ফরিদপুরে প্রথম প্রতিরোধ
[প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা]
আকস্মিকভাবে পঁচিশে মার্চ গভীর রাতে রাজধানীতে পাকহানাদারবাহিনী হামলার খবর, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের কথা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ছাব্বিশে মার্চ সকাল বেলাই পেয়ে গেলা। এ খবর পাওয়ার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফরিদপুরের পুলিশ ব্যারাক এবং বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ফরিদপুরের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে উঠল ঢাকা ফেরত কিছু ইপিআর এসে এতে যোগদান করলেন। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় এভাবে জনতার প্রতিরোধের সাড়া পড়ে গেল। তখন প্রয়োজন দেখা দিল সমন্বয় ও প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদানের। খুব সম্ভবত ২৯ মার্চ তদানীন্তন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কে এম ওবায়দুর রহমানকে আহবায়ক করে এডভোকেট আদেল উদ্দিন, ইমামউদ্দিন আহমেদ, শামছুদ্দিন মোল্লা, সৈয়দ হায়দার হোসেন, মোশাররফ হোসেন, নূরুন্নবী, কাজী খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান খান, গৌরচন্দ্র বালা, ফিরোজার রহমান, আমিনউদ্দিন, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় জননেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাসিরুদ্দিন মুসা, শাহ আবু জাফর, কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহমদ, আবু সাঈদ, আতিয়ার প্রমুখ ছাত্র ও জনপ্রতিনিধিমূলক নেতা ও কর্মীদের নিয়ে জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিকভাবে ফরিদপুরের প্রশাসন ও তদারকি কাজ পরিচালনা করতে থাকে। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন তখন এ এন এম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার ছিলেন নূরুল মোমেন খান। পরবরতীকালে ফরিদপুরে পাকহানাদার বাহিনী প্রবেশের পরেই ধৃত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে বিশেষ করে লিয়াকত আলী হোসেন, আব্দুস সালাম মিয়া, আজম আমীর আলী, আ.ন.ম. আব্দুস সোবহান, মিছির কর্মকার, আতহার হোসেন, শামসুল হক, তারাপদ ঘোষ এবং অনেকের কথাই স্মরণ করা যায়। এছাড়াও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরের প্রত্যেক মহকুমায় স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজশাহীতে মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন, মোসলেম আলী মৃধাসহ জননেতা ডাঃ এস এ মালেক, ওয়াজেদ চৌধুরী, নূরুল ইসলাম, মরহুম আবদুল জলিল, আবদুল হাই, চিত্তবাবু, আলী আক্কাস এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুল জব্বার, নাজিবর, ফজলু, রেজা, তাপস প্রমুখ।
ফরিদপুর জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটির মূল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলা ঝিলটুলীতে এবং সেখান থেকে প্রত্যেকটি মহকুমায় যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। হানাদারবাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত এ দিনগুলো ছিল ফরিদপুরের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সময়কাল। ফরিদপুরে প্রতিরোধ সেই সাতশটি দিন মনে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভূখণ্ডে বাস করছি। কোথাও কোন আইন-শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ যেন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত নতুন জীবনের পথে স্বাভাবিক পথ চলা। ঢাকা থেকে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাকহানাদার বাহিনীর অনেক কুকীর্তি শুনতে পেলাম এবং ফরিদপুরে আমরা আতংকিত হলাম। সম্ভবতঃ ১ এপ্রিল তারিখে প্রয়াত নেতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীর পথে পৌঁছলেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে পরের দিন চলে গেলেন। ১৭ এপ্রিল বাংলার মাটিতে মেহেরপুরে মুজিবনগরে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণার কথা জানতে পারলাম এবং ফরিদপুরকেও আমরা তখন মুক্ত এলাকার একটা অংশ হিসেবে গর্ব অনুভব করলাম। আমরা তখন ফরিদপুরের স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময় ফরিদপুরবাসীদের সার্বিক সুখ-দুঃখ এক উচ্ছ্বাসময় শিহরণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। কখন হানাদারবাহিনী ঢুকে পড়ে সেটাই ছিল সার্বক্ষণিক চিন্তা। দেশের অন্যান্য জায়গায় পাকবাহিনীর নারকীয় অমানবিক দস্যুতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের বেশি ভয় ছিল প্যারাটুপ হানাদার বাহিনী নামলে প্রতিরোধ করার কোন অস্ত্র আমাদের হাতে ছিল না। নদীপথে গোয়ালন্দঘাট, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর ছাড়াও স্থলপথে পাংশা ও কামারখালীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, যাতে করে কুষ্টিয়া কিংবা যশোর হয়ে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রতিহত করা যায়। দিবা-রাত্র চব্বিশ ঘন্টা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের কন্ট্রোল রুম কর্মব্যস্ত থাকত এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিক তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হত। ফরিদপুর ছিল ভারত অভিমুখে শরণার্থীদের অনেকেরই মাঝপথ। অনেক নেতা ও কর্মী ঢাকা থেকে ভারত যাওয়ার পথে ফরিদপুরে বিশ্রাম নিয়ে যশোর হয়ে চলে যেতেন। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অনেক নেতৃবর্গই ফরিদপুরে অবস্থান নিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি, মাদারীপুর শহর থেকে লোকজন পরিবারপরিজনসহ গ্রাম এলাকায় চলে যেতে লাগলেন। একটা আসন্ন সংঘাতের মুখোমুখি। আমরা প্রশাসন কর্মকর্তা ও প্রতিরোধে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহরে রয়ে গেলাম। আমরা শহরে প্রবেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং রাস্তার উপর ব্যারিকেড তৈরি করলাম। ২১ এপ্রিল ভোর রাতে হানাদার বাহিনী সুসজ্জিত গানবোট দিয়ে প্রথমে গোয়ালন্দঘাট প্রতিরোধ করল। আমাদের প্রতিরোধের কর্মীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে, কিন্ত দূর থেকে অবিরাম মর্টার-এর শেল বর্ষণের মধ্যে সকাল নটায় হানাদারবাহিনী গোয়ালন্দঘাট দখল করল এবং একইসঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে জঙ্গীবাহিনী অবতরণ করতে লাগল। নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ফরিদপুর শহর ত্যাগ করতে লাগলেন।
আমি সকাল দশটার দিকে ইপিআর-এর একজন প্রতিরক্ষা কর্মী সদস্য কবিরুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে নড়বড়ে একটা জীপে করে কামারখালীর দিকে রওয়ানা হলাম এবং কে এম ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন। অন্য নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে শহর ত্যাগ করলেন।
[৬৩৫] মো. সোলায়মান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত