বিল বরাইচারার যুদ্ধ
অক্টোবরের শেষ দিকে(সম্ভবত ৩১ অক্টোবর) বিল বরইচারার যুদ্ধ দক্ষিনাচলের বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বদর কমান্ডাএর দলে কিছু সদস্য কৃষনপ্পুর থেকে একই উদ্দেশ্যে রওয়া হয় এবং উভয় দলই বিল বরইচারার কাসেম বিশ্বাসের বাড়িতে দুপুরে (খাওয়ার জন্য) অবস্থান নেয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজাকারদের গোপন সংবাদ দেয়।সবে মাত্র খাওয়া শুরু করেছে এমতাবস্থায় কমান্ডার কুতুবের নেতৃত্ব রাজাকারা আক্রমণ করে।মুক্তিযোদ্ধারা সাথে সাথেই অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়।যুদ্ধে রাজাকার কমান্ডার কুতুব নিহত হয় এবং ফরহাদ হোসেন ধরা পড়ে।মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মস্তাফিজুর রহমান(দমদম) আহত হন।নভেম্বরের প্রথম দিকেই বদর কমান্ডারের নেতৃত্বে শেখ পাড়া রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটে।রাজাকাররা পালিয়ে যাওয়ার সময় মধুপুর থেকে রামগোপাল অধিকারী ওঁ আহসানুজ্জামান জামালকে ধরে নিয়ে যায়। পরে এলাকার সংগঠকদের প্রচেষ্টায় রাজাকার ফরহাদ হোসেনের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করা হয়।নভেম্বর(সম্ভবত প্রথম সাপ্তাহ) পাক হানাদার বাহিনী ওঁ রাজাকাররা মুজাহিদসহ জগন্নাথপুর ইউনিয়নীর দয়ারামপুরে আক্রমণ চালায়।গ্রামে ঢুকতেই প্রথম দিবক সরদারকে গুলি করে হত্যা করে।এরপর হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়।ঘরের মধ্যেই পুড়ে মারা যায় সুধীর ঘোষ,হালদার বাড়ির একজন সহ অন্যান্য বাড়ির আরোও অনেক মানুষ। সম্পূর্ণ গ্রামটি ভস্মে পরিণত হয়,গ্রামের যে ছয়জন তাদের সহযোগিতা করেছিল তাদেরকেও হত্যা করা হয়।এছাড়া আলীম উদ্দিন (মহেন্দ্রপুর),রমজান আলী(চাপাইগাছি),হোগলার ঘোষ্পাড়া এবং আওয়ামী সংগঠক আ. আজিজ খানের(মহেন্দ্রপুর) বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।তারা বীরাঙ্গনা দৌলতজান(দয়ারামপুর),এলেজান এবং মাসুদা খাতুনে(হাসিমপুর)সহ নাম না জানা আরও অনেক মেয়ের ওপর ওইদিন পাশবিক নির্যাতন চালায়।
রাজাকারদের কারযকরভাবে প্রতিরোধ করার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চাশা বেড়ে যায়।মহেন্দ্রপুরের বাহারুল ইসলাম বাহার কমান্ডারের অধীনস্ত তেজস্বী যোদ্ধা অতি উৎসাহী হয়ে কুমারখালি শহরের মুজাহিদ ক্যাম্প(দূরগাপুর) আক্রমণের প্রস্তাব করে।কিন্তু এর পাশেই মিলিশিয়া ওঁ আর্মি ক্যাম্প থাকায় বাস্তবতা উপলব্দি করে কমান্ডার বাহার তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলেন।কারন একক প্রচেষ্টায় এ অপারেশন সফল হওয়া এক প্রকারের অসম্ভব।তিনি অস্র সংগ্রহ করে বস্তায় ভরে একটা পুকুরে ডুবিয়ে রেখে উত্তরাঞ্চলের অন্য কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগের যেষ্টা করেন।কিন্তু দুঃসাহসী কিছু মুক্তিযোদ্ধা মহেন্দ্রপুরের আ কাদের ওঁ আবুল কাসেরমের(দুই ভাইয়ের) নেতৃত্বে বস্তা ভরতি অস্ত্রগুলো তুলে ঘাসখালে (পাশের এলাকা) গিয়ে পরিস্কার করে অপারেশনের প্রস্তুতি করেন।কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের,কয়েকজন রাজাকার দালাল এ সংবাদ ক্যাম্পে জানিয়ে দেয় এবং পাক সৈন্য,মুজাহিদ ওঁ মিলিশয়ার সমন্বয়ে বড় একটি দল ১১ নভেম্বর ঘাসখালের উদ্দেশে রওয়া হয়।কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা যোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং অস্ত্রসহকারে ৬জন মুক্তযোদ্ধাসহ মোট ১৩/১৪ জনকে ধরে ফেলে/তাদেরকে নির্মম, নিষ্টুর নির্যাতন করতে করতে কুমারখালি প্রত্যাবর্তন করে।এর মধ্যে লিয়াকত আলো(নাউত্রী) ওঁ ফেলু শেখ সাত্তার(বাড়াদি) আহত অবস্থায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।অকথ্য অত্যাচারের পর উপজেলা চত্বরের পিছনে তাদের দিয়ে গর্ত করিয়ে রাত ৮টার দিকে ১১ জনকে গুলি করে গণকবর দেয়।শহীদবৃন্দ হলেঃ-১-মনেদ্রপুরের আ কাদের ওঁ আবুল কাসেম(দুই ভাই) ২)আ. আজিজ (চাপাইগাছি), ৩)ফকির সর্দার(শীকোল),৪)শাজাহান (কসবা), ৫) অপর ৬ জনের নাম অজ্ঞাত। নভেম্বরের কোন এক সময় মুক্তিযোদ্ধা আ মাসুদ ফুল খন্দকার শামসুজ্জোহা ওঁ জাফরুল্লাহ খান জাফরি প্রমুখ কমান্ডার নিজ নিজ গ্রুপসহ চাদপুরে অবস্থান কর। খাওয়ার প্রস্তুতিরত অবস্থায় রাজাকাররের দালাল মারফৎ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পান্টি থেকে চাঁদপুরের দিকে রওনা হয়। কিন্তু মোক্তিযোদ্ধারা একথা জেনে যান এবং তাঁরা তিনভাগে ভাগ হয়ে পন্তির উদ্দেশ্যে তিনদিক দিয়ে আসতে থাকেন।রাজাকাররা গুলি করতে করতে চাদপুর মসজিদ পর্যন্ত চলে যায়ার পর বুঝতে পারে যে তাঁরা তিনদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে, তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন বাড়ির মধ্য দিয়ে পালাতে থাকে।এর কিছুদিন পর আবার ক্যাম্প করে এবং খোকশা ওঁ মধুপুরের দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পান্টিতে ধরে নিয়ে আসে।কিন্তু জাহিদ হোসেন জাফর,আ মাসুদ ফুল,লুতফুর রহমান, শামসুজ্জোহা,জাফররুল্লাহ খান জাফরি প্রমুখ কমান্ডার প্রস্তুতি গ্রহণ করে হুশিয়ারি উচ্চারন করে যে তাদের ছেড়ে না দিলে যেকোনো সময় ক্যাপে আক্রমণ করা হবে।এরুপ হুশিয়ারিতে চাপের মুখে পড়ে দুজনকে ছেড়ে দেয় এবং নিজেরাও দক্ষিণাঞ্চলের শক্তিশালী এই রাজাকার ক্যাম্পটি গুটিয়ে ফেলে।এভাবে নভেমবর মাসের মধ্যেই যুদ্ধের পট পরিবর্তন হয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা শহরের ক্যাপটি ছাড়া থানার প্রায় প্রইতটি রাজাকার ক্যাম্পেরই পতন ঘটাতে সক্ষম হন। রাজাকারদের তৎপরতা পাক আর্মিদের সহায়তা বিক্ষিপ্ত ভাবে চলতে থাকে।পান্টির শক্তিশালি ক্যাম্পটি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে খেলাফত হোসেন নভেম্বর শেষে অথবা ডিসেম্বরের প্রথমে কুষ্টিয়া আসার পথে রাস্থার দু পাশে ফসল পুড়িয়ে ব্যপক ক্ষতিসাধন করে। মোহননগরে আমজাদ মোল্লার বাড়ি ওঁ এর আশেপাশের ২০/১৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং একজন কৃষককে হত্যা করে। পান্টির বিশাল বাজারটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। বাজাররের পাশের কসাইপাড়া,কলুপাড়া এবং জাহিদ হোসেন জাফরের বাড়িসহ বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।নিরীহ গ্রামবাসী জাকের(পান্টি),গনেশপুরের একজন জমাদার এবং সাওতার একজনকে পান্টিতে হত্যা করে।এছাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন ওঁ সাধারণ সম্পাদক সোবহান মোল্লা ওঁ ভাতিজা আজগর আলী মোল্লাকে ধরে নির্যাতন চালায়।ফেরার পথে মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেনের জামাই মাওলানা আকবর হোসেনকে(রামচন্দ্রপুরে) হত্যা করে। নিয়ামতবাড়িয়ার মাদ্রাসার হাফেজ ফয়জুল্লা(পেশোয়ার,পাকিস্থান),নামে এক আলেম এবং একই গ্রামের এক জেলে ওঁ এক রাখালকে সামনে পেয়ে হত্যা করে।তারা কুশলীবাসাতে খোন্দকার শামসুজ্জুহা,সুলতা উদ্দিন আহম,সুকুর খাঁ নাসিম উদ্দিন শেখ, ইসাহাক আলী মোল্লা,রিয়াজ উদ্দিন শেখ আ রশিদ জোয়ারদার,মকবুল হোসেন জোয়ারদার,এবং চাঁদপুরের আলী হোসেন,বদর,করিম মোল্লা, আমজাদ মোল্লা, আ মজিদ প্রমুখ বুক্তি বাড়ি এবং ধলনগর প্রতাপপুর এলাকার অনেক বাড়ি(প্রায় ৫০/৬০) সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়।
[১২] এ টি এম জায়েদ হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত