বদলপুর যুদ্ধ, সিলেট
৫ নম্বর সেক্টরের টেকেরঘাট সাব সেক্টরের যুদ্ধের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র জগৎজোতি দাস। তাঁর দাস গ্রুপ অত্র আলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উল্লেখ্য যে, টেকেরঘাট সাব সেক্টরে যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকে গেরিলা তৎপরতার সুবিধার্থে সেকশন, প্লাটুন কোম্পানি তথা প্রথাগত সংগঠনের পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধারা অধিনায়ক কেন্দ্রিক গ্রুপ বা দলে বিভক্ত ছিল। দিরাই শাল্লা এলাকায় যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। ১৬ নভেম্বর রাজাকারদের সাথে বদলপুরে দাস বাহিনীর এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে জগৎজোতিসহ চার জন মুক্তযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন। ১৫ নভেম্বর জগৎজোতির নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা টেকেরঘাট সাব সেক্টর থেকে সন্ধ্যার পর বানিয়াচঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। উদ্দেশ্যে হলো বানিয়াচং হানাদার মুক্ত করে এর আশপাশের থানাগুলোতে চোরাগুপ্তা হামলা করে বিজয় ত্বরান্বিত করা। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে পরিমাণ যুদ্ধরসদ প্রয়োজন তা ইন্ডিয়ার সেক্টর কমান্ডার বার্ড (BARD) সরবরাহ করেন। অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৪টি জিএফ রাইফেল, জাহাজ বিধ্বংসী অস্ত্র, রকেট লাঞ্চার, ৪টি ২ ইঞ্চি মর্টার। ৫টি লাইট মেশিনগান, ১০টি এসএমজি বাকি অর্ধেক ছিল রাইফেল ও এসএলআর। এইসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের বাক্স দিয়ে দুটো নৌকা বোঝাই হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরসহ মোট নৌকা হয় ১০টি। টেকেরঘাট তাহিরপুর থানাধীন হওয়ায় অত্যান্ত সতর্কতার সাথে থানা সদর অতিক্রম করে আসতে হয়। ১০টি নৌকার বহর একযোগে রাত দুটোয় শাল্লার শিবপুর গ্রামে (জনমানবহীন পরিত্যাক্ত) অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার শাল্লা থানা অপারেশন করে বানিয়াচং অপারেশন করতে পরামর্শ দেন। জগৎজোতি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সুকুমারের দুজন লোককে মাছ ধরার অভিনয়ে রেকি করতে বলেন, তাদের দিরতে দেরি হওয়ায় জোত তার কোম্পানিসহ বানিয়াচঙ্গের উদ্দেশ্য রওনা হন। কার্তিক মাস (নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখ) হওয়ায় নদীপারের অনেক জায়গা শুকিয়ে যায়। ফলে শিবপুর থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে খান্দিরগাও নামক গ্রামের মধ্য দিয়ে নৌকা টেনে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এ সময় খান্দিরগাও গ্রামের লোকন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক উৎসাহ দেয় ও সাহায্য সহযোগিতা করে। নৌকাবহর সকাল সাড়ে ৮টার সময় বদলপুর গ্রামে এসে পৌছাল। বদলপুরের বড় নদী পার হয়ে ছোট নদীর মধ্য দিয়ে বানিয়াচং যাওয়ার পথে লোক মারফত খবর আসে, বদলপুর চেয়ারম্যান অফিস রাজাকাররা দখল করেছে। এ এলাকায় বাণিজ্য নৌকা আটক রেখে চাদা তুলছে। জগৎজোতি একথা শুনার পর জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে তার কোম্পানি নিয়ে রাজাকারদের হামলা করবার উদ্দেশ্যে দৌড়ে অগ্রসর হতে থাকে। এসময় উভয় পক্ষ থেকে গুলি বিনিময় হলে ২ জন রাজাকার নিহত হয়। এবং মুক্তিযোদ্ধারা ২ জনকে ধরে নিয়ে আসে। ঠিক এ সময় বদলপুর গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত জলসুখা হতে গুলি আসতে থাকে। জগৎজোতি বলতে থাকেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না; কিন্ত জলসুখা থেকে গুলি আসার আমার এখনই যেতে হবে। উল্লেখ্য যে, জগৎজোতির বাড়ি জলসুখা গ্রামে। তিনি একই গ্রামের স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মে মাসে মুক্তিযুদ্ধে যগ দেয়ার সময় তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাতেহ ওয়াদা করেছিলেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিজ বাড়িতে ফিরবেন না। মুক্তিযোদ্ধা বাবুল আক্তার জানান, জলসুখার রাজাকারদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি আমাদের দুদলে বিভক্ত করেন। একটি দল বাদশাহ মিয়ার কমান্ডে পিটিয়াকান্দি অন্যটি আইয়ুব আলীর কমান্ডে আজমিরীগঞ্জের দিকে পাঠান। ইতোমধ্যে শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে পাক আর্মি আমাদের উভয় দলকে আক্রমণ করে। অবস্থা প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় জগৎজোতি জলসুখা না গিয়ে পিহন দিকে নিজ দলের সাথে যোগ দেবার জন্য ফিরে আসেন। পিটুয়াকান্দির দল পাক আর্মিকে প্রতিরোধ করবার জন্য বদলপুরে অবস্থানরত আজমিরীগঞ্জের বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। জগৎজোতি পিটুয়াকান্দি এসে পাক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পিছন থেকে তাঁর কোম্পানি তাঁকে সহযোগিতা করে। কিন্ত জগৎজোতি পাক বাহিনীকে তাড়া করে অনেক দূর চলে গেলে তাঁর কোম্পনি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার সঙ্গে একটি এলএমজি ও একটি মর্টার থাকায় এ অবস্থায়ই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন এবং সারাদিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে আবু লাল, গোপেন্দ্র ও উপেন্দ্র শহীদ হন এবং তিনি গুলিবিদ্ধ হন। বাম পাঁজরে গুলি নিয়েও যুদ্ধ চালিয়ে যান। জ্যোতি একাধারে ৮ ঘন্টা যুদ্ধ করে টিকে থাকতে না পেরে নিজের গুলিতে নিজে শহীদ হন। পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণাই তার এ ধরনের আত্মহত্যার কারণ। জগৎজোতির লাশ পাক আর্মি একটি বাঁশে বেঁধে জলসুখার রাস্তার ঝুলিয়ে রাখে। ডক্টর সুকুমার বিশ্বাস বলনে: এই এলাকায় জগৎজোতি দাস পাকিস্তানীদের ঙ্কট টেরর ছিলেন। শোনা যায় শ্রী জগৎজোতি পাকসেনাদের চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধে নামতেন। ইতঃপূর্বে ৯টি অপারেশনে তিনি তার সফল রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। আরো শোনা যায়, জগৎজোতিকে বার বার মায়ের সঙ্গে দেখা করবার বলা সত্ত্বেও তিনি নাকি দেশ শক্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মায়ের মুখ দেখবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই দুঃসাহসী টেরর জগৎজোতিকে নিশ্চিহ্ন করার এমন সুযোগ পাক সেনারা ছাড়ল না। জগৎজোতি পাকসেনাদের এই আকস্মিক আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে ত্বরিৎবেগে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে আত্মরক্ষামূলক ব্যাবস্থা নিলেন। জগৎজোতির তীব্র আক্রমণের মুখে ফাস্ট লাইনে অবস্থানরত পাকসেনারা পিছনে সরতে শুরু করে। এই সংঘর্ষে দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা স্থায়ী হলো। ব্যাপকভাবে পাকিস্তানীদের ক্ষয়ক্ষতি করলেও শেষ রক্ষা হলো না। নির্ভীক দেশপ্রেমিক জগৎজোতি দাস, উপেন্দ্র প্রমুখ পাকিস্তানী বুলেটের শিকার হলেন। আহত হলো আইয়ুব, ইলিয়াস, দ্বিজেন্দ্রুসহ আরো কয়েকজন।
[৬৩] মাহফুজুর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত