বানারীপাড়ার যুদ্ধ, বরিশাল
কাউখালী থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বানারীপাড়া থানা।বানারীপাড়া ও কাউখালী থানার মাঝে রয়েছে স্বরূপকাঠি থানা। এই থানা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বে প্রত্যন্ত বিল এলাকায় অবস্থিত আটঘর কুরিয়ানা ও আতাভিম্রুল গ্রাম। এই গ্রাম দুটিতে ‘হাইড আউট’ বা গোপন আস্তনায় আছে কামান্ডার হাবিব ও কমান্ডার পনার দল।দ’দুলই পরিকল্পনা করছে বানারীপাড়া থানা আক্রমনের/এর ফলে পরপর দ’বার আক্রমণ হয় বানারীপাড়া থানার উপর।প্রথম আক্রমণ কামান্ডার হাবিব আগস্ট মাসের প্রথম সাপ্তাহে তাঁর দল নিয়ে থানা আক্রমণ করে।বেলা তখন দশটা।থানার আউট পোস্টে আক্রমণ করলে পুলিশরা প্রচন্ডভাবে বাঁধা দেয়।পুলিশদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় মুক্তিযোদ্ধা হারুন।সে ছিলো ইপিআর এর সৈনিক। এরপর হারুন নামে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়।সে ছিলো পুলিশ সদস্য।চোখের সামনে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু দেখে কামান্ডার হাবিব আরো মরুয়া হয়ে যুদ্ধ করতে থাকে।যুদ্ধ্রত অবস্থায় এক পর্যায়ে তাঁরা পুরো থানা ঘিরে ফেলে। ধীরে ধীরে আক্রমনের তীব্রতা বাড়িয়ে হাবিবের দল থানা প্রায় দখল করে ফেলে। পুলিশরা যখন বেকায়দায় পড়ে যায় তখন তাঁরা হাত উচিয়ে আত্নসমরপন করে। হাবিব দখল করে বানারীপাড়া থানা।থানার ৪২জন পুলিশ বন্দী হয়থানার ওসিকে এবং তাঁর পরুবারকে ছেড়ে দেয়া হয়।যে ৪২ জন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্নসমর্পণ করেছিলো তাঁরা পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।দ্বিতীয় আক্রমণঃ প্রথম আক্রমণের পর আবার থানায় নতুন করে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়।এবার পুলিশ দলের সাথে যোগদান করে রাজাকার ও বদর বাহিনী। এরা সবাই ইস্ট পাকিস্থান সিভিল আর্মড ফোরসেস(ইপিকাপ) এর সদস্য।সব মিলে প্রায় ৮০ জনের মত একটি দল থানা রক্ষার্থে নিযুক্ত থাকে।বানারীপাড়া থানায় যে নতুন ওসি পোস্তিনফ নিয়ে এসেছে সে ছিলো মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক,সে নিজেই কামান্ডার পনার দলের সাথে লোক মারফৎ যোগাযোগ করে।কামান্ডার প্নার দল তখন তাঁর গোপন আশ্রয় প্রত্যন্ত এলাকা আটঘর কুরিয়ানাতে অবস্থান করছিল।ওসির সাথে প্ল্যান করা হয় যে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করলে ওসি তাঁর পুলিশ সহ দুই চারটা ফায়ার করবে।যেহেতু ওসি চাকরি করে তাই লোক দেখানোর জন্য এই ফায়ার করা হয়ে। এরপর সবাই আত্নসমর্পণ করবে।আটঘর কুরিয়ানা থেকে বানারীপাড়া পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য।নৌপথেই সহজ।বানারীপাড়া থানার পাশ ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে একেবেকে চলে গেছে একটি খাল।থানার উত্তর দক্ষিণে বয়ে চলেছে বানারীপাড়া নদী।কামান্ডার পনা প্ল্যান করে এই নদীপথেই তাঁর দল নিয়ে থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওণা দেয়।মসজিদে ফজরের আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করল,তারা চু চারটা গুলি করে থেমে গেল।কেননা কথা ছিলো পুলিশরা মাত্র দু একটা গুলি করেই স্যারেন্ডার করবে।কিন্তু বাস্তবে হিলো তাঁর উলটো।থানায় অবস্থিত রাজাকার ও বদর বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পালটা আক্রমণ চালায়।থানায় সেকেন্ড অফিসার ছিলো পাকিস্থানীদের দোসর।সে বদর বাইনী ও রাজাকারদের সমন্বয়ে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু করল।মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখল অবস্থা বেগতিক তখন তারাও সাঁড়াশী আক্রমণ চালাল।প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো দুপক্ষীর মধ্যে। থানার ভিতরে তখন চলছে হুড়োহুড়ি আর ডৌড়াদৌড়ি।খালের পাড়ের মুক্তিযোদ্ধারা খ্রলিং করে থানার ভেতরে ঢুকে পড়ল।শুরু হলো দুপক্ষের মরণপণ সম্মুখ ও হিতা হতের যুদ্ধ।সারাদিন এক্টে গেলো যুদ্ধে যুদ্ধে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়।মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রমের মুখে ধীরে ধীরে বদর বাহিনীর আক্রমণ স্তিমিত হয়ে এলো।এক পর্যায়ে তাঁরা স্যারেন্ডার করল।বন্দি হলো থানার সেকেন্ড অফিসারসহ সবাই।মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ফিরে গেল আটঘর কুরিয়ানা গোপন আশ্রয়ে।
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত