You dont have javascript enabled! Please enable it! বান্দরকাটা বিওপি আক্রমন, ময়মনসিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

বান্দরকাটা বিওপি আক্রমন, ময়মনসিংহ

ময়মনসিনহ জেলার সর্ব উত্তরে হালিয়াঘাট ও ধোবাউড়া থানার মধ্রবরতীস্থানে সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি বান্দরকাটা বিওপি’র অবস্থান।এই বিওপি থেকে দসশিক পশ্চিম হালিয়াঘাট থানার দূরত্ব ১০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ পূর্ব দিকে ধোবাউড়া থানা ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ী অঞ্চল ডালু সীমান্ত।আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে ঘোষগাঁও,ভূঁইয়াপাড়া,মেকীরকান্দী,বালিগাও,রাজিবপুর,গাজিরভিটা উল্লেখ্যযোগ্য।
এই এলাকা এবং বান্দরকাটা বিওপি’র সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ বুবস্থা ছিলো অত্যন্ত খারাপ।এই বিওপি’র সাথে কোনো পাকা রাস্থার সংযোগ ছিল না। একটি মাত্র কাঁচা রাস্তা বান্দরকাটা বিএপি থেকে ধোবাউড়া সড়কে এসে মিশেছে।বান্দরকাটা বিওপি’র বিপরীত দিকে ভারতীয় সীমান্ত থেকে কৌণিক অবস্থানে বাংলাদেসজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় ভারতীয় সীমান্ত থেকে বিওপি’র দূরত্ব খুব সামান্য।ভারতের অভ্যন্তর থেকে দুটি ছোট পাহাড়ী নদী বান্দরকাটা বিওপি’র দুপাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।বান্দরকাটা বিওপি অবস্থান সমতল ভূমিতে। অপরদিকে সীমান্ত পার হলেই ভারতের পাহাড়ি এলাকা।এই এলাকার অধিবাসীরা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ,গরিব এবং কৃষিজীবী।
বান্দরকাটা বিওপি’র অবস্থান ছিল পাকবাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর অপারেশনাল এলাকায়.৭৯ উইং রেঞ্জার্স এই সময় ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।বান্দরকাটা বিওপিতে ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্যের অবস্থান। এই প্লাটুনের কোম্পানি সদর দপত ছিল হালুয়াঘাট এলাকায়।এই বিওপি’তে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ছিল এক প্লাটুন রাজাকার।
মে মাস থেকে হালুয়াঘাট থানা অঞ্চলে পালবাহিনী সীমান্ত ফাড়িগুলোকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। আগস্ট মাস নাগাদ পাকবাহিনী বান্দরকাটা বিওপি’র ঘাটিটি সুসঙ্ঘত ক সুরক্ষিত করে তোলে/জুলাই মাসে প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেহসের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য পাকিস্থানী সেনাবাহিনী এবং এর সহযোগী রাজাকার বাহিনীও এই এলাকায় টহল দিতে শুরু করে।এই সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক চলাচলের অসুবিধার সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে যুদ্ধের কোশলগত কারণে বিওপটি শত্রুমুক্ত করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে।
১১ নম্বর সেক্টরের অধীরে ভারতের মেঘালয় রাজের ডালু এলাকায় ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান।ডালু ছিল এই সেক্টরের একটি সাব সেক্টর।মুক্তিবাহিনীর কোন সামরিক অফিসার না থাকায় ময়মনসিংহের যুবলীগ নেতা আবুল হাসেম মেদিকেল কলেজের ছত্র ডা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ,নাজমুল আহসান,নাজমুল হক তারা,তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুসহ বেশ কয়েক জন ছাত্র নেতা দায়িত্ব নিয়ে এই সাব সেক্টর গঠন করেন।এই সময় পর্যন্ত এই সাবসেক্টরে কয়েকজন পুলিশ এবং ইপিআর সৈনিক ব্যতীত সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনো সদস্য ছিল না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দু’জন কমান্ডারের নেতৃত্ব মুক্তিবাহিনী বরাকঝিরি নদি অতিক্রম করে শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়।হাবিলদার জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দলটি সঠিক সময়ে বিওপি’র সম্মুখ ভাগে পূর্বদিকে অবস্থান গ্রহণ করে।আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের দলের সদস্যরা নদীর প্রবল স্রোতের কারণে নদী অতিক্রম করে সময়মত পূর্ব পাড়ে পৌছাতে পারেনি,যার ফিকে আবুল হাসেমের নেতৃত্বাধীন দলটি দু’ভাগে বিভিক্ত হয়ে পড়ে/আবুল হাসেমসহ দলের বেশিরভাগ সদস্য নদী অতিক্রম করে সামান্য দেরীতে হলেও শক্ত অবস্থানের সম্মুখে পজিশন নিতে সক্ষম হয়।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমঙ্কারী দলট রওানা দেয়ার পর পরই বৃষ্টি শুরু হয়।এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শরতুর বাঙ্কারের কাছাকাছি পৌছাতেও তেমন অসুবিধা হয় নি এবং বৃষ্টির শব্দের কারণে পাকবাহিনীর পক্ষেও মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন ও অবস্থান নির্ণয় সম্ভব হয় নি।যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীদের নির্দেশ মত রাত ৩টার পূরবেই অভিযানে অংশগ্রহনকারী সকল যোদ্ধা পূর্ব নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।ঠিক রাত ৩টার সময় ভারতের তেরিখালো বিএসএফ অবস্থান থেকে বানদ্রকাটা বিওপি’র উপর আটিলারী ফায়ার শুরু হয়।
আটিলারীর গোলাবর্ষণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন ছেলেরা উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।হটাৎ প্রচন্ড গুলাগুলির শুরু হলে পাকবাহিনী হচকচিত হয়ে যায় এবং তড়িত গতিতে পালটা গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে নদীর তীর ছেড়ে এগিয়ে খোলা স্থানের মধ্যদিয়ে শত্রুর উপর গুলি চালাতে থাকে।অনেক দৌড়ে বিওপি’র দিকে অগ্রসর হয়।
পশ্চিমদিকে অবস্থানরত আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দল শত্রুর ১নং এবং ৫নং বাঙ্কার দুটি দখল করে নেয়। এ সময় হটাৎ বিওপি’র দক্ষিণে অবস্থিত দুটি বাঙ্কার থেকে অজস্র মেশিনগানের গুলি আসতে থাকে।ফলে যুদ্ধ্রত বেশ কয়েকজন যোদ্ধা আহত হন এবং তাঁরা কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।এই পর্যায়ে কমান্ডার আবুল হাশেমের পক্ষে অগরসর হওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে।তিনি বুঝতে পারেন যে আর অগ্রসর হয়েও বিওপি দখল নেয়া সম্ভব নয়।সেই সময় তিনি তাঁর সাথে রক্ষিত সিগন্যাল পিস্তল দিয়ে ফায়ার করে সহযোদ্ধাদের পিছিয়ে আসার সংকেত দেন।
নির্ধারিত সংকেত পেয়ে ভারতীয় অবস্থান থেকে পুনরায় আটিলারি সাপোর্ট শুরু হলে মুক্তিবাহিনীর রফিক উদ্দিনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। পূর্ব ও পশ্চিমে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর দুটি দলকে প্রত্যাহারের সুযোগ করে দেয়ার জন্য উত্তর দিকে অবস্থাঙ্কারি হাবিলদার জিয়া উদ্দিনিয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনীর উপর এই সময় গুলিবর্ষণ করতে থাকে।অবস্থাঙ্গত বিচারে উত্তর দিকে অবস্থানকারী দলটি একটু সুনিধাজনক অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব এবং পশ্চিম অংশে উভয় দল পিছিয়ে সীমান্ত বরাবর এসে উঁচু কয়েকটি পাহাড়ের উপর অবস্থান নিয়ে শত্র্য বাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে।একইসাথে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আটিলারি ফায়ার চলতে থাকে।এই আক্রমণের মধ্যে সকালের আলো ফুটে ওঠে।পাকিস্থানী সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবরষনের পালটা জবাব দিতে চেষ্টা করে।হটাৎ আটিলারির একটি গোলা বিওপি’র অভ্যন্তরে টিনশেডের মূল ঘটির উপর আঘাত হানে।এই গোলার আঘাতে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত এবং আহত হয়।মুক্তিবাহিনীর আটিলারি ফায়ারে টিকে থাকা সম্ভন নয় ভেবে পাকবাহিনীরা বিওপি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিকাল তিনটার মধ্যে তাঁরা বিওপি ছেড়ে ৩০০-৪০০ গজ পেছনে নদী পার হয়ে নতুন একটি অবস্থানে চলেযেতে থাকে।
বানদকাটা বিওপি আক্রমণের সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করলে দু একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমতঃ অবস্থাগত দিক থেকে এলাকাটি ছিলো অনেকটা দুর্গম স্থানে।যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দূরবল।মূল রাস্থার সাথে এই স্থানের কোন পাকা সংযোগ সড়ক ছিল না।
দ্বিতীয়তঃ মুক্তিবাহিনী যখন আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে পাহাড়ের উপর আত্ন্রক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে গুলি চালাতে থাকে তখনই পাকবাহিনী ভয়ে তাদের অবস্থান ত্যাগ করে।এ থেকে এটা প্রমাণিত যে,পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ভয়ে কর্মে ক্রমে ভিত সস্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।সর্বশেষ লক্ষনীয় বিষয়টি হল পাকিস্থানী বাহিনীর বিচ্ছিন্ন অবস্থান।এক দিকে যেমন এদেশের মানুষ থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিচ্চিন্ন ছিল,তেমনি তাদের নেজেদের মাঝেও পারস্পরিক বিচ্চিন্নতার বিষয়টি কাজ করছিল।বান্দরকাটা বিওপি আক্রান্ত হলে দুর্গম অবস্থান এবং খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পাকবাহিনী কোন প্রকার রি-ইনফোরসমেন্ট করতে পারে নি।ফলে পরস্থিতি তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
বান্দরকাটা বিওপি আক্রমে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাঃএ কে এম মতিউর রহমান,ইব্রাহিম খলিল,এ কে এম ফজলুল হক, মোজাহিদ খান,মোজাফফর আহমদ,আবুল কাশেম খান,পুলিশ সুবেদার মাহতাব উদ্দিন খান,আবদুর রশিদ,আবুল হাশেম,সেলিম সাজ্জাদ,সামছুল হক বাদক, রবার্ট সরকার,আবদুর রশিদ,কে এম শাহাব উদ্দিন,কে এম হারেছ উদ্দিন,আনিসুজ্জামান,তালেব হোসেন,আবদুল হামিদ,আবুল হাশেম,সিরাজুল ইসলাম,আবদুস সামাদ,রিয়াজ উদ্দিন,মকবুল হোসেন,আবদুর রহিম ইয়াসিন আলী,আবদুল আজিজ,গোলাম মোস্তফা,আমান উল্লাহ,নুরুল ইসলাম বাদ,নেকবর আলী খান, ফজলুল করিম,জয়নাল আবেদীন,অনিল সাংমা,বজলুর রহমান,দেবেশ মারাক,আনোয়ার হোসেন,আবদুল হালিম,উইলিয়াম মোরং,জয়নাল আবেদীন,আব্দুল গনি,জামাল উদ্দিন,নজরুল সিলাম,সোহরাব আলী,আবুল কালাম আজাদ,পলেন সাংমা,আনিদ্র্য সাংমা,এখলাছ উদ্দিন,লাল মিয়া,এরশাদ,গিয়াস উদ্দিন ,আব্দুল মান্নান,কামাল হোসেন,আব্দুল আজিজ,মিয়া হোসেন,নুরুল ইসলাম,আব্দুল মোতালেব,কাজেম উদ্দিন,মোরশেদ আলম,প্রদীপ সাংমা,আহির উদ্দিন,ওমর আলী,আব্দুল আলী, কারনেশ রসিল,আবুল হোসেন,হোসেন আলী,তোফাজ্জল হোসেন, আমানুল্লাহ,প্রদীপ তজু, দেবতোষ মারাক,হরমুজ আলী,রাকেশ সাংমা,মানুএল চিগি চাক,শাহীনাথ পাথাং,সুখেন সাংমা,আলী হোসেন,আবদুল হক, চৌধুরী,আবদুর রশিদ,জিয়া উদ্দিন,বাদশা মিয়া,সুশীল,রনজিৎ কান্তি মারাক,হানিফ উদ্দিন,আব্দুর রহমান,আবদুল হাকিম,আব্দুল খালেক,পশর উদ্দিন,আলী নেওয়াজ,সামসুদ্দিন,আবদুল খালে,মীর ইব্রাহিম,আব্দুর রহমান,সামছুল হক,ফকর উদ্দিন,শুকর আলী,উমর আলী,হাছেন আলী,ফরজ আলী,সারভেন মুরাং,গোলাপ হোসেন,কামাল উদ্দিন,গিয়াস উদ্দিন,মমতাজুর রহমান খান,সুলতান আহমদ,সালাহউদ্দিন,দুলাল মিয়া,সুজিত সাংমা,নবী হোসেন,বদিউল আলম রতন,বিমল চন্দ্র পাল। বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণকারী শহূদ মুক্তিযোদ্ধাঃ আব্দুস সালাম,আমীর হোসেন,আবদুল আজজ, হাকিম মোল্লা,রফিক উদ্দিন ভুইয়া,নীগিথ রিংথেং,রফিক,দিপক সাংমা,সামাদ প্রমুখ।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত