You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাবাজার (টন্নির হাট) যুদ্ধ, ভোলা

বাংলাবাজারের পূর্ব নাম টন্নির হাট।এখানে মোহাম্মদ টন্নি নামের একজন প্রভাবশালী লোক বাস করতেন ,তাঁর নামেই হাটের নামকরন হয় টন্নির হাট। কিন্তু দুর্ভাগ্য লোকটির মেধা বা শক্তি দেশের স্বাধীকারের স্বারথে কাজে লাগেনি। লেগেছে ক্ষতির কাজে। বাংলাবাজারের যুদ্ধের যে অপূরনীড় ক্ষতি হয়,সেটা হয় এই রাজাকার কামান্ডার মোহাম্মদ টন্নির জন্যই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত থেকে যুদ্ধ শুরু হলেও ভোলায় তাঁর প্রভাব পড়ে অনেক পরে।কারণ ভোলা একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে এখানে পাকবাহিনী আসে অনেক দেরীতে।তাদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এ জেলায় বিভিন্ন স্কুলের মাঠে প্রকাশ্যেই চলতে থাকে পাকিস্থান বিরোধী কার্যক্রম।বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুলের মাঠে বা বাড়ির প্রশস্থ উঠোনে চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ। ভোলায় পাক বাহিনী আসার পরও কিছু রাজাকার ও গুতিকতক পুলিশের তৎপরতা ছাড়া তেমন কিছুই পরিলক্ষিত হয়নি।তখন বলতে গেলে স্থানীয় প্রশাসনও পরোক্ষভাবে দেশ স্বাধীনের পক্ষেই ছিলো।তবে,হ্যা পাকআর্মি ভোলায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। কিন্তু দিন যতইন যেতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে স্থানীয় যোদ্ধাদের শক্তি ও মনোবল আরোও বৃদ্ধি পায়। অক্টবর মাস নাগাদ বলতে গেলে ভোলার পাক বাহিনীর তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড ভোলা শহরের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে। এর কারণে ভোলার অনতিদূরে ঘুঙ্গারহাটে ছিলো দশটি বাংকার এবং বাংলা বাজারে ছিলো ৭৭টি বাংকার।এই বাংকার গুলোতে সর্বক্ষণের জন্য পাঁচজন,ছয়জন করে মুক্তিযোদ্ধা পাহারায় থাকতো।পাক বাহিনীর গতি ছিলো দক্ষিণ দিকে মুখ করা।যাতে পাক আর্মির গাড়ির পাকা সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে গমন করলেই তারা পথিমধ্যে হামলা চালিয়ে তাঁদের গতি থামিয়ে দিতে পারে। আর এখানে গনি থামানো মানে পুরো জেলার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। বাংলাবাজারে যে ৭৭টি বাংকার ছিলো তাঁর ৩০টাই ছিলো মূল সড়কের পাশে। পূর্ব দিকের রাস্থায় ছিলো ২৫টি,দক্ষিণ দিকের রাস্থায় ছিলো ১০টি আর পশ্চিম দিকের রাস্থায় ছিলো ১২টি।তবে তখন একটি মাত্র সড়ক ছাড়া সকল রাস্থাই ছিলো কাঁচা।এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধারণা করা হতী পাক আর্মি এলে সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে উত্তর দিক থেকেই আসবে।অবশ্য ক’দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিলো পাক আর্মি যেকোনো মুহূর্তে হামলা চালাতে পারে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধারাও বাংলাবাজার এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় আগে থেকে যুদ্ধের জন্য তৈরী ছিলো এবং কথা ছিলো তাঁদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বরিশাল থেকে মুক্তিযুদ্ধা কুদ্দুস মোল্লার নেতৃত্বে আরেকটি শক্তিশালী গ্রুপ এসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিবে। কিন্তু রাজাকার কামান্ডার মোহাম্মদ টন্নি ও তোফাজ্জল দফাদার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের রণ প্রস্থুতি ও কুদ্দুশ মোল্লার কথা পাক আর্মিদের জানিয়ে দেয়। ফলে তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্থা করার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্থুত হতে থাকে.২৭ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টার দিকে মোহাম্মদ টন্নি ও মকবুল কামান্ডারের নেতৃত্বে খেয়াঘাট হয়ে পাক বাহিনী লঞ্চযোগে বাঘমারা আসে।আরেকটি দল কমরুদ্দি হয়ে ঘুইঙ্গার হাট চলে যায়।বাংলাবাজারে যে দলটি আসে তারা রাত অনুমানিক তিনটার দিকে অতর্কিতে হামলা চালায়। পাকা আরমিকে সহযোগিতা করে স্থানীয় রাজাকাররা।তাদের জানা ছিলো বাংকারের অবস্থান।ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা অতর্কিত হামলার শিকার হয়। পাক আর্মি বাঙ্কারে গিয়ে বেয়নেট চার্জ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল বাংলাবাজারে কাজ করত।একটি দল ছিলো কামান্ডার কাঞ্চন মিয়ার নেত্রৃত্বে,দক্ষিণের দলটি ছিলো কামান্ডার হযরত আলীর নেতৃত্বে আর পশ্চিম দিকের দল ছিল সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকের নেতৃত্বে।তখন ছিলো রোজার মাস। লোকজন কেউ সেহরী খাবার জন্য উঠেছে,কেউ উঠবে,কেউবা এলোমেলো পায়চারী করছিলো।ঠিক এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় তারা হামলার শিকার হলে মুক্তিযুদ্ধাদের শক্তিশালি ঘাঁটি বাংলাবাজার অল্পক্ষণের মধ্যেই তছনছ হয়ে যায়।তাছাড়া পাক আর্মির হাতেছিলো সর্বাধুনিক অস্র আর মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে ছিলো থ্রী নট থ্রী রাইফেল ও কিছু হাত বোমা,তাও তারা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।যখন মুক্তিদোদ্ধাদেরা একতরফাভাবে মার খাচ্ছিলো,তখন স্থানীয় কামান্ডার কাঞ্চন মিয়া ইশারা দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান ছেড়ে চলে যাবার জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর সিগনাল পেয়ে দ্রুত সরে যাবার চেষ্টা করে।কিন্তু যারা বাঙ্কারে ছিলো তাঁদের বেশির ভাগই শাহাদত বরণ করে।সে রাতে পাক আর্মির অতর্কিত হামলায় শহীদ হয় ৬০জন মুক্তিযোদ্ধা,আর সাধারণ মানুষ নিহত হয় প্রায় একশ জনের কাছাকাছি।এই যুদ্ধের পর কিছুদিনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহব্বল হয়ে পড়ে।অবশ্য অল্প দিনেই তারা পুনরায় একত্রিত হয় এবং পাক আর্মির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
[৩৭] কালাম ফয়েজী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!