You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.11 | পিংলার কান্দি যুদ্ধ, বড়লেখা, সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

পিংলার কান্দি যুদ্ধ, বড়লেখা, সিলেট

কচুরিপানা ও ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়ে সমগ্র হাওর বিস্তৃত। গেরিলা যুদ্ধের একটি উর্বর ক্ষেত্র বলা যায় এ হাওরকে। এখানে বেশ কিছু লড়াইয়ে পাক হানাদারদের পর্যুদস্ত করেছিল মুক্তিসেনারা। সেপ্টেম্বর মাস। সুজানগর গ্রাম এবং তার পশ্চিম প্রান্ত ঘেষে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার আগমনে আক্রমণ জনগণ উল্লসিত। তবে পাক সেনাদের স্থাবর রাজাকার সদস্যরা সক্রিয়। এসব অনুচর দালালদেরই একজনের নেতৃত্বে কুখ্যাত রাজাকাররা অতর্কিতে আক্রমণ চালায় মুক্তি বাহিনীর জোয়ানদের উপর। কিন্ত সদাজাগ্রত মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে জাতিদ্রোহীরা পালিয়ে যায়। আহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমদ। মুক্তিসেনারা এভাবে গ্রাম ছেড়ে আরো পশ্চিমে সরে গিয়ে হাওরের কান্দিতে অবস্থান করে। ইচ্ছা ছিল দিনটা কাটিয়েই তারা গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। কিন্ত না নির্বিঘ্নে তাঁদের স্থান ত্যাগ করার উপায় নেই। সাড়ে এগারটার মধ্যেই গ্রামের পূর্বদিক থেকে মিলিশিয়া বাহিনীর একটি গ্রুপ এবং উত্তর দিক থেকে রাজাকার বাহিনীর আরো একটি দল এক যোগে আক্রমণ চালায় মুক্তিসেনাদের উপর। কিন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও সম্মুখযুদ্ধে কম যাননি। উল্লেখ্য, এখানে মুক্তিবাহিনীর পুনঃপৌনিক আক্রমণ অভিযানের পেছনে স্পষ্ট কারণ ছিল। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মুজিবনগর সরকারের হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তে অনিয়মিত বাহিনীর এক বিরাট অংশ দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সৈন্য চলাচলে বাঁধা দান, নির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপর আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। এরকম একটি গ্রুপকে ৪নং সেক্টরের কুকিরতল সাবসেক্টর থেকে অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। ফেঞ্চুগঞ্জের চান্দভাগ চা বাগানে তাদের অবস্থান নেয়ার কথা। ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার এ দলের কমান্ডার ছিলেন বিয়ানীবাজারের ন্যাপনেতা আবুল খায়ের চৌধুরী। ডেপুটি কমান্ডার ছাত্র ইউনিয়ন নেতা তজমুল আলী। দলটিকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল লুৎফুর রহমান এম পি ও তথ্য সংগ্রহ আক্তার আহমেদের উপর। কিন্ত এক পর্যায়ে তারা উভয়েই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আবুল খয়ের চৌধুরী আবুল ময়িদ চৌধুরীর মাধ্যমে মানচিত্র, পথপ্রদর্শক ও অন্যান্য ব্যবস্থা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বরলেখার ডিমাই এলাকা থেকে ১১ সেপ্টম্বর রাতে রওয়ানা হয়ে ভোর হবার আগেই ফেঞ্চুগঞ্জের কিনার দিয়ে রেলপথ অতিক্রম করার কথা। দূরত্ব সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতার অভাবেই তাদের পরিকল্পনায় ভূল হয়। রাত ভোর হয়ে যায় সুজানগর গ্রামে। ফলে এসব অপ্রাত্যাশিত আক্রমণ ও যুদ্ধ। দ্বিতীয় বার আক্রমণ প্রতিহত করার পর মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বনের কথা চিন্তা করতে থাকেন। কারণ এখান থেকে লোকবল ও অস্ত্র ক্ষয় করা নয় নির্দিষ্ট স্থানে পৌছানই তাদের লক্ষ্য। সেখানে তারা সম্পাদিত করবেন একটি পরিকল্পিত কাজ। তাই স্থান পরিবর্তনের চিন্তা করা হয়। একই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ও প্রচুর সংখ্যক সৈন্য নিয়ে পাক হানাদার সৈন্যরা অগ্রসর হতে থাকে। প্রায় আড়াইটার দিকে গ্রামটির উত্তর পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে একযোগে আক্রমণ রচনা করে বসে তারা। হাকালুকি হাওরকে দক্ষিণ দিকে রেখে বাকী তিন দিক থেকে পাক সেনারা ভারী অস্ত্র শস্ত্র সহযোগে আক্রমণ রচনা করে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা আবুল খয়েরের যোগ্য নেতৃত্বে শক্রর সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। হাকালুকির কান্দিতে কাঁদা জলে অবস্থান নিয়ে হালকা অস্ত্র দিয়েই পাক হানাদারদের মোকাবেলা করে মুক্তিযোদ্ধারা। এক ঘন্টা ব্যাপী স্থায়ী এ যুদ্ধে পঁচিশ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত ততোধিক। অন্যরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। মুখোমুখি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৪ জন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা গর্বিত মৃত্যুবরণ করে। তারা হলেন বিয়ানীবাজারের আব্দুস শহীদ, মদন আলী, ঢাকার আনোয়ার হোসেন, গোলাপগঞ্জ থানার আরো এক বীর সন্তান। মারাত্মকভাবে আহত হন সহকারী কমান্ডার তজম্মুল আলী, বালাগঞ্জের আবদুল খালিক ও আর চার জন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদদের জানাজা পড়ার পর তাঁদের লাশ সহযোদ্ধাদের অশ্রুজলে ভাসিয়ে দেন হাওরে।
[৯৩] মোস্তফা সেলিম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত