You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.12 | বল্লা যুদ্ধ, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

বল্লা যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার দক্ষিণ-পূর্বে একটি গ্রাম বল্লা। কালিহাতি থেকে একটি কাঁচা রাস্তা বল্লা পর্যন্ত গেছে। ১২ জুন, কাদের সিদ্দিকী জানতে পারেন, কালিহাতি থেকে শক্র বল্লার রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। খবর পাওয়া গেছে সকাল আটটায় তারা হাঁটা শুরু করেছে। সম্ভবত এখন শক্র পাছচাড়ানোর কাছাকাছি এসে গেছে। এমন সময় অগ্রবর্তী ঘাঁটি থেকেও কাদের সিদ্দিকীকে টেলিফোনে জানানো হয় শক্র কালিহাতি থেকে বল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সর্বত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে খবর পাঠানো হয়। কমান্ডার ফজলুল রহমান, লাবিবুর ও অফিসার তাদের কোম্পানি নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর জন্য গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে। কাদের সিদ্দিকী তাদের কাছে পৌছেই ফজলুর রহমানকে বলেন, সহযোদ্ধাদের বল্লা গ্রামের দক্ষিণে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে সে যেন শুধু ১০/১২ নন নিয়ে অপেক্ষা করে। লাবিব ও আফসার দুজন করে সহযোদ্ধা নিয়ে কাদের সিদ্দিকীকে অনুসরণ করতে বলে ও ফজলুকে নির্দেশ দেয়া হয়, তার পুরো দলকে বাজারের দক্ষিণে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে। এ সময় চাড়ানের দিক থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর সামনে এসে হাজির হয়। তাদেরকেও বল্লা গ্রামের দক্ষিণে নিরাপদ জায়গায় অপেক্ষা কর‍তে বলা হয়। কাদের সিদ্দিকী তার ২০ জন যোদ্ধা নিয়ে নদীর অপর পারে প্রায় দেড় মেইল এলাকা জুড়ে ওঁৎ পেতে বসে থাকেন। কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন না হওয়ায় শক্র দুটি নৌকা নিয়ে নদী পার হতে থাকে আর গুলিবর্ষণ করে তাদের যাত্রাপথে আচ্ছাদন সৃষ্টি করে। এমনি করে নৌকা দুটি যখন নদীর মধ্যস্থলে এসে পৌছায়, তখনো কোনো গুলির শব্দ মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে না আসায় ওরা নিশ্চিন্তে পারের কাছাকাছি এসে যায়। অমনি বজ্রের গর্জনে গর্জে উঠে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কের হাতের হাল্কা মেশিনগান। সঙ্গে সঙ্গে দুটি নৌকাই ডুবে যায়। তারপর শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। কাদের সিদ্দিকী মাত্র একটি এলএমজি সম্বল করে একবার ডাইনে, একবার বামে সরে গিয়ে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে, আর দূরে গাছের মাথায় বসে আলম ও কাসেম অবজারভেশন পোস্ট থেকে সঙ্কেত দেয়। শক্রর একটি মেশিনগান কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে, লক্ষ্য এড়ানোর জন্য বার বার স্থান পরিবর্তন করেন তিনি। প্রথম চোটে শক্রর দুটি নৌকাডুবি হওয়ায় তাদের মনোবল যথেষ্ট ভেঙ্গে যায়। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে এক পর্যায়ে ৪ জন শক্র নিহত হয়। নদীতে ডুবে অপর কয়েকজনও মারা যায়। এপর্যায়ে শক্র অবস্থা বেগতিক বুঝে উত্তর দিকে পিছু হটতে শুরু করে। শক্রর ৪টি লাশ উদ্ধারের জন্য কাদের সিদ্দিকী নির্দেশ দেয় দুজন দুঃসাহসিক তরুণ সবুর ও মালেককে। ওরা দুজন এগিয়ে চলে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। তারা কখনো ডুবে, কখনো ভেসে সাতরিয়ে চলে। ওদের রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনী কভারিং ফায়ার করে। এই গুলিবর্ষণ ও পাল্টা গুলিবর্ষণের মধ্যে সবুর ও মালেক পারে গিয়ে লাশের দিকে অগ্রসর হলে শক্ররা আতঙ্কে যুদ্ধ ত্যা করে পালিয়ে যায়। পাঁচ ঘন্টাব্যাপী এই যুদ্ধে শক্র পর্যুদস্ত হয়ে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যায়। বল্লার যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানীরা এ আলাক্য তেমন বাধা পায়নি। ছোটখাটো ঝুকি ও বাধার সম্মুখীন হলেও তা তারা অনায়াসেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। জনতার মধ্যে একটা বিশ্বাস বদ্ধমুল হয়েছিল যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুর্জয়, অজেয়। বিশ্বের কোনো শক্তিই তাদের পরাজিত বা পর্যুদস্ত করতে পারবে না। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ধাবমান নির্বোধ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের নেতা বজ্র (কাদের সিদ্দিকীর ডাক নাম) সম্পর্কে অনেকে সেদিন ব্যাঙ্গোক্তি করেছে। বলাই বাহুল্য, তাদের এ উক্তি ছিল খুবই সরল, স্বাভাবিক ও আন্তরিক। এতে ঘৃণা, হিংসা বা বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না। কিন্ত বল্লার যুদ্ধে পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে এতই ভীতি ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে, মৃতদেহ ও অস্ত্রগুলো পর্যন্ত কুড়িয়ে নিতে সাহস করেনি। তারা কোনোভাবে পালিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করে। শক্র প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, লাশ ও অস্ত্র-সংগ্রহে সাহসের অভাব, সর্বোপরি পরাজয় বরণ করে পলায়ন ইত্যাদি ঘটনা জনতার পূর্ব-বিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তাদের এতদিনের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলে। জনতার চিন্তা ও বিশ্বাসে শুরু হয় বৈপ্লবিক। শক্র যে অজেয় নয় এটা তারা বুঝতে ও দেখতে পায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ অর্থাৎ যুদ্ধজয় দেখে জনতা চিন্তাধারাও পাল্টাতে শুরু করে। বল্লার যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর উপর জনতার যে আস্থা আসে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল। উদ্ধারকৃত শক্রর লাশের চারপাশে যখন জনতার ভিড় তখন কয়েকজন উৎসাহী যুবক ও দশ-বারোজন মুক্তিযোদ্ধাকে দুটি করে কলাগাছ দিয়ে চারটি ভেলা বানিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল। জনতার লাশ দেখা শেষ। অন্যদিকে কলাগাছের ভেলা তৈরি। মৃতদেহগুলো যত্রতত্র পড়ে রয়েছে। অসংখ্য মানুষের আনাগোনা ও চলাফেরার ফলে লাশগুলো ধূলিতে একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে সাপে-কাটা রোগীদের কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার একটি রীতি আছে। গ্রামকে-গ্রাম যখন কলেরা বা ওলাওঠায় নিষ্প্রাণ, উজাড় হয়ে যেত তখন কবরে বা শ্মশানঘাটে বয়ে নেবার লোকেরা অভাবে মৃতদেহগুলো কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হতো। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে প্রাচীন প্রথার আশ্রয় নেয়। সামরিক পোশাকে চারটি লাশ কলাগাছের ভেলার উপর শক্ত করে বেঁধে ভাটিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। দখলকৃত ৪টি লাশ তল্লাশি করে প্রথমজনের কাছে একশ টাকার ছয়টা নোট ও একটি ঘড়ি, দ্বিতীয়টির কাছে তিরিশটি টাকা ও উর্দু-লেখা একটুকরো কাগজ, জনপ্রিয় চিত্র তারকা নিলুর ছবি, তৃতীয়জনের পকেটে সোনার হার আনুমানিক দুই তোলা ওজনের রুমালে বাঁধা, তিনটি আংটি ও পাঁচ-ছয় ভরি ওজনের একটি সোনার চেইন এবং সর্বশেষ জনের কাছে তেরশ টাকা, একটি ঘড়ি, কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী চিতাভিনেত্রীর ছবি, কিছু চুড়ি, মালা ও আংটিসহ ভরি সাতকে স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। বল্লার যুদ্ধে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে ৪টি চাইনিজ রাইফেল, ৬০০ গুলি, ১০টি গ্রেনেড, ৪টি ২ ইঞ্চি মর্টারশেল। পরে বল্লার উৎসাহী যুবকরা রাস্তার দুপাশে জলাশয়ে ঝাকিজাল ফেলে তুলে আনে ১টি চাইনিজ রাইফেল এবং ৪০০ গুলি। বল্লা যুদ্ধের দুদিন পরে আরো একটি শক্রর মধ্যে লাবিবুর রহমান, হুমায়ুন, খোরশেদ আলম, আর ও সাহেব, সাইদুর রহমান, আফসার উদ্দিন আহমেদ (আফসার মেম্বার), আবদুস সবুর খান, আবদুল মালেক, আবদুল হালিম, রফিক, নিতাই পাল, বাবুল সাহা, আমজাদ উল্লেখযোগ্য।
[৫৯৪] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত