পিরোজপুর এমবুশ
মুক্তিবাহিনী কালিগঞ্জ থানার পিরোজপুর থেকে প্রায় আধা মাইল পশ্চিমে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে অবস্থান করছে। আর এ অবস্থানের কারণে হানাদারবাহিনী দক্ষিণে যেতে পারছে না। বস্তুতঃপক্ষে মুক্তিবাহিনীর এ প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল পাকহানাদারবাহিনীর জন্য লোভনীয় টোপ। মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ অধিনায়কগণও জানেন একদিন না একদিন মিলিটারীরা তাঁদের এ প্রতিরক্ষা দুর্গে হানা দেবে আর সেই সুযোগটাই গ্রহণ করবে মুক্তিবাহিনী। ওদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশে এসে যুদ্ধ করার মজাটা বুঝিয়ে দেবে। এই প্রতিরক্ষার গুরুদায়িত্বের অধিনায়ক ওয়াহিদুজ্জামান এবং সঙ্গে আছেন লিয়াকত, গফুর, আকবর, মোকাররম, আক্কাছ উদ্দীন, সামাদ, রাজ্জাকসহ অসীম সাহসী ৪০/৪৫ জন বিশেষ কমান্ডো। সকলেই দিন গুনছেন কবে কখন জামাইরা (মিলিটারী) আসে। কারণ গোলাবর্ষণ করে ওদের উপযুক্ত অভ্যর্থনা জানাতে হবে।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। অবশেষে খবর পাওয়া গেল তারা আসছে। সময় তখন রাত ৯টা আকাশে চাঁদটা জেগে জেগে কিরণ দিচ্ছে আর মাঝে মধ্যে মেঘে ঢাকা পড়ছে। মুক্তিবাহিনীর সবাই সজাগ। ওদের আগমণে গভীরভাবে প্রতীক্ষারত। সিএন্ডবি রাস্তার পূর্ব দিকে একদল এলএমজি, এসএলআরসহ আর পশ্চিম দিকে আক্কাছ উদ্দিনের নিকট এলএমজি আর মোকাররমের নিকট দুই ইঞ্চি মর্টার এবং অন্যান্যরাও বিভিন্ন দূরপাল্লা অস্ত্রে সুসজ্জিত। অধিনায়ক ওয়াহিদ লিয়াকতও অন্যান্যদের নিয়ে পীরোজপুর ব্রীজের কাছে অবস্থান করছে।
সম্ভবত অতর্কিত আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার দুর্বার দিবা স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাকসেনারা রাজাকারদের নিয়ে কালিগঞ্জ থেকে সিএন্ডবি রোড ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। আর যমুনার খাল ব্যবহার করে ৪ খানা বড় নৌকায় ৫০/৬০ জন খানসেনা শ্যামনগর থানা অভিমুখে যাচ্ছিল। এদের ধারণা ছিল চাঁদনি রাতে যমুনার খালের ধারে কে আর বাঁধা দেবে, মুক্তিবাহিনী কি আর এই রাতে এখানে থাকবে? তাদের যাত্রা নিষ্কন্টক মনে করে হাসি-ঠট্টা আর গল্পগুজবে মেতে ছিল।
পরপর কয়েকজন গোয়েন্দা এসে মিলিটারীর এ নৈশ অভিযানের খবর দিল অধিনায়ক ওয়াহিদকে। সাথে সাথে সবাই প্রস্তুত। এত দিন পর জামাইরা যখন আসছে তখন ওদের উপযুক্ত অভ্যর্থনা করতেই হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সবাই নিজ নিজ অবস্থান নিল, মূল প্রতিরক্ষা অধিনায়ক ওয়াহিদের পরিকল্পনা, এলাকা থেকে আরো আধা মাইল সামনে এসে মুক্তিবাহিনী এমবুশ করে হানাদারবাহিনীর মুখোমুখি হবে। পাকবাহিনীর কল্পনায় এটা আসেনি যে মূল প্রতিরক্ষা এলাকা রেখে মুক্তিবাহিনী এসে এমবুশ করে তাদের উপর আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখাবে। সত্য কথা বলতে কি, অস্ত্রের চেয়েও মুক্তিবাহিনীর সাহস আর কৌশলের উপর নির্ভর করত বেশি।
মুক্তিফৌজরা স্পষ্ট চাঁদের আলোয় পাকবাহিনীর এগিয়ে আসা দেখতে পাচ্ছে-ওরা সব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তারা রেঞ্জের মধ্যে আসে। ওদের আঙ্গুলগুলো ট্রিগারে নিশপিশ করছে কখন চাপ দেওয়ার সুযোগ হবে। চাঁদটা কিছুটা মেঘ ঢাকা। পাকা রাস্তায় তারা বেশ দ্রুত এগিয়ে আসছে। অধিনায়ক সঙ্গীদের নির্দেশ দিলেন, যে মুহূর্তে তিনি ‘থাম’ বলে পাকসেনাদের থামাবেন-সেই মুহূর্তে যেন সবার অস্ত্র একযোগে শক্রর উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ওদের সুযোগ ও সময় দেয়া যাবে না। সকলে একরকম নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে। এই আসে, এমন সময় অধিনায়কের কন্ঠে শোনা গেল ‘থাম’। আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে সবার হাতিয়ার গর্জে উঠল। খানসেনারা পজিশনে যাবার পূর্বেই ওদের মেরুদন্দ একদম ভেঙে গেল, বেশ নিহত আহত হল এ আচমকা আক্রমণে। মুক্তিবাহিনী তখন সুযোগ বুঝে আক্রমণ আরো তীব্র করল; আর ওদিকে নৌকায় যারা ছিল তাদের অবস্থা আরো করুণ। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করা বা জবাব দেয়ার কোন ক্ষমতা ওদের ছিল না। মাত্র আধাঘন্টার যুদ্ধ, তাতেই তারা কুপোকাত। খানসেনাদের করুণ আর্তচিৎকার দ্বিগ্বিদিক ছড়িয়ে গেল।
আক্রমণের মূল লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় অধিনায়কসহ সবাই আনন্দিত। মাত্র আধঘণ্টার এমবুশ আক্রমণে পাকবাহিনী অগ্রযাত্রা পুরোপুরি প্রতিহত হল, হল নাস্তানুবাদ, জীবিতরা দ্রুত কিছু লাশ ফেলে কিছু লাশ নিয়ে পালিয়ে গেল। যমুনার খালে আর সি এন্ড বি রাস্তায় লাশ পড়ে থাকল। এত স্বল্প সময়ের যুদ্ধে এত বড় সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দারুণভাবে বৃদ্ধি করে দিল। মুক্তিবাহিনীর কেউ শহীদ বা আহত হয়নি। এলাকার শান্তি কমিটির মারফত জানা গেল ওদের মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৫০ জন, আহত আরো ২০/২৫ জন। এই ঘটনার ৩ দিন পর পাকবাহিনী কয়েকটি ট্রাল, জীপসহ এসে দু’দিকে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়। তখন মুক্তিবাহিনী এ এলাকা থেকে বহু বহু দূরে তারা তা জানে না।
মুক্তিবাহিনীর এ সাফল্যে এতদ্বঞ্চলের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে চিরস্মরনীয় ঘটনা হিসেবে বিরাজ করছে।
[৫৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত