ফেনাঘাটা যুদ্ধ, নোয়াখালী
২৪ এপ্রিল হানাদারবাহিনী নোয়াখালীতে দুইভাবে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। এক গ্রুপ লক্ষীপুর অভিমুখে এবং আরেক গ্রুপ মাইজদী অপারেশন করে। মাইজদী গ্রুপ মাইজদী কোর্ট স্টেশন এবং ম্যালেরিয়া অফিস ঘেরাও করে প্রায় ১৬০ জন লোককে গ্রেফতার করে চৌমহনী টেকনিক্যালে নিয়ে যায়। সকলের সামনে কাদির হানিফের তাজুকে প্রকাশ্যে প্রথমে বেয়োনেট চার্জ ও পরে গুলি করে হত্যা করে। এই করুন দৃশ্যের মুহূর্তে টেকনিক্যাল স্কুলের বারান্দায় নোয়াখালির তৎকালীন ডি.সি. মঞ্জুরুল করিমকে উপস্থিত করে নাজেহাল করে ছেড়ে দেয়া হয়। একই দিনে হানাদারবাহিনীর আরেকটি দল টেকনিক্যাল থেকে লক্ষ্মীপুরের দিকে রওয়ানা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর সামনে একটি লাল জিপ ছিল। দুই শ’ইয়ের বেশি মিলিটারি পায়ে হেঁটে পুলিশের পেছনে সারিবদ্ধভাবে রওয়ানা হয়। এই যুদ্ধ ফেনাঘাটার পশ্চিমে হয়। নারায়ণপুর সাঁকোর গোঁড়ায় ওঁৎ পেয়ে থাকা সুবেদার লুৎফুর রহমানের প্রেরিত গ্রুপ কমান্ডার শফিউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর গ্রুপটি পাকবাহিনীর জিপ লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে। যার ফলে গাড়িটি অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে পাকবাহিনীর সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এই অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর গুলি শেষ হয়ে যায় ও পেছনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর গুলি বন্ধ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী তারাতাড়ি খাল পার হয়ে ধানক্ষেত ঘিরে ফেলে। ধান ক্ষেত পালিয়ে যাওয়ার সময় ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় জয়নারায়ণপুর আব্দুল হাই পাটোয়ারী, ডা. সুলতান আহাম্মদ, আনসার আলী, এবাদ উল্লাহ-এদেরকে হত্যা করে গ্রামের ১৯টি বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। এই যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়,-প্রত্যক্ষদর্শী জবেদ আলীর কাছ থেকে-“তখন বর্ষাকাল, আমরা নৌকা দিয়ে যাচ্ছি। সকাল ৯-১০টা হবে। হঠাৎ দেখি টেকনিক্যালের রাস্তা হতে প্রায় ৫০০/৬০০ পাঞ্জাবি এদিকে আসছে। ফেনাঘাট পুলে পা দিতেই খালের ওপার/থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার করল। ১৫/২০ জন মুক্তি দেখলাম। তারা গুলি করছিল খালের উপর দিক থেকে। রাস্তায় পাঞ্জাবিরা, খালে কিছুটা পানি কম। দুইপক্ষ গোলাগুলি করলো প্রায় ১ ঘন্তা ধরে। দুইজন মুক্তিকে পাকবাহিনী ধরে ফেলল এবং গুলি করলো”। যে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাদের লাশ স্থানীয় জনসাধারণ জয়নারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে রাখে। রাত ৮টার সময় সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম নূর মহাম্মদ লোকজন নিয়ে সেই মুক্তিযোদ্ধা দুই জনের লাশ নিয়ে যান। শহীদ দুইজনের মধ্যে একজনের নাম মোহাম্মদ ইসমাইল, গ্রাম কংশ নগর, দশ নয় আমিশাপাড়া ইউনিয়ন, থানা বেগমগঞ্জ। তাঁকে তাদের নিজস্ব কবরস্থানে দাফন করা হয়। অপরজনও মোহাম্মদ ইসমাইল। তার সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে যতোটুকু ধারণা পাওয়া গিয়েছে, তাতে জানা গিয়েছে যে তিনি কুমিল্লার লোক। তবে উভয়ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক ছিলেন। তাঁকে নূর মোহাম্মদ-এর নেতৃত্বে মনু মিয়ার বাজারে মিজিবাড়ির কবরস্থনে দাফন করা হয়। ২৪ এপ্রিল ফেনাঘাটা অপারেশন শেষে পাকবাহিনী চন্দ্রগন পূর্ব বাজার পুরো জ্বালিয়ে দেয় এবং জগদীশপুর গ্রামের ২টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তেলিবাড়ির দু’জন নিরীহ লোককে গুলি করে হত্যা করে। এদের একজনের নাম সুজা মিয়া।
[৪৪] জোবাইদা নাসরীন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত