বালাট সাব-সেক্টরের খন্ডযুদ্ধ, সিলেট
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সাপ্তাহ।বালাট সাব সেক্টর তখন যুদ্ধের তরঙ্গে উত্তাল।মুক্তিবাহিনী তখন গুজাবিল,নলুয়া,বাগমারা,কাংলার হাওর, চিনাকান্দি প্রভৃতি অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যুধে লিপ্ত।তাদের হাতের অস্ত্র মানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের থ্রী নট থ্রী রাইফেল,কয়েকটি অতি হালকা মেশন গান।এ দিয়েই তাঁরা সুরমার উত্তর পারের যুদ্ধকে ফহরে রেখেছে সুনামগনের চার থেকে আট মাইলের মধ্যে।আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর সাত্থে যুদ্ধ করে আত্নবলি দিয়েছে ডজন ডজন তাজা প্রান তরুণ।কিন্তু মনোবল তাঁরা কখনই হারায়নি।ধন্য তাদের বীরত্বপূর্ণ আত্নত্যাগ।জাতির হৃদয়ে তাদের বীরত্বগাথা অক্ষয় হয়ে থাকবে চিরকার।সাব সেক্টরের সম্মুখে যুদ্ধ তখন মূলত সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে অংশি বিশেষ সীমাবদ্ধ ছিল।অভ্যন্তর ভাগে নিয়মিত চলতো সুপরিকল্পিত গেরিলা অপারেশন।সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে ডেকে পাঠানো হউ কোম্পানীয় কমান্ডার গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশীকে। অ অঞ্চলের মিত্র বাহিনীর খবর হচ্ছে দুই দিন পর মধ্যে রাতে একজন মেজরের নেতৃত্বে কিছু পাক সেনা সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ আসবে;তাদের অবশ্যই আহসানমারা হয়ে আসতে হবে।সে পথে যথা সময়ে একটি মাইন বসাতে হবে।এজন্য সত্ত্বর একটি দল গঠন করে পাঠাতে হবে।বলাবাহুল্য,সেক্টরের অত্যন্ত ভেতরের এ গেরিলা অপারেশনে বেশি লোক আর বেশী অস্ত্র মানেই বেশি ঝুকি।ঠিক মানেই বেশি ঝুঁকি। ঠিক হল দলনেতা গৌরাঙ্গচন্দ দেশূর সাথে ৮জন মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার আব্দুর রহীম সান্ত মিয়া(নবীগঞ্জ),সুধীর রঞ্জন সুত্রধর,পীতেশ,আলী হাওদার প্রমুখ যাবে। অস্ত্র দেয়া হয় একটি এন্টি ট্যাংক মাইন,কয়েকটি হান্ড গ্রেনেড, কিছু এক্সপ্লোসিভ এবং কিন্তু আনুসঙ্গিক উপাদান। জরুরী আত্ন্রক্ষার জন্য দেয়া হয় সামান্য কয়েক রাউন্ড অতিরিক্ত গুলিসহ একটি এস এল আর এবং একটি স্টেনগান। দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর নির্দেশে সুনামগঞ্জে থানার ওসি কাজী মোখলেছুর রহমান অপারেশন ব্যায় বাবদ প্রয়োজনী অর্থ যোগান দেন।যাবার সময় এ দল চিনাকান্দিতে রাত্রী বাস করে।অতঃপর একটি নৌকা নিয়ে নিদৃষ্ট স্থানের দিকে রওয়ানা হয়।রাতের অন্ধকারে একটি মাইন মুক্তিযোদ্ধার দল রেখে দেয়্য।একটি জীপ এ মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায়।কিন্তু কোন মেজর এতে মরেনি।জীপ চালক ছড়া কেউ ছিলো না। দলের অপারেশন অবশ্য ব্যর্থ যায় নাই।দল তাঁর নিদৃষ্ট কাজ সেরেছে।মাইন বিস্ফোরনের পর সম্ভাব্য বিপদ সৃষ্টি হতে পারে আশংকায় এ দল দ্রুত এলাকা ত্যাগ কএর।সকলের পেটে প্রচন্ড ক্ষুঢা।এ দলের কেউ কেউ দূরবর্তী নদীতে চলাচলকারী লঞ্চের শব্দকে গানবোটের শব মনে করে ওঁৎ পেতে থাকে। কিন্তু আসলে তা নয়। অবশেষে সকালবেলা মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায় রাজাবাজ গ্রাম ওঠে বিশ্রাম ওঁ আহারের ব্যবস্থা ক্করার চেষ্টায় বেরিয়ে পড়ে।এ এলাকা থেকে আন্দাজ চার মেইল দূরে জামালগঞ্জে(সাচনা বাজার) তখন পাক আর্মির ঘাটি।যেকোনো মুহূর্তে পাক বাহিনীর লোক ঐ গ্রামে পৌছাতে পারে।অথচ মুক্তিযুদ্ধাদের নৌকা চালনার মত শক্তি নেই।নিরুপায় হয়ে ঐ গ্রামের মধ্যেওই কিছু বিশ্রাম ওঁ আহারের সিদ্ধান্ত নেয়।এদিকে ডাল ভাত রান্না হচ্ছে।ক্লান্ত সহগামীদের বিশ্রামের কথা বলে দল নেতা গৌরাঙ্গ দেশী নিজেই পাহারা দিতে থাকলেন।গ্রামের সহযোগী আন্দুল খালেককে বলা হয় সতর্ক দৃষ্টি রাখার কথা। দলতপতি গৌরাঙ্গ দেশি বয়সে বিস্রাম নিচ্ছেন।অবিরাম পরিশ্রম ওঁ একাধিক রাত জাগার ফলে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে।ঠিক এমন সময় খালেক খবর দেয় স্যার দক্ষিণ থেকে মনে হয় যেন একটা নৌকা আসছে।তখন দলনেতা স আরোও কয়েকজন দেখতে পেলো বিরাট একটি ছই বিহীন নৌকা(দাওয়াল) অনেকগুলো দাড়ি দাড় টেনে মুক্তুযোদ্ধাদের দিকে দ্রুত বেগে আসছে।অল্পক্ষনের মধ্যেই পরিস্কার হয়ে গেল।নৌকার যাত্রীরা সবাই খাকী পোষাকধারী ওঁ কালো পোষাকধারী পাক বাহিনীর সৈনিক। মুক্তিযোদ্ধারা প্রমাদ গুনল,তাদের হাতিয়ার নগন্য-সংখ্যাও অল্প।তবু তাদের আত্নরক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য আক্রমণ নয় আত্নরক্ষা।কিন্তু পাকসেনাদের লক্ষ্য বুঝা যাচ্ছে না।তারা কি এ পাড়ায় অবস্থান কারী মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে? তাতক্ষনিকভাবে দলপতির নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিল। সম্মুখ ভাগে একটি এস এল আর ওঁ আর একটি নিকট পাল্লার স্টেনগান, একজন গ্রেনেডধারী,অনান্যদের হাতে কিছু নেই।সিদ্ধান্ত হয় ৫০ গজের মধ্যে এলেই নৌকায় গুলি করা হবে যেন সীমিত হাতিয়ার ওঁ গুলির প্রতিটি কাজে লাগে।মুতকিযোদ্ধারা প্রস্তুত।এস এল আর সানু মিনার হাতে।তাঁর সহযোগীতায় ছিলো আনসার কমান্ডার আলী হায়দার।৫০গজ নয়,শ দেড়শ গজ দূরে থাকতেই নৌকা লক্ষ্য করে সানু মিয়া ব্রাস ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। অপর দিক থেকেও গুলি আসতে থাকে। এক পর্যায়ে এস এল আর নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আলী হায়দার তাঁর সিঙ্গেল শটের উপযুক্ত করে।উভয় দিক থেকে ২০/২৫ রাউন্ড গুলি বিনিময় হপ্য।হানাদাররা একজন আহত মাঝিকে সরিয়ে অস্ত্র ফেলে বাতাসের অনুকুলে নৌকাকে ঘুরিয়ে রেঞ্জের বাহিরে চলে যায় আরোও একটি গ্রাম আগুনে পোড়ার আশংকা দূর করতে মুক্তিযোডধারা তৎক্ষণাৎ রাজাবাজ ত্যাগ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কৌশল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয়,কেউ না মরে, সম্ভবব হলে অস্ত্র বিসর্জন না দিয়ে,কাউকে বা মেরা ধরে আনতে পারলে অথবা নিদেন পক্ষে শত্রুদের অস্ত্র করায়ত্ন করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধের অনুকূলে তা বিরাটসাফল্য বলে গন্য হবে। নভেম্বর মাসে সাচনা বাজারস্ত রাজাকার কোম্পানী কমান্ডার মঙ্গল প্রস্তাব পাঠায় যে,সে অস্ত্রসহ আত্নসমর্পণ করতে রাজি,যদি কমান্ডার গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশি নিজে নিরস্ত্র অবস্থায় রক্তী নদী সংলগ্ন ফুলবরী গ্রামে রাত একটার সময় যান। কথা অনুসারে গৌরাঙ্গ দেশী যান, এর পিছনে ছিল কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা। মঙ্গল তাঁর কথা অনুযায়ী অস্ত্রসহ আত্নসমর্পণ করে।মঙ্গল এর পর জানায় যে রাজাবাজের সংঘর্ষে পাকবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মারা যায়।মঙ্গল কোন রকমে বেঁচে ছিল।
[৯৪] মো আলী ইউনুছ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত