ফরিদপুরে প্রথম মুক্তিফৌজ দল গঠন
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]
অনাহার ও অনিদ্রায় আমাদের রাত কেটে গেল। সকালে দীপকদের বাড়িতে নাস্তা করলাম। খেতে খেতে মাজেদ মোল্লাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অস্ত্র তো আনলাম, কিন্ত এখন কি করা যায়?’
তিনি বললেন, ‘চলেন বড় ভাইজানের নিকট (আঃ আজিজ মোল্লা) গিয়ে পরামর্শ করি। তিনি অভিজ্ঞ লোক। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী।
২৩ এপ্রিল সকাল ৮টায় আমরা তার বাড়ি গিয়ে আজিজ মোল্লাকে সব কথা খুলে বললাম এবং অস্ত্র রক্ষার দায়িত্ব তার উপর দিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা বিষয়ে প্রস্তাব করলাম। সব শুনে তিনি বললেন, ‘এত সব করার পূর্বে তোমরা তো আমার সাথে কোন আলাপ করো নাই। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে, যেখানে দেশের প্রায় সব কিছুই পাকবাহিনীর হাতে, সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী গঠন করা যে কত বড় বিপদের বিষয় তা কি একটিবার চিন্তা করে দেখেছো?’
বললাম, ‘যা করবার তা করেই ফেলেছি, এখন চিন্তা করে কোন লাভ নেই। কাজেই এখন মুক্তিবাহিনী গঠন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই’।
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আল্লাহ ভরসা। যা হয় হবে। মুক্তিবাহিনী গঠনের দায়িত্ব আমি নিলাম। দেশের জনগণ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে, তখন আমরা জয় একদিন করবই ইনশাআল্লাহ’।
মাজেদ মোল্লাকে বললাম, ‘আপনি পুড়াপাড়া গিয়ে অস্ত্রের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। কোন রকম অসুবিধা হলে সত্ত্বর জানাবেন। আমি আগামীকাল সকালে আজিজ মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে আসছি। আরও বললাম, ‘ঐ এলাকার যত মঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার ও পুলিশের যত লোকজন আছে সবাইকে খবর দিয়ে হাজির রাখবেন’। মাজেদ মোল্লা চলে গেলেন।
পরদিন সকালে সূর্য মিয়া, গোলাম রসূল ও অন্যান্য সকলের সাথে আলাপ আলোচনা করে মুক্তিবাহিনী গঠনের চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম এবং সর্বসম্মতি ক্রমে আজিজ মোল্লাকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করে তাঁর উপর দল গঠনে সব দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। ২৪ এপ্রিল ওবায়েদ ভাই সেলিম, বাবুল, মজনু কয়েকজসহ টেংরাখোলা গিয়েছিলেন। ওখানকার পাকসেনা সহযোগী ওহাব মিয়া, জলিল মিয়া ও নয়া মিয়া প্রভৃতি তাঁদেরকে ধরার জন্য আক্রমণ করে আর দুষ্কৃতিকারী বলে গালাগালি দেয়। এই অবস্থা দেখে ওবায়েদ ভাইয়ের সাথে ছেলেরাও ক্ষেপে যায় এবং পাকসহযোগীদের লক্ষ্য করে মজনু স্টেনগানের গুলি করে। এখানে থাকা নিরাপদ মনে না করে তিনি ঐ রাতেই উড়ার বিরে ফিরে এসে সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন সকালে পুড়াপাড়ায় আমার সাথে দেখা হয়। মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দেন। তারপর তিনি এই স্থানে উপস্থিত লোকজনের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। ভারত যাওয়ার পূর্বে ওবায়েদ ভাইয়ের সাথে ঐ দিনই আমার শেষ দেখা।
দুই দিন পরে সালতা নদীর ভেতর দিয়ে যাবার সময় স্থানীয় কিছুসংখ্যক স্বাধীনতা বিরোধী লোক তাদেরকে আক্রমণ করলে ওবায়েদ ভাইয়ের সাথের ছেলেরাও কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। আক্রমণকারীরা ভয়ে পালিয়ে যায়। অতঃপর তিনি সালতার হাটে পৌঁছেন। সেখানে ওবায়েদ ভাই তাঁর নিজের পরিচয়ে বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন। সেখানে মাওলানা ফায়জুর রহমানের সাথে তাঁর দেখা হয়। মুক্তিবাহিনী ছেলেদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মাওলানা ফায়জুর রহমানও ইউনুস আলীর দায়িত্বে রেখে ওবায়েদ ভাই ভারত অভিমুখে রওয়ানা হলেন। বাবুল, সেলিম, মোজাম, মজনু প্রভৃতিও ওবায়দুর ভাইয়ের সাথে ভারতে রওয়ানা হয়। বহু কষ্টে করে চারদিন হাঁটার পড়ে তাঁরা কলকাতা পৌছেন।
[৬৩৫] মোঃ সোলায়মান আলী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত