বড়কামতার যুদ্ধ, কুমিল্লা
কুমিল্লা সেনানিবাস হতে ১২ কি.মি. পশ্চিমে চান্দিনা থানার নিকট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন স্থানে কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার অন্তর্গত একটি ছোট গ্রাম বড়কামতা। বড়কামতা ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। সমগ্র চান্দিনা এলাকা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বড়কামতা নামে অধিক পরিচিত ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চান্দিনা বাজারের মধ্য দিয়ে ছিল বড়কামতা গ্রাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে হওয়ায় গ্রামটি পাকিস্তানীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাছাড়া কুমিল্লা সেনানিবাসের নিকটবর্তী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম হওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বড় লক্ষ্য ছিল এ গ্রাম। বড়কামতা এলাকায় যখন মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তখনো মুক্তিবাহিনী সাংগঠনিক পূর্ণতা লাভ করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ যুদ্ধে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈনিক ও গ্রামবাসী অংশ নেয়। পক্ষান্তরে পাকিস্তানীদের নিয়মিত টহল বাহিনী এ যুদ্ধে অংশ নেয়। বাগমারা গ্রামের মো. মনিরুল ইসলাম ভুঁইয়া ওরফে মনির মাস্টার যিনি বাংলাবাজার সংলগ্ন বিএ মুসলিম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনিই এলাকার যুবকদের সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহে ১৬ থেকে ১৮ তারিখ ভারতের মতিনগরে যান এবং মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বড়কামতায় সংঘটিত প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধেই তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তার নেতৃত্বেই এলাকাবাসী ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সহায়তায় প্রাথমিক প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়। মনির মাস্টার মতিননগর ক্যাম্পে গিয়ে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মতিনকে এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। ক্যাপ্টেন মতিন মুনির মাস্টারকে পুলঘাটা ব্রিজ ধ্বংসের প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক দেন ও মৌখিক প্রশিক্ষণ দেন। ১৮/১৯ এপ্রিল মনির মাস্টার ও তার ৫ জন সহযোগী উক্ত ব্রিজ ধ্বংসের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের নায়েক মফিজ ও নায়েক তাহেরে সহায়তায় ২২ এপ্রিল পুলঘাটা ব্রিজ ধ্বংস করা হয়, ২৩ এপ্রিল নায়েক তাহের, নায়েক মফিজ, আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার ও মোঃ সাইদুর রহমান ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস করেন। এসব তৎপরতার কারণে পাকিস্তানীদের সম্ভাব্য আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ১৯/২০ এপ্রিল সকাল দশ ঘটিকায় ৩/৪ টি ট্রাকে করে পাকিস্তানী সৈন্য চান্দিনা বাজারে আসে ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২০/২১ এপ্রিল সকাল দশটায় দ্বিতীয়বার পাকিস্তানীরা চান্দিনা বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ও বড়কামতার দুর্গাবাড়ি, জেলেবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ২০/২১ এপ্রিল গ্রামবাসী লাঠিসেটা, বর্শা, বল্লম নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। গ্রামবাসীর প্রতিরোধের খবর মতিননগরে এসে পৌছালে ২৬/২৭ এপ্রিলে হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে ১১/১২ জনের একটি দল ছোটনা এসে পৌঁছায়। ২৭/২৮ এপ্রিল তারা বাগমারা গ্রামের আমিন উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান নেয়। হাবিলদার গিয়াস ২৮/২৯ এপ্রিল শক্র কতৃক বড়কামতা আক্রমণের সংবাদ পান। তিনি তার দলকে দুটি ভাগে ভাগ করেন, পূর্বদিকে থাকেন নায়েক তাহের ও তার দল। পূর্বনির্ধারিত খবর অনুযায়ী ২৮/২৯ এপ্রিল সকাল আটটায় পাকিস্তানীরা ৪/৫ টি ট্রাকে করে এসে চান্দিনা থানার কাছে পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর থামে ও দ্রুত বড়কামতা গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে ফায়ার করে শক্রদের ওপর। হতবিহবল শক্র ভীট হয়ে যত্রতত্র ফায়ার করা শুরু করে। গুলি বিনিময় চলে বিকাল পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত। এই যুদ্ধে পূর্বদিকের দল অধিনায়ক নায়েক তাহের ও সিপাহী কালুমিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাওয়ায় হাবিলদার গিয়াস দলবল নিয়ে অবস্থান ত্যাগ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ত্যাগ নিশ্চিত হয়ে পাকিস্তানীরা বড়কামতায় প্রবেশ করে ও ধৈয়রাবাড়ি, করের বাড়িসহ বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মুক্তিবাহিনী নিশ্চিত হয় যে, পাকিস্তানীরা অবশ্যই আবার অতিরিক্ত লোক ও শক্তি নিয়ে আসবে। হাবিলদার গিয়াস দেরি না করে জনবল ও ভারী অস্ত্র চেয়ে মতিননগরে বার্তা পাঠান। মতিননগর হতে একটি এমজি, কিছু গ্রেনেড ও কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল প্রেরণ করা হয় কিন্ত লোকবল বৃদ্ধি সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। হাবিলদার গিয়াস অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। জনবল ও অস্ত্র বৃদ্ধি পেলেও তা সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত শক্রদের তুলনায় ছিল নগন্য। হাবিলদার গিয়াস তাই পাকিস্তানীদেরকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা বাজারের ওপর হতে বড়কামতা গ্রামের মাঝ দিয়ে বাগমারা হয়ে ছোটনা পর্যন্ত হালকা যান চলাচলকারী এই রাস্তাকে মাঝে রেখে দু’পাশে দুটি দলকে বসানো হলো। প্রতি দলে জনবল ছিল ৭/৮ জন। গ্রামবাসী ১২/১৪ দিন পর্যন্ত প্রতিরক্ষা প্রস্তুত করল। ১৩/১৪ মে সকাল দশ ঘটিকায় পাকিস্তানীরা পুলঘাট ব্রিজের কাছে এসে থামে। সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী গুলি শুরু করে। সংঘর্ষ প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মুক্তিবাহিনীর কেউ এতে হতাহত হয়নি। পাকিস্তানীদের অনেকেই হতাহত হয়। পাকিস্তানীরা এই প্রতিরোধের মুখে বড়কামতা গ্রামের অতীন্দ্র চন্দ্র আচারয্য ও জনৈকা হিন্দু মহিলাকে হত্যা করে দিকবিদিক ফায়ার করে সেনানিবাসে ফিরে যায়। এর পর হাবিলদার গিয়াস ১৬/১৭ মে মতিননগর গিয়ে ১৫ জুন ৪ ইস্ট বেঙ্গলের ২৭ জনের একটি দিল নিয়ে ফিরে আসেন এবং দুটি দলে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ২৫ জুন সকাল দশটার সময় পাকিস্তানীরা ৪টি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। একটি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হতে আক্রমণ পরিচালনা করে। একটি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হতে বড়কামতা পশ্চিম খালের ভেতর দিয়ে ছোটনা গ্রাম পর্যন্ত পজিশন নেয়। আরেকটি দল গ্রামের পূর্বদিকে উত্তরে ব্রাহ্মণপাড়া গ্রাম পর্যন্ত রাস্তায় ও গ্রামের ভেতর পজিশন নেয়। তৃতীয় দলটি পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হতে অ্যাসল্ট ফরমেশন গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ছোটনা ব্রাহ্মণপাড়া লাইনে এসে উত্তর-পূর্বদিকে মুখ করে অবস্থান নেয়। চতুর্থ দল তৃতীয় দলের কাভারে সমগ্র গ্রাম তল্লাশী চালায়। এদিন ব্যাপক ধরপাকড় ও অত্যাচার নিপীড়নের পর বিকাল ৪৩০ ঘটিকায় পাকিস্তানীরা বড়কামতা ত্যাগ করে। পরবর্তীতে তারা আর কোনোদিন বড় কামতায় আসেনি। বড়কামতা, বাগমারা, ফাগুন্ডা এলাকা, স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ গুপ্তাশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুদ্ধের ফলাফল: বড়কামতার যুদ্ধ অনেকগুলো খণ্ডযুদ্ধ ও প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের সমষ্টি। এসব যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় আংশিক সাফল্য লাভ করেছে। পাকিস্তানীরাও দফায় দফায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলায় বড়কামতার গ্রামবাসীর ওপর।
[৫৫] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত