You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফরিদগঞ্জ ভাটিরগাঁও ব্রিজের লড়াই, চাঁদপুর
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েৎ হোসেন পাটোয়ারী ফরিদগঞ্জ লড়াইয়ের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে-আমাদের কাছে খবর এলো গত রাতে একদল পাকসেনা চাঁদপুর থেকে এসে রাত্রে ধানুয়া মাদ্রাসায় অবস্থান নিয়েছে। তারা রিক্সায় বুলেটের বাক্স নিয়ে পায়ে হেঁটে এদিকে আসছে। তাদের আক্রমণের জন্য জনগণ আমাদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করে। ৩/৪ টি এসএলআর এবং কয়েকটি রাইফেল দিয়ে এদের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা ভাববার বিষয়। আমার লোকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেই, যে করে হোক তাদের প্রতিহত করব। তড়িৎ গতিতে চানমারি ব্রিজের পাশে একটি হিন্দুবাড়ীতে লড়াইয়ের উপযোগী স্থান হিসেবে পজিশনের ব্যবস্থা করি। বাড়ীতে কোন লোকজন ছিল না। বাড়ির পিছনে খোলা মাঠে। আমাদের পজিশন থেকে প্রধান সড়ক ছিল ৩০ গজ দূরত্বে, জনগণ বাড়ি বাড়ি হতে কোদাল এনে আমাদের জন্য বাংকারের ব্যবস্থা করে। হঠাৎ আমাদের সামনে কয়েকটি রিক্সার বহর দেখে সন্দেহ হল। তাই আমি মফিজকে ডান পাশ থেকে ব্রিজের কাছে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেই। ব্রিজের ডান পাশে ছিল একটি বেয়াল (স্থানীয় নাম, মূলত মাছ ধরার এক ধরনের পেতে রাখা জাল) তাতে জেলে বসে মাছ ধরছে। তারও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মফিজ আস্তে আস্তে ক্রলিং করে যেই ব্রিজের কাছে গেল, অমনি সে বাবারে বলে বিকট চিৎকার দিয়ে রাস্তার নিচে পড়ে যায়। তার চিৎকারে মাওরাও গুলি শুরু করলাম। আমাদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে বসে। আমাদের গুলির সাথে সাথে জেলেটি বেয়াল থেকে পানিতে পড়ে যায়। প্রায় ১৫ মিনিট উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই হলো। আমরা পাক বাহিনীকে দেখতে না পেলেও রাস্তার পাশে তাদের বন্দুকের নল দেখা যাচ্ছে। এবার তাদের একটি গ্রুপ ব্রিজের গোড়া থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে অনবরত গুলি করে যাচ্ছে। আমি আমার লোকদের গুলি কম করার নির্দেশ দিলাম। সময় যতই বাড়ছে আমার মনে ততই চিন্তা ঢুকছে। কারণ যদি পাক বাহিনী মার্চ করে তাহলে আমাদের বিপদ। পিছনে খালি মাঠে দৌড়াতে বা পালাতে সক্ষম হব না। পড়ে বুঝতে পারলাম পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ আমাদের আক্রমণ করছে আর বাকিরা সাইড রোল করে রাস্তা অতিক্রম করে মাত্র ৪০ মিনিটে তারা সবাই নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হয়। এবার আমি আমার গ্রুপের অবস্থা জানার জন্য বামে তাকাতেই দেখি আমার পাশে মফিজ শুকনা কচুরির স্তুপে কাপড়ের গাট্টি নিয়ে গড়াচ্ছে। তার কাছে আমাদের সবার জামা কাপড়। সে যেভাবে গড়াচ্ছিল আমি ভেবেছি তার শরীরে গুলি লেগেছে। হয়ত গুলির যন্ত্রনায় গড়াচ্ছে। আমি দ্রুত তার কাছে যাওয়ার সাথে সাথে সে উঠে বসল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি ব্যাপার কী? আপনি অমন করে গড়াচ্ছেন কেন ? সে বলল, ভাই আমার অস্থির লাগছে যদি পাকিস্তানীরা এসে পড়ে। আমরা অনেকক্ষণ পজিশন থেকে পাকবাহিনীর কোন সাড়া শব্দ। এবার আমি আমাদের আশ পাশের সবাইকে পজিশনে থেকে একজনকে (আনু পাটওয়ারী যিনি সর্ব ডানে আছেন) অবস্থা জানার জন্য বলি। এমন সময় জনতা দৌড়ে আমাদের খবর জানালো একজন পাকসেনাও নেই, সবাই ফরিদগঞ্জ চলে গেছে। কিন্তু আমার সাথী হাফিজকে পাওয়া যাচ্ছিল না। হাফিজের কথা ভেবে আমরা চিন্তায় অস্থির। যদি তার লাশ পাক ফৌজ ফরিদগঞ্জ নিয়ে যায়। এদিকে বেয়ালে যে জেলেটি ছিল সে গোলাগুলির ভিতরে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে ছিল। সে সেখান থেকে পাক বাহিনীর সব অবস্থা দেখতে পায়। তার মতে ২/৩ জন রিক্সা চালক নিহত হয়। পাক ফৌজের তেমন ক্ষতি না হলেও গুলিতে তারা জখম হয়। আমরা রাস্তার ওপর রক্তের দাগ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির ঘায়ে সব রিক্সা ভেঙ্গে গেছে। তারা রিক্সাগুলি নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সব বুলেটের বাক্স তারা নিয়ে যায়। আমরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও জনগণ খুব আনন্দিত হয়। সেদিনই বিকালে পাকবাহিনী এই রাস্তায় পুনরায় চাঁদপুর চলে যায়।
[৫০] ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!