You dont have javascript enabled! Please enable it!

বালাখাল রামচন্দ্রপুর খেয়া ঘাটের প্রথম যুদ্ধ, চাঁদপুর

দেলোয়ার হোসেন খান চাদপুরের কচুয়ায় বলাখাল যুদ্ধের বিবরণ লিখেছেন। তিনি নিজে ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন] একদিন আমি কলিমউল্লা ভূইয়া ও নায়েক সুবেদার নূর আহাম্মেদ গাজী (বিশকাটালি, পড়ে তিনি পূর্ব চন্দ্রাবাজার বাখরপুর মজুমদার বাড়িতে পাকবাহিনীর সাথে এক সম্মুখ লড়াইয়ে শহীদ হন এবং বীর প্রতীক উপাধীতে ভূষিত হন।) ও সাথে আরো ২ জন জোয়ানকে নিয়ে রেকি করার জন্য যাই। ইতিপূর্বে কলিমউল্লা ভূয়া ২দিন রেকি করেন। জনগণের দেয়া ইনফরমেশন এবং আমাদের দেখা সব তথ্য নিয়ে পরিকল্পনায় বসলাম। খুব সম্ভব ১৭-০৫-৭১ তারিখ, খুব ভোরে আমার একটি প্লাটুন নিয়ে অ্যাম্বুশ করি। সেদিন আমার সাথে যারা ছিল তাদের অনেকের নাম মনে নেই। তবুও যাদের কথা মনে পড়ে তাদের মধ্যে কলিমউল্লা ভুঁইয়া, সুবেদার আবদুল হক (মতলব), সুবেদার আলী আকবর পাটওয়ারী (রামগঞ্জ), নায়েক সুবেদার নূর আহামেদ গাজী (বিশকাটালী), নেভাল অফিসার জয়নাল চৌধুরী (চাঁদপুর), হাবিলদার লোকমান (তেলিসাইর), হাবিলদার গোলাম মাওলা (পাছই, বর্তমানে অনারারী ক্যাপ্টেন ৪২, বেঙ্গল ও বক্সার), বজলু ওস্তাদ (বক্সার) সিপাহি করিম (ভাওয়াল, বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের গাড়ী চালক), লান্স নায়েক সিদ্দিক (মেহের), হাবিলদার আবদুর রশিদ (কাসারা), নায়েক মোঃ আলী (টিকে, ফিঙ্গিরা, মতলব), নায়েক ফারুক (হুগলি, পড়ে শাসিয়ালীর লড়াইয়ে শহীদ হিন), হাবিলদার আবদুল মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার শহীদ আহমেদ, আহাম্মদ উল্লা ভূঁইয়া, আহমেদ উল্লা রতন, শাহজাহান-২ (আনসার, বাবুর হাঁট), আবু তাহের তরফদার, (নাটেহারা, বর্তমানে ব্যাংকে চাকুরীরত), আবু বক্কর (বক্কা) (হাজিগঞ্জ), আরো অনেকে। আমি আমার লোকদের নিয়ে রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটে অ্যাম্বুশ করি। আমাদের ইনফরমার খবর নিয়ে আসে পাকবাহিনীর একটি বড় গ্রুপ মুন্সীর হাঁট যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। লোক হাজিগঞ্জ থেকে খবর নিয়ে এল পাকবাহিনী আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি আমার লোকদের নিয়ে খুব ভোরে মাঝি বাড়ির পুকুরে এবং নদীর পাড়ে ডিফেন্স বসাই। পাঠান সাহেব বলেন, আজ আমি নিজে শাহজাহান০২ (বাবুরহাট, মুন্সির হাঁট) কে সাথে করে সবার সামনে মাঝি বাড়ীর একটি আগে নদীর বাঁকে এলএমজি নিয়ে পজিশন নেই। আমরা যখন পজিশন নেই তখন নদীর পাড়ের বেশীর ভাগ লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। লোকজনের বাড়ীঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার করুন দৃশ্য আমি ভুলতে পারবো না। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পাকবাহিনীর ভয়ে বাড়ীঘর ছেড়ে পালানোর দৃশ্য যে একবার দেখেছে সে হয়ত চিরদিন বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও কষ্টের কথা মনে রাখবে।
আমি লক্ষ করি প্রথমে দুইটি কার্গো লঞ্চ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। নদীর তীরে আধা মাইল এরিয়া নিয়ে আমার লোকজন প্রস্তুত। পাঠান সাহেব বলেন, আজকের যুদ্ধের মূল কমান্ডে আমি নিজেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার লোকদের তিনটি গ্রুপে ডিফেন্স করি। পূর্বেই আমি নির্দেশ রাখি পাকবাহিনীর লঞ্চ মাঝখানে আসলে প্রথম ফায়ার ওপেন হবে আমার তরফ থেকে। মাজখানে কলিমউল্লা ভূইয়া ও সর্ববামে সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর প্লাটুন। তিনটি গ্রুপে ৫টি ব্রিটিশ এলএমজি, ২টি এ ইঞ্চি মর্টার ও রাইফেল আজকের হাতিয়ার। লঞ্চ ধীরে ধীরে আমাদের অ্যাম্বুশে প্রবেশ করছে। চতুদিংক থমথমে ভাব। হঠাৎ আমি লক্ষ করি প্রায় আধা মাইল দূরত্বে আরও দু’টি লঞ্চ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। সামনের লঞ্চ দু’টো এখন আমাদের টার্গেট বরাবর। সবাই অধীরভাবে অপেক্ষা করছে আমি অর্ডার করি ফায়ার। লঞ্চগুলো আমাকে অতিক্রম করে বামে মাঝখানের গ্রুপের নাকের বরাবর ৫০ গজ দূরত্বে এলে আমি অর্ডার করলাম ফায়ার। অমনি আমার সহযোদ্ধারা সামনে পিছনে ও মাঝখান থেকে শুরু করলো অতর্কিত আক্রমণ। আমার দুঃসাহসী চৌকস মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে বেশিরভাগ পাকসেনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। খুব সম্ভব আমাদের গুলিতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। আমাদের প্রতিরোধের সামনে টিকতে না পেরে সামনের লঞ্চটি আর সামনে বা পিছনে এগুতে পারছে না। দ্বিতীয় লঞ্চটি ছিল একটু পিছনে সে আক্রমণকে প্রতিহত করে পিছনে চলে যায়। আরো পিছনে দূরে যে লঞ্চগুলো ছিল তারাও বহুদূর থেকে অনবরত গুলি করতে পিছে চলে যাচ্ছে। আমরা একটানা ১০/১২ মিনিটের মত গুলি করে যাচ্ছি। পাকবাহিনী যারা নদী সাতরিয়ে অপর পাড়ে চলে গেল তারা কেউ কেউ গুলি করছে। এরি মধ্যে মারাত্মক ভাবে গুলিতে নিহত বা আহত কয়েকজনকে পায়ে ধরে টেনে নদীর পাড়ে রাস্তার আড়ে তুলছে। এ অবস্থায় বেশ কয়েকজন পাকসেনা আমাদের গুলিতে নিহত হয়। তারা দ্রুত নদীর তীরে রাস্তায় আড় নিয়ে শুরু করলো আমাদের প্রতি পালটা আক্রমণ। একটি লঞ্চ বর্তমানে আমাদের এরিয়ায় নিরুপায়ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। লঞ্চটি শেষ পর্যন্ত বাতাসের আঘাতে সর্ববামে হাবিলদার রশিদের কাছে গিয়ে থেমে থাকে। (সেখানে আলী আকবর পাটোয়ারীর প্লাটুন ছিল) এখন নদীর এপাড়ে আমরা অপর পাড়ে পাকবাহিনী সামনা সামনি গুলি বিনিময় হচ্ছে। এবার আমি আমার লোকদের অযথা গুলি না করে মাঝে মাঝে দু’একটি গুলি করার নির্দেশ নেই। পাকবাহিনী একটানা গুলি করে যাচ্ছে, এরি মধ্যে হঠাৎ শুরু হল আমার বাহিনীর উপর হেভি মেশিনগান থেকে অতর্কিত গুলিবর্ষণ। সাথে ৩ইঞ্চি মর্টারের শেল। এধরনের আক্রমণ হতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মূলত: আমার বাহিনী কতৃক পাকবাহিনীর লঞ্চ বলাখাল খেয়া ঘাটে আক্রান্ত হয়। এই খবর পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি হাজিগঞ্জে পৌছলে কয়েক ট্রাক পাকসেনা বলাখাল চলে আসে। এখানে এসে পাকবাহিনী দু’টি দলে বিভক্ত হয়। একটি দল হেভি মেশিন গান বলাখাল ওয়ারলেস কাছে বিল্ডিং এর ছাদের উপর। আর একটি দল আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাস্তার আড়ে আড়ে একেবারে নদীর অপর পাড়ে তাদের বন্ধুদের সাথে যোগ দেয়। এবার তারা নদীর অপর পাড় ও ওয়ারলেসের ছাদের উপর থেকে আমার উপর বৃষ্টির মত গুলি করে যাচ্ছি। আমার ভরসা মাঝখানে নদী পাকবাহিনী কিছুতেই নদী অতিক্রম করে এপাড়ে আসতে পারবে না। আমি আমার লোকদের পজিশনে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিলাম। প্রায় একঘন্টা একটানা তারা থেমে আমাদের উপর গুলি ও মর্টারের গোলা বর্ষণ করে। এখন তারাও মাঝে মাঝে গুলি বর্ষণ করছে। প্রায় দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হতে চলল আমরা উভয় পক্ষ পজিশনে থেকে থেমে থেমে লড়াই করে যাচ্ছি। এরি মধ্যে হাবিলদার লোকমান (তলিসহর) নিজের পজিশান থেকে তার পাশে পজিশনরত আবু তাহেরকে (নাটেহারা, বর্তমানে পূবালী ব্যাংকে কর্মরত) জিজ্ঞেস করেন, আপনার কাছে সিগারেট আছে? আবু তাহের বলে আছে। আমি বলেছি পাকবাহিনী তখনও মাঝে মাঝে গুলি করে যাচ্ছে। হাবিলদার লোকমান বলল, আমার কাছে আগুন আছে। আমি আপনার কাছে আসছি দু’জনে এক সাথে ধুমপান করবো। হাবিলদার লোকমান আহম্মদ উল্লা রতনের কাছে তার হাতিয়ার দায়িত্ব দিয়ে ক্রলিং করে যেই আবু তাহেরের ব্যাংকারের কাছে অগ্রসর হচ্ছেন অমনি পাকবাহিনী হাবিলদার লোকমানকে লক্ষ করে গুলি চালায়। গুলি হাবিলদার লোকমানের দান পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। হাবিলদার লোকমান গুলি খেয়ে মারে বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে নীচে ধান ক্ষেতে পড়ে যায়। কলিমউল্লা ভূইয়া ছিলেন হাবিলদার লোকমানের বাম পাশে। তার চিৎকারে আমার দলে একটি আতঙ্কের তরঙ্গ সৃষ্টি হলো। কলিম উল্লা ভুঁইয়া উত্তেজিত হয়ে সবাইকে পালটা আক্রমণের জন্য বলেন। আমিও তাঁকে সমর্থন করি। আমার লোকদের আক্রমণের জন্য বলেন। আমিও তাঁকে সমর্থন করি। আমার লোকদের আক্রমণের জন্য বলেন। আমিও তাঁকে সমর্থন করি। আমার লোকদের আক্রমণের কাছ এটিকতে না পেরে নদীর তীরের পাকবাহিনী পিছে হটতে বাধ্য হয়। আমি আমার লোকদের হাবিলদার লোকমানের চিকিৎসার জন্য যত তাড়া তাড়ি সম্ভব নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। তারা পাশেই মাঝি বাড়ী থেকে বাঁশের মই (চঙ্গ, হাল চাষে ব্যবহার করা হয়) নিয়ে আসে। হাবিলদার লোকমানকে বুক সমান পানি ও ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে নিরাপদ স্থানে নেয়া হয়। নাটেহারের আবুতাহের একটি বুলেট হাতে টেনে রস ও লতা গামছা দিয়ে বেঁধে পায়ে ব্যান্ডেজ করে।
পাকবাহিনীর দু’টো কার্গোতে প্রায় ২০ জন পাকসেনা ছিল। আমরা একটি কার্গো লঞ্চ দখল করতে সক্ষম হই। আমরা লোকমানকে নিয়ে ব্যস্ত পাকবাহিনীও একে একে পিছনে চলে গেছে। আমি সেদিন রাতেই জনগণের সহায়তায় লঞ্চটি মুন্সির হাট পাঠিয়ে দিই।
[৫০] ডাঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!