ফরিদপুরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের তৎপরতা, ফরিদপুর
২১ এপ্রিল পাকসেনারা গোয়ালন্দ থেকে শেলিং করতে করতে ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামানো হয়। পাকিস্তানের পতাকা হাতে ‘নারায়ে তকবীর, আল্লাহ আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ;’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে পাকসেনাদের কাছে এগিয়ে যার বড় কালু, ছোট কালু, রমজান, শের মোহাম্মদ, হাতেম, চান মিয়া, ইসহাক, লালন ও হাতেম মাতুব্বর (বাঙালি)সহ বেশ কিছু সংখ্যক স্থানীয় বিহারী অধিবাসী। তখন থেকেই পাকসেনাদের অনুঘটক হিসেবে তারা লুটপাট, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, পথ দেখিয়ে নেয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগীদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের সহযোগীর ভূমিকায় একে একে এগিয়ে গেল মুসলিম লীগ, জামায়াত ও পিদিবির নেতা, কর্মী ও সমর্থক গোষ্টী। পাকসেনারা যখন ফরিদপুর প্রবেশ করে তখন মুক্তিযোদ্ধা সেন্টু (চরকমলাপুর), মুক্তিযোদ্ধা একেএম আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাকী (গোয়ালচামট) ও শহীদ নৌফেলের মাতা ফাতেমা বারী ফরিদপুরে ছিলেন। তাদের বর্ণনায় সেদিনের অবস্থার কিছু খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। ‘হেমায়েতের নেতৃত্বে ইপিআর গ্রুপটি গোপালগঞ্জ চলে যাওয়ার সময় আমাকে একটি চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গেল আমি তা নিয়ে ২১ এপ্রিল আলিমুজ্জামান ব্রিজের ওপর দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হই। তখন সারা শহরে পাকসেনারা ‘এই আসে, এই আসে’ রব। তখন পুরনো পেট্রোল পাম্পের কাছে মুসা বিন শমসের কিছু বাঙালি যুবককে নিয়ে বিরাট এক পাকিস্তানী পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাইফেল উঠিয়ে তাক করে বলি, শালার দালাল, শেষ করে দেবো। ওরা দৌড় দেয়। কিন্ত পরিস্থিতির কথা ভেবে গুলি না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি। “২২ এপ্রিল ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ে এসে দেখি যে কামরুজ্জামান খান জাসু ও কতিপয় বিহারী যুবক নিত্যনন্দ কবিরাজের বাড়ি লুট করছে। জাসুকেদেখেআমিদ্রুত সরে যাই। এগিয়ে গেলে দেখি যে, দিনু পাগলা ও হারুকান্দির মতির লাশ পড়ে আছে। এমনি সময়ে আমি পাকসেনাদের হাতে ধৃত হই। আমাকে সারকিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দেখলাম, মেজর কোয়ায়েশী সঙ্গে মুসা বিন শমসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেজরের কাছে আমাকে হাজির করলে মুসা আমাকে চেনে। তখন আমি বুঝতে পারি আমার গ্রেফতারের পেছনে কাদের হাত রয়েছে। ২২ এপ্রিল বেলা দশটায় আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় হৈচৈ শুরু হলো। কারণ গতকাল যে যুবক ছেলেটি গুলিতে নিহত হয়ে পড়ে আছে তার লাশ সরানো দরকার। কোথায় চেয়ারম্যান এডিসি, কোথায় ভাইস চেয়ারম্যান, মিউনিসিপ্যালিটির সুইপারই বা গেল কোথায়? এই মুহূর্তে যদি এসব উপস্থিত না হয় তাহলে চাকরি তো যাবেই উপরন্ত তাদের গুলি করে মারা হবে। মুসলিম লীগের জনকয়েক লোক উপস্থিত হলো। আশপাশ থেকে মাইকে অ্যানাউন্স করল, সবাই উপস্থিত হোন কোনো ভয় নেই। ভয় নেই আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্ত ফাস্ট ফায়ারিং যে দেখেছে সে জানে ভয় ছিল কিনা ? ফরিদপুরবঙ্গবন্ধুরদেশকাজেইপাকসেনারা মনে করেছিল, বিপুল বিক্রমে এখানে বাঁধা পাবে। কিন্ত দেখল তার বিপরীত। একেবারে জনশূন্য ফরিদপুর। দু’একটি লোক যারা পালাচ্ছিল শেষ মুহূর্তে তারা খতম। তাদেরই একজন খবির চৌধুরী। ছাব্বিশ বছরের স্বাস্থ্যবান যুবক নাটক করত। নাতকীয়ভাবেই মরে পড়ে থাকে রাস্তার ওপরে। হানাদারদের হম্বিতম্বির পরই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম। রকিম মামা ও এডিসি হালিমউল্লা চৌধুরী দাঁড়িয়ে আর্মিদের কথা শুনছেন, হুকুম তামিল করছেন। কিন্ত গলা দিয়ে জবাব বের হচ্ছে না। হতবিহবল দৃষ্টি নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে দেখছে লাশটাকে। দুনিয়ার কালি ঢেলে দিয়েছে অদৃশ্য কোনো হস্ত ওদের সর্বাঙ্গে। বলির পাঁঠার মতো ঠক ঠক করে কাঁপছে। সামনের বারান্দায় বের হয়ে মামাকে ডাকলাম হাতের ইশরায়। চৌধুরী সাহেব বারবার আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। যেন একটু সাহস পাচ্ছেন আমাকে দেখে। নির্বান্ধব শক্রপুরীতে যেন বন্ধুর আবির্ভাব। সজাগ ইন্দ্রিয়, সতর্ক পা। কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব চলছে ধরে আনা আজকের নাগরিক। সবাইর মুখে আতঙ্ক চোখে কি এক সন্দেহ, কি এক অবিশ্বাস, কেউ যেন আপন দেশের আপন মাটিতে হাঁটছে না। প্রাণটাকে হাতে নিয়ে সবাই যেন হাঁটছে কোনো এক শক্রপুরীর পথে। তাই এত ভীত শঙ্কিত পদক্ষেপ। সুইপার এসে মুরদ্দাকে ঝনাৎ করে ফেলে দিল ময়লা ফেলানো গাড়ির মধ্যে। এখনই স্থানান্তরিত হবে ট্রেনসিং ফিল্ডে। মামা কাছে আসতেই বললেন, আমাদের দোকান ভেঙেছে গতকাল। আর একটু পর প্রাণটাই থাকে কিনা সন্দেহ। মামার মুখ দিয়ে অতিকষ্টে শব্দকয়টি বের হলো। পুরো মুখ কালো হয়ে ঘাম ঝরছে দু’গাল বেয়ে। গরমে নয় ত্রাসে। প্রাণভয়ে ভীত অন্তরাল থেকে সম্মুখে এসেছে যদি ওদের করুণা লাভ হয়? ত্রস্তপদে দু’জনই অন্তর্নিহিত হলেন। মনে হলো যেন আমাকেই নিষেধ করছেন বাইরে বের হতে। ঘরে প্রবেশ করে খাওয়ার আয়োজন করতে গেলাম, কিন্ত ইচ্ছে নেই-নেই উৎসাহ। চুপে চুপে বল এগেল আনসার-শহরের মধ্যে সতেরজনকে গুলি করে মেরেছে আমাকেও মারতো কিন্ত উর্দুতে কথা বলায় মারেনি। কয়েকজন অফিসারকেও ধরে নিয়ে গেছে জিপে করে গুলি করে মারবে ঠিক সেই মুহূর্তে এসপি সাহেব উপস্থিত হয়ে বলেছেন ওরা দোষী নয়। এখনই আপনাদের হুকুম মতো আমরা সবাইক কাজে নেমে যাব। স্যারেন্ডার করল আরো অনেকে কিন্ত তাদের চোখের তারায় গভীর আশঙ্কা আর উদ্বেগের ছায়া ঘন হয়ে রইল সর্বক্ষণ। ২২ এপ্রিল থেকেই মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াত প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা তৎপর হয়ে ওঠে। ওই সব দলের নেতারা সার্কিট হাউজে গিয়ে পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। ওইদিন থেকে এক দল লোক পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপকর্মে শরিক হয়। ৩ মে জেনারেল নিয়াজী ফরিদপুর সফর করেন। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের আরো সক্রিয়ভাবে দুষ্কৃতকারীদের দমন করার ব্যাপারে তৎপর থাকার নির্দেশ দেন। এর কয়েকদিন পর ফরিদপুর শহরস্থ আম্বিকা ময়দানে পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার নামে একটি সভা হয়। সভায় অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, আলাউদ্দিন খান, আবদুর রহমান বাকাউইল, মওলানা মোবারক আলী বক্তৃতা করেন। ঐ সভায় মওলানা মোবারক আলী তার বক্তৃতায় হিন্দুদের সম্পত্তি গনিমতের মাল ঘোষণা করে লুটপাটের জন্য উৎসাহ দেন। ঐ ঘটনার পরই বাঙালি ও বিহারী রাজাকারদের মধ্যে হিন্দুদের বাড়ি লুটপাট, দখলের হিড়িক পড়ে যায়। ১৮ মে পূর্বাঞ্চল কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ফরিদপুর সেনা ইউনিট পরিদর্শন করেন। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে মিলিত হয়ে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সৈনিকদের আরো সতর্কতার সঙ্গে শক্র মোকাবেলার নির্দেশ দেন। মধুখালী ও কামারখালীতে সভা হয়। ওইসব সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, আব্দুর রহমান বকাউল, রুস্তম আলী খান প্রমুখ। মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনকে আহবায়ক করে কেন্দ্রের অনুরূপভাবে জেলা ও থানা পর্যায়ে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও পিডিবির নেতা ও সমর্থকদের স্মন্বয়ে ফরিদপুর শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর মওলানা আবদুল আলী, আলাউদ্দিন খান ও মওলানা মোবারক আলী, মুসলিম লীগের আব্দুর রহমান বকাউল, আদেলউদ্দিন হাওলাদার, আবদুস সোবহান মোল্লা ও জলিল মৌলভী এবং পিডিবির রকিবউদ্দিন আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, খলিলুর রহমান ঠাকুর, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এমএন জামান, আবদুল করিম মিয়া, আবুল বাসার মিয়া, খন্দকার নুরুল হোসেন, মমতাজ হোসেন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের অধিকাংশই শান্তি কমিটিতে নাম লিখিয়েছিলেন। তারাও ছিলেন চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থী কিংবা জামায়াত মুসলিম লীগ, পিডিপির সমর্থক। ফরিদপুরে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া ছিলেন শান্তি কমিটির উদ্যোক্তদের মধ্যে অন্যতম। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নুরুল আমিনের নেতৃত্বে জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারী দলের মধ্যে তিনিও ছিলেন এবং তারা শক্র নিধনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার পরতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য পিডিপি, জামায়াত, মুসলিম লিগ প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী দলের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তিনি ওই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক জান্তা আয়োজিত প্রহসনমূলক উপনির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনে মনোয়নপত্র দাখিল করেন এবং তাঁকে জাতীয় পরিষদ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে করাচিতে তার মৃত্যু হয়। ফরিদপুরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় জামায়াতের মওলানা সৈয়দ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সক্রিয় ছিলেন। ফরিদপুরে পাকবাহিনী প্রবেশের পর তিনি ফরিদপুরে এসে দলীয় সমাবেশে সামরিক জান্তাকে সমর্থন জানিয় বক্তৃতা করেন। তিনি ফরিদপুরে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলার নেতৃত্ব দেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল কাদের মোল্লা সদরপুরে সমাবেশ করেন এবং আলবদর, রাজাকারদের সংগঠিত করেন। মে মাসে থানা পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যরা হলেন মাঈনউদ্দিন, চৌধুরী, খলিলপুরের জলিল মৌলভী, মাঈনউদ্দিন উকিল, আব্দুল ওহাব মিয়া, খলিল ঠাকুর প্রমুখ। চরভদ্রাসনে আব্দুল হাই চৌধুরীকে (মোক্তার) আহবায়ক করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সদস্যরা হলেন আবদুল মজিদ মোল্লা, বাবুল মৃধা চরহরিরাম পুরের আবদুল হাই খান প্রমুখ। সদরপুরে কনভেশন মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আদেলউদ্দিন হাওলাদারকে সভাপতি করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্যরা ছিলেন আইনউদ্দিন ফকির, আবদুর রশীদ ব্যাপারী, আমিন উদ্দিন খান, মোহাম্মদ আলী আকন প্রমুখ। আদেলউদ্দিনের নেতৃত্বে ঘরোয়া ও প্রকাশ্যে সমাবেশ হয়। ভাঙ্গাতে অ্যাডভোকেট আবদুল আলীকে সভাপতি করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সদস্যরা হলেন আখতারুজ্জামান (মন্নু চেয়ারম্যান), সাজাহান মাস্টার, আজিজ খলিফা, নুরুল হক মোল্লা, আপেল মাস্টার প্রমুখ। নগরকান্দায় মৌলভী আব্দুস সালামকে (কাজী মৌলভী) সভাপতি করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সদস্যরা হলেন ওয়াহেদ সর্দার, মজিবর রহমান, মকবুল খান, রুস্তম আলী খান, চান কাজী প্রমুখ। তাছাড়া জামায়াত নেতা মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ও মওলানা আবুল কালাম আজাদ খুন, লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্মের হোতা ও পাকসেনাদের চিহ্নিত দোসর। বোয়ালমারীতে এমএ ওয়াহিদকে (টেপু মিয়া) সভাপতি এবং সিরাজুল হক মৃধাকে (ছিরু মিয়া) সম্পাদক করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সদস্যরা হলেন জামায়াত নেতা ডা. ফজর আলী ও মওলানা জাকারিয়া, মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল করিম (বিষু মিয়া) ও রুস্তম আলী খান (কামারখালী), পিডিপির আবদুর রাজ্জাক মিয়া প্রমুখ। আলফাডাঙ্গায় মুসলিম লীগ সভাপতি আবু বকর মিয়াকে সভাপতি ও আনোয়ারুল হককে (নান্না ডাক্তার) সম্পাদক করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সদস্যরা হলেন আবদুল বারী মিয়া (মুক্তিযোদ্ধা কতৃক নিহত), উকিল শেখ (মুক্তিযোদ্ধা কতৃক নিহত), রুস্তম ফকির (মুক্তিযোদ্ধা কতৃক নিহত), সিদ্দিকুর রহমান, আবদুর রউফ মাস্টার প্রমুখ। ১২ জুন খানসামাপুরে ফরিদপুর শান্তি কমিটির আহবায়ক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন শান্তি কমিটির তৎপরতা বাড়ানোর আহবান জানিয়ে বক্তৃতা করেন। ২৮ মে ফরিদপুর শান্তি কমিটির সভা অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত হয়। আম্বিকা ময়দানে অনুষ্টিত সভায় অবিভক্ত ভারতের প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা প্রয়াত আম্বিকাচরণ মজুমদারের স্মৃতিবিজড়িত আম্বিকা ময়দানের নাম আজাদ ময়দান রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। অ্যাডভোকেট আফজাল রাষ্ট্রদ্রোহীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য আহবান জানান এবং পাকিস্তানের অস্তিত্বের ওপর ভারতীয় নির্লজ্জ হামলার নিন্দা করেন। ঐ সভায় আরো বক্তৃতা করেন অধ্যক্ষ এএইচএম মহিউদ্দিন আবদুর রাজ্জাক, খলিলুদ্দিন মিয়া, আবদুর রহমান বকাউল, মওলানা আবদুল আলী প্রমুখ। সভায় গৃহীত প্রস্তাবনা ছিল (১) সভায় পাকিস্তান রক্ষার জন্য আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করা হয়। (২) সভায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কতৃক দেশের বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলার জন্য যথাসময়ের গৃহীত উদ্যোগের প্রশংসা করা হয় এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকার ও দুষ্কৃতকারীদের দমনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানীদের প্রতি আবেদন জানানো হয়। (৩) সভা পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং কূটনৈতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘনের জন্য নিন্দা জ্ঞ্যাপন করে। (৪) সভা প্রত্যেক দেশপ্রেমী পাকিস্তানীকে শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য পাকসেনাদের সঙ্গে সহযোগিতার আবেদন করে। (৫) সভা প্রত্যেক পূর্ব পাকিস্তানীকে দেশ ও দেশের অর্থনীতি পুননির্মাণে আহবান জানায়। ২৮ জুন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার গৃহীত পদক্ষেপকে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করে বলেন, “এসব দুষ্কৃতকারীর হাতে নির্বাচনের ফলাফলকে নস্যাৎ করতে দেয়া যায় না। তার ভাষায়, শেখ মুজিব বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী, শঠ, বিচ্ছিন্নতাবাদী”। এই ভাষণকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেন অনেকের মধ্যে ফরিদপুরের শান্তি কমিটির আহবায়ক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। ফরিদপুরের আওয়ামী নেতা অ্যাডভোকেট কাজী খলিলুর রহমান, আবদুল জলিল মিয়া, আবদুস শুকুর, কামালউদ্দিন মিয়া দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। ২৩ জুলাই জেলা পরিষদ হলে (কবি জসীমউদ্দিন হল) শান্তি কমিটির সভা হয়। বক্তব্য রাখেন মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন ও সারোয়ারজান মিয়া, আওয়ামী লীগ থেকে সম্পর্ক ছিন্নকারী আদেলউদ্দিন আহমেদ এমএনএ, কাজী খলিলুর রহমান, অ্যাডভোকেট আমিরুজ্জামানসহ অনেকে। ১৪ আগস্ট ফরিদপুরের অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, অধ্যাপক মহিউদ্দিন ও মাওলানা মোবারক আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস’ উপলক্ষে সভা ও মিছিল হয়। ২০ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ২৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সেতু ধ্বংস উচ্ছৃংখল জনতার সমাবেশ এবং ভারতীয় সামরিক কর্মচারীরা সঙ্গে বেআইনি যোগসাজশে ইত্যাদির অভিযোগ এনে সামরিক কতৃপক্ষের সামনে হাজির হওয়ার জন্য সামরিকজান্তা যে ঘোষণা প্রদান করে তার মধ্যে ফরিদপুরের কোতোয়ালি-নগরকান্দা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কেএম ওবায়দুর রহমান ও ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুদ্দিন মোল্লার নাম ছিল। ১০ সেপ্টেম্বর ১৪৫ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের গৌরচন্দ্র বালা, ইমামউদ্দিন আহমেদ, ডা. আফতাব মোল্লা ও আমিনউদ্দিন আহমেদ। ৭ নভেম্বর ফরিদপুরে আলবদরের সভা হয়। এতে বক্তৃতা করেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ ইউনুস, সৈয়দ নজরুল হুদা প্রমুখ। খাড়দিয়ার মওলানা আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু) ছিল জেলা আলবদর প্রধান, সৈয়দ নজরুল হুদা তৈহিদ শহর আলবদর প্রধান, তারা দু’জনেই ইসলামী ছাত্র সংস্থার নেতা। আবুল কালাম আজাদকে নগরকান্দা, বোয়ালমারী, মুকসুদপুর ও কাশিয়ানীতে অনেক অপকর্মের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। আটবশির সাহাবুদ্দিন খান ছিল ফরিদপুর জেলা আলশামস বাহিনীর প্রধান আবদুল মান্নান ছিল জেলা যুব শান্তি কমিটির কনভেনর। সেদিন ফরিদপুর শহরে লুটপাট কিংবা সামরিক জান্তার সঙ্গে আরো যারা হাত মিলিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছিল, নারী ধর্ষণে সাহায্য করেছিল তাদের মধ্যে মাঈনউদ্দিন উকিল, মুসা বিন শমসের, জুলফিকার আলী, কামরুজ্জামান খান জাসু, ফাউল জাহাঙ্গীর, ইফতার ইফতু (আইনপুর), নঈম হোসেন চৌধুরীর ভূমিকা বহুলভাবে আলোচিত। রাজাকার বাহিনীর ফরিদপুরের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন আবুল কাশেম খান, আবদুল লতিফ মিয়া (দি ঢাকা গেজেট, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। রাজাকার বাহিনীতে জামায়াত, মুসলিম লীগ, পিদিপির রাজনৈতক সমর্থক ছাড়াও অশিক্ষিত বেকার যুবকদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে রিক্রুট করা হয়। যাদের প্রধানত ব্রিজ পাহারা, পাকসেনাদের অস্ত্র ও মালামাল বহনে নিয়োজিত করা হতো। পাক সেনাদের মুক্তিযোদ্ধা কতৃক আক্রমণের মুখে এই রাজাকাররা ছিল খুবই অসহায়, ভীতসন্ত্রস্ত তারা ব্যাপকভাবে আত্মসমর্পণ করে। তবে জামায়াত, মুসলিম লীগের যেসব কর্মী রাজাকারে নাম লিখিয়েছিল তাদের ভূমিকা ছিল হিংসাত্মক। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দুদের সম্পত্তি লুট করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রিপোর্ট করা, পাকসেনাদের পথ দেখিয়ে আনা, হত্যা, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মে তারা লিপ্ত হয়। রাজাকার কমান্ডারদের মধ্যে আলফাডাঙ্গার নাসির মওলানা, বোয়ালমারীর কোটন, নগরকান্দার আবু জাফর, ভাঙ্গার মুন্নু চেয়ারম্যান, সদরপুরের জলিল খান ও চরভদ্রসনের বাদশার ভূমিকা খুবই ন্যক্কারজনক।
[১৫] আবু সাঈদ খান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত