একজন দারোয়ান বন্দুক দিয়ে গুলি চালালে গুলিতে তিনজন খানসেনা নিহত হয়। কিন্ত খানসেরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও তাঁর পুলিশ বাহিনী এবং যুগনি পাশারু মুসা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে। কিন্ত সেনাবাহিনীর উন্নত অস্ত্রের কাছে প্রতিরোধ ভেসে যায়। ফুলতলার মন্দিরে ঢুকে তারা ভারত ফার্মেসীর মালিক ডাঃ মনিন্দ্রনাথকে হত্যা করে এবং গুলি করতে করতে খুলনাভিমুখী রওয়ানা হয়। অধ্যাপক আবু সুফিয়ান দৌলতপুরের রেলী গেটে আর একটি শক্তিশালী ব্যারিকেড গড়ে তুলেছেন। আবু সুফিয়ান তখন দৌলতপুরের অবিসংবাদিত নেতা। তার নেতৃত্বে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা গড়ে তেলেছে আর এক প্রতিরোধ দুর্গ। কিন্ত পাককনভয় নোয়াপাড়া ও ফুলতলায় বাধাগ্রস্ত হয়ে অতি সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা ফুলবাড়ি গেট অতিক্রম করে ধীরে গতিতে আসছিল। কিন্ত দৌলতপুরের প্রবেশদ্বারে রেলী গেটে (বর্তমানে আবু সুফিয়ান গেট) এসে ব্যারিকেড দেখে নেমে পড়ে এবং ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলে ফের রওয়ানা হয়। দৌলতপুর মোড় অতিক্রমকালে দৌলতপুরের এক তরুণ হিডি এই কনভয়ের উপর ২২ বোর রাইফেল দিয়ে এক দালানের ছাদ থেকে পর পর কয়েকটি গুলি করে, আহত হয় পাকসেনাদের কয়েকজন , শক্রর রক্তে দৌলতপুরের রাস্তা রঞ্জিত হয়। এদৃশ্য ও ঘটনা দৌলতপুর তথা খুলনাবাসীর মনে বেশ অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। হিডির এ সাহসী আক্রমণ যুবকদের আর সাহসী করে তোলে। বৈকালীর মোড়ে মল্লিক সুলতান আহমেদ দাঁড়িয়ে। এমন সময় ১৩ জন রিজার্ভ পুলিশ অস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে তার সাথে দেখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানতে পারেন যে, তারা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে নেমেছেন। তখন তিনি আলোচনাক্রমে তাদের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বৈকালী সিনেমা হলের ভিতর ৫ জন, পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে ৪ জন ও অন্য ৫ জনক আরেক স্থানে পজিশন দেন। মল্লিক সুলতান আহমেদের নিরদেশক্রমে বেবীট্যাক্সি ড্রাইভার মোসলেম বৈকালী সিনেমা জলের তালা ভেঙ্গে রিজার্ভ পুলিশের থাকারও ব্যবস্থা করেন। প্রায় বেলা ১২টার দিকে পাকসেনাদের কনভয়ের ৩/৪টা গাড়ি গোয়াখালি অতিক্রম করলে, নগর আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মীর্জা খায়বার হোসেন খবর পেয়ে সকলকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। এক দল আশ্রয় নেয় বৈকালী সিনেমা হলের ভেতর, অন্যদল খুলনা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতর। মীর্জা খায়বার হোসেন, এডভোকেট মঞ্জুরুল আলম, শেখ দবিরুল ইসলাম, মীর্জা উদ্দীন, শেখ সালাম উদ্দীন, শেখ সারোয়ারু উদ্দীন, মুজ্জাম্মির খিজির আলী, দুলু কাজী, হাবিবুর রহমান, কবীর জিন্না, বাবু খোকন, শেখ নূর মোহাম্মদ, ওয়াদুদ, মোহাম্মদ আলম, শেখ আব্দুল গাফফার, কালিপদ, মোঃ নুরুল হক, পুলিশের সিপাহী মুফাজ্জল মুন্সি, পুলিশ ও আর্মির প্রাক্তন সদস্যসহ ৫০/৬০ জন মিলিত ভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে পাককনভয়কে বাঁধা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের তিন চারটি গাড়ি এসে যায়। সাথে সাথে শুরু হয় রাইফেল ও বন্দুকের গুলি। পাকসেনারা বিপদ দেখে যশোর রোডের পূর্ব দিকে দ্রুত নেমে পড়ে পজিশন নেয় এবং বৈকালী সিনেমা হল লক্ষ্য করে শুরু করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কম যায় না, তারাও বেপরোয়া হয়ে গোলাগুলি অব্যাহত রাখে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকসেনারা মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে বৈকালী সিনেমা হলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের একমাত্র টার্গেট তখন বৈকালী সিনেমা হল। কারণ, ওখান থেকেই বেশি গোলাগুলি তাদের আসছিল। পাকসেনারা তখন পাবলিক লাইব্রেরী ও মহিলা কলেজের দিকে আক্রমণ শুরু করে, খানসেনাদের লক্ষ্যে অনেক বোমা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্ত সেগুলো তেমন কাজে আসেনি। ঐ সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক এক ঝুড়ি বোমা মাথায় করে বিড়ি খেতে খেতে দ্রুত এডভোকেট মঞ্জুরুল আলমের নিকট আসে। মঞ্জুরুল আলম তাকে বিড়ি খেতে দেখে ধমক দিলেন, কারণ আগুনে নিজেদেরই বিপদ হতে পারে। এলোপাথাড়ী বোমার লক্ষহীন আক্রমণ চলে। বয়লা মহিলা কলেজের সামনে ছিল প্রচুর ইটের গাদা, সি এন্ড বির এই ইটের ঢিবির পিছন থেকে একদল তরুণ কয়েকটা আক্রমণ চালায়। খানসেনাদের একজন নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। এই সময় পুলিশের সিপাহী মুন্সি মুজাম্মেল হক এক ইটের গাদা থেকে অন্য ইটের গাঁদায় যাওয়ার সময় পাকসেনাদের এক জোয়ান তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। নিশানা ছিল অব্যর্থ তাই সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে এই অকোতভয় যোদ্ধা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত দু’পক্ষ ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। খানসেনাদের আরো ২০/২৫ টি গাড়ি চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে যায় আর খানসেনারা চলে যায় খুলনা শহরে। এই যুদ্ধে এইচ এন্ড পোদ্দার কোম্পানীর একজন শ্রমিকও মারা যায়। তাঁর নাম মুন্সি মিয়া। যুদ্ধ শেষে আজকের যুদ্ধের বীর শহিদ বয়রা রিজার্ভ ক্যাম্পের সিপাহী পি আর এফ নাম্বার ১৩৪, মুন্সি মোফাজ্জল হককে যথারীতি বাজারে দাফন করা হয়। এই শহীদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মুকছেদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। তার আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বয়রাবাসী স্মরণ করবে। বয়রা যুদ্ধের পরদিন ২৮শে মার্চ খুলনা থেকে কয়েক গাড়ি মিলিটারী এসে বয়্রা এলাকায় ব্যাপক জ্বালানো-পোড়ানো শুরু করে। স্থানীয় জনসাধারণের অনুরোধে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরোধ না করে পিছু হটে যায়। পাকবাহিনী ফুলতলায় যায় এবং আবু কাজী ও খোকন কাজীর বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দেয়। এই সময় পাকসেনাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় সরো মোল্লা, হাবিবুর রহমান (পরবর্তীতে রাজাকার কমান্ডার), সৈয়দ মোল্লা, ওহাব মহলদার প্রমুখ। বয়রা যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই যুদ্ধ এতদ্বঞ্চলের লোকজনের দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামান্য ক’টা বোমা, রাইফেল, বন্দুক নিয়ে দুর্দর্শ খানসেনাদের গতিরোধ করা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বৈকালীর যুদ্ধ তাই খুলনার স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। মীর্জা খায়বার, এডভোকেট মঞ্জুরুল আলম, মল্লিক সুলতান আহমেদ, শেখ দবিরুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ সহ অন্যান্য যোদ্ধারা সেদিন যে সাহসিকতার নজির স্থাপন করেছে গোটাজাতির জন্য তা গর্বের বস্তু।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত