বাঁকার যুদ্ধ, খুলনা
বোয়ালিয়ার যুদ্ধে রাজাকাররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলেও এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা ব্যাপকভাবে প্রশ্তুতি নিয়ে পাক সেনাদের সহযোগীতায় ১৯ সেপ্টেম্বর বাঁকা ক্যাম্পের বিরোদ্ধে অভিযান চালায়। রাজাকার ও পাক সেনারা কপিলমুনি ক্যাম্প থেকে একটি গানবোট ও একটি লঞ্চ যোগে বেলা ১২টার দিকে বোয়ালিয়া ঘাটে আসে। তখন কপোতাক্ষ নদ জোয়ারের পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো। গানবোট ও লঞ্চের ছাদ থেকে নদীর দু’ধারে অনেক দূর পর্যন্ত লঞ্চে অবস্থানরত রাজাকার ও পাকসেনাদের নজরে আসে।অন্যদিকে বাঁকার কামান্ডার ইতোমধ্যে শ্রীকন্ডপুরের গফুর সরদার নামক জনৈক ব্যাক্তির মাধ্যমে গোপনে তাদের এ অভিযানের কথা জানতে পেরে তাৎক্ষনিক সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি নদীর ঘাটে এসে যুদ্ধের প্রস্থুতি গ্রহণ করেন। কামান্ডার তাঁর বাহিনীকে কয়েকটি দলে ভাগ করে বিভিন্ন পজিশনে পাঠান।এদের একটি দল নদীর চরে শ্মশান ঘাটে পজিশন নেয়।ঘাটের কাছে বিশ্বাসের বাড়ির পাশে অবস্থান নেয় কামান্ডার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন একটি দল এবং একটি অগ্রগামী দল অবস্থান নেয় জাহান বক্স গাজির বাড়ির নিকট।মুক্তিযোদ্ধাদের অস্র ছিলো ৭টি ৩০৩ রাইফেল ও ১টি এসএলআর।এভাবে পাকিস্থানী বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের ব্যাপক প্রস্ততি সহকারে আকস্মিক উপস্থিতি এবং তা প্রতিরোধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তাৎক্ষণিক অবস্থান গ্রহণ এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।হানাদার বাহীনী ঘাটে পৌছার সাথে সাথ চারিদিকে বেপোরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে।মুতকিযোদ্ধারাও উত্তর দেয়। কিন্তু প্রতিপক্ষের মেশিনগানসহ উন্নতর অস্রশস্রের সম্মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে পারেনি।উপরস্ত জোয়ারের পানিতে নদী ভরা থাকায় শত্রুদের গানবোট ও লঞ্চ থেকে তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসমূহ সহজে দেয়া যায়।ফলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পশ্চাদসরন করতে বাধ্য হয়।কিন্তু আশেপাশের তেমন কোনো নিরাপদ স্থানে না থাকায় তারা নিকটস্থ ধানক্ষেত,বাড়ির বাগান,পুকুর বিভিন্ন স্থানে দ্রুত আশ্রয় নেয়।যা আক্রমনকারীর অনেকটা নাগালের মধ্যেই ছিলো।ফলে পাকসেনা ও রাজাকাররা দ্রুত নেমে পড়ে এবং ধানক্ষেত ও আশেপাশের বাগানে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন শীকন্ডপুরের কামরুল ইসলাম,বাঁকার এনায়েত আলী মোড়ল এবং ভবানী পুরের শংকর কুমার অধিকারী। কমান্ডর আবুল কালামসহ কয়েকজন একটি পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে মাথা গুজে ঘন্টাখানেক লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে যান।শত্রুরা পুকুরের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়লেও তারা অক্ষত থাকেন।এরপর পাকসেনারা বাঁকা ক্যাম্প ভস্মিভূত করে দেয় এবং আব্দুল মালেক মোড়ল,আইনউদ্দিন গাজি,মো জমির আলী ও আবু তালেবকে ধরে নিয়ে যায়।এদের মধ্যে মো জমির আলী লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বাকি তিন জনের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।কামান্ডার আব্দুল কালামের মতে,ইদ্রিস নামক মুক্তিযোদ্ধাও ধরা পরে এবং সেও লঞ্চ থেকে পালাতে সক্ষম হয়।মারাত্নক আহত টি এ বি ছিদ্দিককে চিকিৎসার জন্য ভারতে প্রেরণ করা হয়। তিনি পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন।বাঁকার যুদ্ধে খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।এতে মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হলেও তারা এক শক্তিশালি বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে এলাকাবাসিকে রক্ষা করার জন্যে এক দুঃসাহসিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বীরত্বের পরিচয় দেয়।এখানে বাংকারসহ সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে হয়তী ফলাফল বোয়ালিয়া যুদ্ধের ন্যায় হত। কিন্তু প্প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলার সুযোগ না পাওয়ায় তারা অসহায় হয়ে পড়ে এবং দ্রুত পশ্চাদসরণ করতে ব্যর্থ হয়।তবে প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরি না করে এভাবে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়ার ভুল থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বাস্তব শিক্ষা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এ শিক্ষা কাজে লাগায়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত