বগাদিয়া অপারেশন, নোয়াখালি
১৯৭১ সালে যারা নিয়মিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতেন তাদের কাছে বগাদিয়া নামটি খুবই পরিচিত। পাকিস্তানী আর্মিরা এটি উচ্চারণ করতো ‘বগদাদ’। বাংলাদেশের যে কয়টি জায়গায় নিয়মিত যুদ্ধ লেগেই থাকতো তার মধ্যে ‘বগদিয়া’ ছিল অন্যতম। নোয়াখালির এই বগাদিয়ায় প্রথম যুদ্ধ হয় ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল। সুবেদার লুৎফুর রহমানের বাহিনী আগে থেকেই জানতো যে তারা বিপুলাশহর দিয়ে আসবে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি করা হয় কালিকাপুরের হাফিজ সাহেবের (জায়েদী হোটেলের মালিক) বাড়িতে, সেই পরিকল্পনা মিটিং- এ ছিলেন ২৫ জন। পরিকল্পনা মোতাবেক বিপুলা শহরের দিক থেকে সুবেদার শামছিল হক, হাবিলদার মোস্তফা, নুরুল হক, নুর মোহাম্মদ, নায়েক সিরাজ, বিডিআর-এর শাজাহান (আবীরপাড়া) প্রমুখ ছিলো। রাস্তার দুই পাশে অ্যামবুশের পরিকল্পনা করা হয়। তাদের গাড়িতে প্রথম দিকে ছিল ১ জন ওয়ারলেস অপারেটর, ড্রাইভার, দুইজন প্রটেকশন গার্ড এবং পেছনে আর্মস সজ্জিত সৈন্য। এই গ্রুপের মধ্যে আমিশাপাড়ার নুরুন্নবী এবং আলেমও ছিলেন। সফল অ্যামবুশ হয়। এই যুদ্ধে সেবেদার ওয়ালীউল্লাহ আহত হন। একই দিনে ফেনাঘাটা পুল ধ্বংস করা হয়। রাতে সেখানে এক্সপ্লোসিভ ফিট করেন নায়েক ইউসুফ। এটি পুলের মধ্যে লাগানো হয় রাত ২টায়। এই পুল ধ্বংস করতে ছিলেন ৫ জন। সুবেদার শামছুল হক, নূর মোহাম্মদ, মোস্তফা, সিরাজ ও ইউসুফ। তাঁর আগে থেকে প্ল্যান করেছিলেন। এর মধ্যে মে মাসের ৬ তারিখে সোনাইমুড়ী রেলওয়ে পুল ভাঙা হয় সুবেদার শামছুল হকের নেতৃত্বে। এরপর থেকে শুরু হয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, আনসার, মুজাহিদ মিলে প্রায় ১০০ জনকে ট্রেনিং দেওয়া হয় পিতম্বপুর জব্বার সাহেবের বাড়িতে। এই ট্রেনিংটি শুরু হয় শুধু গুলি চালানোর জন্য। এই সময় থেকে শুরু করা হয় আবীরপাড়া ট্রেনিং সেন্টার, মুন্সীরহাট ট্রেনিং সেন্টার, কাদিরপুর, চাটখিলের পাটোয়ারী বাড়ির ট্রেনিং সেন্টার, কড়িহাটিতে মমিনউলাহ এবং নুরমুন্সী চৌধুরীর বাড়িতে ট্রেনিং ও গোলাবারুদ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, প্রথমে যেদিন আর্মি চৌমুহনীতে আসে তাঁর পূর্বে আর্মি আসার খবর পেয়ে চৌমুহনীর মুক্তিকামী জনতা কালোপুলটি ভেঙে দেয় এবং এর দক্ষিণে রমজান বিবির পুল ভেঙে দেয়, যেন আর্মি এদিকে আসতে না পারে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মি স্থানীয় লোকদের চাপ প্রয়োগ করে সেগুলো ঠিক করিয়ে নেয়। নোয়াখালী শহর এভাবে পাকিস্তানীদের করতলগত হয়ে যায়। এর সঙ্গে তাদের শক্তি হিসেবে যুক্ত হয় দেশীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা। তারা বিভিন্ন বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালায়, মালামাল লুট করতে থাকে, যেন, বাঙালিদের মানসিক অবস্থা নাজুক হয়ে যায় এবং তারা কোনোক্রমে আর পাকিস্তানী শক্রকে মোকাবেলা করতে না পারে। লুৎফুর রহমান, সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ এবং সুবেদার শামছুল হকের কমান্ডিং-এ দুইটা গ্রুপ করলেন। একটি গ্রুপ চৌমুহনী লক্ষ্মীপুর রোডের, অপর গ্রুপ চৌমুহনী সোনাইমুড়ী রোডের পাশে কাজ করবে। গাজী আমিনউল্লাহ এবং সুবেদার লুৎফুর রহমান সাহেব ভারতে যাবেন তা ঠিক হলো। ২৯ এপ্রিল আবিরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় অবস্থানরত সকল সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, মুক্তিযোদ্ধাদের হাজির হওয়ার অনুরোধ করা হয়। এই অনুরোধ করার দায়িত্ব পালন করলেন আবির পাড়ার আবুল খায়ে ভূঁইয়া, আতিকউল্লাহ, সুলতান আহমেদ, ছাত্রনেতা শফিউল্লাহ অ ক্বারী করিম উলাহ। একই দিনে আবীরপাড়ার বৈঠকে সুবেদার লুৎফুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সকল বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে হতে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করা হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সুবেদার অলিউল্লাহ, সুবেদার শামছুল হক, হাবিলদার মন্তাজ, হাবিলদার রুহুল আমিন। হাবিলদার জামালকে গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করেন।এই সময় গণপরিষদ সদস্য খালেদ মোহাম্মদ আলী ভারত থেকে এসে ক্বারী করিমউল্লাহর বাড়িতে অবস্থান নেন এবং বেগমগঞ্জ, লক্ষীপুর ও সদরে মুক্তিবাহিনী সংগঠনের কাজ জোরদার করেন। এরই মধ্যে ২৫ এপ্রিল বেগমগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেলসহ করিম উল্লাহ সাহেবের বাড়িতে অবস্থান নেন। ২ মে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক আবীরপাড়ায় অনুষ্টিত হয়। এই বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া, বাসস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি শক্তিশালী সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলীকে সভাপতি এবং আবুল খায়ের ভুচঞ্চাকে সম্পাদক করা হয়। শহীদ রুহুল আমীন (খিলপাড়া), গাজী আমীনউল্লাহ, আলী আহাম্মদ চৌধুরী, ক্বারী করিম উলাহ, আব্দুর রব চেয়ারম্যান (জিরতলী) সহ ৩১ জনকে সদস্য করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। এই সভায় গাজী আমিনউল্লাহকে সর্বসম্মতিক্রমে আগরতলায় যোগাযোগ করে অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি কয়েকবার আগরতলা থেকে অস্ত্র এনে সুবেদার লুৎফুর রহমানের কাছে পৌছান। কিছুদিন পর সুবেদার লুৎফুর রহমানের পরামর্শে দক্ষিণ অঞ্চলে একটি ট্রুপ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ছয়ানীর ক্বারী করিম উল্লাহর বাড়িতে ৩ মে একটি বৈঠক অনুষ্টিত হয়। এই বৈঠকে সুবেদার লুৎফুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মরহুম আখতারুজ্জামান এডভোকেট, শাহজাহান কামাল, অমল নাগ, আলী আহমেদ চৌধুরী, শফিকুর রহমানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় জনাব মশাররফ হোসেনকে কমান্ডার নিযুক্ত করে দক্ষিণাঞ্চলে একটি ট্রুপস গঠন করা হয়। এই সময় জনাব আলী আহমেদ চৌধুরী গোপন খবর পেয়ে নোয়াখালী খালের দক্ষিণে চরে মাটির নিচে পুঁতে রাখা ৫১টি রাইফেল উদ্ধার করেন। এই রাইফেলগুলি শামছুল কবীর চৌধুরীর দায়িত্বে দেয়া হয়। তিনি আলী হোসেনের নেতৃত্বে নূরনবীর মাধ্যমে রাইফেলগুলি কার্যকর করে তোলেন। ৬ মে হানাদারবাহিনী পুনরায় লক্ষীপুর যাত্রা করে এবং পথে চন্দ্রাগঞ্জ বাজার আক্রমণ করে সমস্ত বাজার জ্বালিয়ে দেয়। এদিকে বি,এল,এফ দ্বিতিয় ব্যাচেও ভারতের উদ্দেশ্যে রোয়ানা দেয়। হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতের পথে পাড়ি জমাচ্ছে। ১৫ দিন পরপরি এক একটি ব্যাচ যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে এফ.এফ (শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র) এর বিভিন্ন ব্যাচ ও ট্রেনিং-এর উদ্দেশ্যে ভারত যাওয়া শুরু করে। ঢাকার অনেক মানুষ বাঁচবার তাগিদে তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালি এসেছিল। দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নোয়াখালী শহরের অবস্থান করছিল তারা মে-র দিকে ছুটে পালাতে লাগল গ্রামের দিকে। পাক আর্মি এবং স্থানীয় রাজাকাররা পি.টি.আই এবং চৌমুহনী পলিটেকনিক্যালে তাদের ক্যাম্পে তৈরি করল। যুদ্ধ শুরু হবার ২ মাসের মধ্যে অস্ত্রের সন্ধান বাড়তে থাকল। দায়িত্ব মোতাবেক গাজী আমিনউলাহ সাহেব সুবেদার লুৎফুর রহমানের সঙ্গে ভারত হতে অস্ত্র আনার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। প্রথম ব্যাচে মোট ৪৫ জন বি.এল.এফ-এর পক্ষে ট্রেনিং-এ যায়। এদের সঙ্গে পরবর্তীতে ব্যাক্তিগতভাবে যাওয়া অনেকেই ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করেন। শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশেই তারা যায়।
[৪৪] জোবাইদা নাসরীন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত