বাগাতীপাড়ার যুদ্ধ, নাটোর
নাটোরে সংগটিত খন্ডযুদ্ধসমূহের ধারাবাহিকতায় যখন পাকবাহিনী রাজশাহী এবং তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহের তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে নাটোর জেলার পাশ দিয়ে যেতে থাকে তখনই স্থানীঊ মুক্তিবাহিনী এবং সাধারণ জনগন তাদের সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্থানীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।সেদিনের সেই মুক্তি পাগল দুঃসাহসী নাটরবাসী হত্যা করেছিলো অনেক পাকিস্থানিকে এবং ছিনিয়ে এনেছিলো তাদের অস্র,গোলাবারুদসহ যাবতীয় সকল সামগ্রী।তারই পেরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্থানীরা নাটরের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় বাগাতিপাড়ায়্ব চালিয়েছিলো নারকীয় তান্ডবলীলা। নাটরে পাকিস্থানীদের ওপর বাঙ্গালিদের যাবতীয় আচমকা আক্রমন প্রতিরোধ করতে এবং অত্র অঞ্চলের তাদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই দয়ারামপুরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে।মূলত এখান থেকে অত্র অঞ্চলে শুরু হয় পরবর্তী সকল কার্যক্রম। পাকিস্থানীরা তাদের স্থানী দালালদের সহায়তায় বাগাতীপাড়ায় একের পর এক বর্বর হত্যাকান্ড,লুন্টন ও গণধর্ষণশ নানা রকমের অপকর্ম চালাতে থাকে। স্থানীয় জনগন যখন পাকিস্থানীদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিলো তখনই স্থানীয় মুক্তিবাহিনীরা নৈতিকতার বিবেচনায় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় পাকিস্থানীদের উক্ত অঞ্চল থেকে তাড়ানোর। তারই সুত্র ধরে কোনো এক হাটের দিনে আচমকা মুক্তিবাহীনিরা অত্যান্ত সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিতভাবে পাকিস্থানী ক্যাম্পে আক্রমণ করে এবং অনেক রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে।১৯৭১সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণার পর বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় নাটোরেও গটিত হয় মুক্তিযোদ্ধা সংরাম পরিষদ। এই সংগ্রাম পরিষদ ততকালীন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক,প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত আনসার ও উৎসাহিত যুবকদের স্থানীয় ভাবে রাইফেল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হানাদার বাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি দল রাজশাহী সেনানিবাস অভিমুখে যাত্রা করে বাগাতিপাড়া থানার অন্তর্বর্তী বড়াল নদীর তীর দিয়ে লোকমানপুর রেলস্টেশনের পথে যাওয়ার সময় গালিমপুর বিলেয়ার কাছে মুক্তিধুদ্ধাদের সরাসরি আক্রমণের মুখে পতিত হয়। উক্তি আক্রমণের মুখে আলবদর রাজাকার সহ হানাদার বাহিনীর চারজন সদ্য পালিয়ে যায়ার সময় গালিমপুর সমজিদের নিকটে ধরা পড়ে এবং তাদের সেখানে হত্যা করা হয়।পাখানাদারদের গণকবর বাগাতিপাড়া থানার পশ্চিম পাশে নদীর অপর প্রান্তে অবস্থিত। গালিমপুর বিলের আক্রমণে পশ্চাদসরন কয়েকজন পাকসেনা অত্র থানার জামনগর ইউনিয়নের স্বাধীনতা কামী জনতার হাতে ধৃত ও নিহত হয়। পরবর্তীতে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে স্থানীয় দালাওদের সহায়তায় বাগাতিপাড়া থানায় রাজাকারদের নিয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাপ স্থাপন করে। যার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় বর্তমানে কাদিরাবাদ সেনানিবাস সংলগ্ন দয়ারামপুর বাজারে।উক্ত ক্যম্পে রাজাক্রদের অত্যাচারে অতিষ্ট বাঙ্গালিরা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জানালে কাজিপাড়া(ভারত) অপারেশনাল ক্যাম্পের তত্বাবদানে নাটোর এলাকার মুক্তিযুদ্ধাদের একটি দল সম্ভবত ২২ সেপ্টেম্বর কোন এক হাটের দিনে পাকবাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে আচককা আক্রমণ করে দখল ও ভস্মীভূত করে।উক্ত আক্রমণে কয়েকজন মুক্তিসেনা আহত হলেও কেউ মারা যায় নি।ইশ্বরদীতে অবাঙ্গালিদের(বিহারী) আবাসস্থল ও রেলওয়ে জংশন ছিল। সেখান থেকে পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের মাধ্যমে পাকহানাদারদের চলাচল ও রশদ সরবরাহ হত।এই সরবরাহ বন্ধ করতে অক্টোবরের প্রথম সাপ্তাহে অত্র থানার প্রবেশ পথে মাড়িয়ার নেংটি পাড়া নামক স্থানে স্থলমাইন দ্বারা ইশ্বরদী হতে রাজশালীগামী হানাদার বাহিনী বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়া হয়।এতে রেললাইন সহ চারটি বগি বিদ্ধস্ত হয় এবং অনেক পাকবাহিনীর সদস্য হতাহত হয়। প্রতিশোধের আগুনে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে যায়। তাঁরা মাড়িয়া গ্রামে আচমকা আক্রমণ চালায় কিন্তু সেখানে কোনো মানুষকে না পেয়ে শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উক্তগ্রামকে নিশ্চিন্ন করে দেয়। সান্তাহার অবাঙালিদের বিশাল আবাস্থলে হানাদার এবং তাদের স্থানীয় দোসরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধুয়াউড়া ব্রিজে আক্রমণ করা হয়। এতে ব্রিজের আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সাপ্তাহে ন্বসেরা গ্রামের কলকুটি নামক স্থানে ইংরেজদের এক পরিত্যক্ত বাড়ির পাকবাহিনী পরবতীতে তাদের আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। যেখান থেকে বাগাতীপাড়া ব্যাপক আক্রমণের প্রস্ততিকালে ১০ ডিসেম্বর আচমকা মুক্তিবাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে পাক হানাদাররা দিশেহারা হয়ে থানায় আশ্রয় নেয়। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী থানা আক্রমণ করলে পাক হানাদার বাহিনী কিছু মালামাল ও রসদ রেখে নাটোর সদরে পলায়ন করে। ১৪ ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলা পতাকা থানায় উত্তোলনের মাধ্যমে বাগাতীপাড়া থানা পাক হানাদারদের দখলমুক্ত হয়।
[৫৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত