You dont have javascript enabled! Please enable it!

পুটিয়া অপারেশন, নরসিংদী

পুটিয়া বাজারসংলগ্ন পুটিয়া সেতুটি পাকবাহিনীর যোগাযোগ ও রণকৌশলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নরসিংদীতে তখন পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি এবং এই ঘাঁটির মাধ্যমে এরা শিবপুর, মনোহরদীর মতো উত্তরাঞ্চলীয় থানাসমূহে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালাত। আর নরসিংদী থেকে এই সকল অঞ্চলে যাওয়ার উপায় ছিল নরসিংদী-শিবপুর সড়ক, যার ওপর এই সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রক্ষা করছিল। সেতুটি সার্বক্ষণিক পাহারাধীন থাকত। পাহারার দায়িত্ব ছিল পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী। উল্লেখযোগ্য যে, সেতুটির দক্ষিণ পাশের ঘোড়াদিয়া ও আশপাশের গ্রামের বেশ কিছু যুবক সে সময় রাজাকার-আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এবং হানাদারদের সহযোগী শক্তি হিসেবে নানা অপকর্মে লিপ্য হয়েছিল। এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সেতুটি উড়িয়ে দেয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহ প্রাধান্য পায়:
(১) এই সেতুটি বিধ্বস্ত হলে নরসিংদী কিংবা ঢাকা থেকে পাকবাহিনী শিবপুর অঞ্চলে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হতে পারবে না।
(২) এর ফলে সমগ্র উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিচালনা সহজতর হবে এবং ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা গেরিলা অবস্থান ও মুক্তাঞ্চলসমূহ সুরক্ষিত হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। স্থির হলো, রাতের অন্ধকারে সেতুটি উড়ানোর আগে কোনক্রমেই শক্রর সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না। শক্রর টের পাওয়ার আগেই সংগোপনে এ কাজটি সারতে হবে। আর এই জন্য প্রায় সারা রাত কষ্টকর অপেক্ষার পর ভোর রাতে এক সুযোগে একটি ছোট অথচ দুঃসাহসী বিস্ফোরক দল সেতুর নিচে গিয়ে এর মাঝে ডিনামাইট-বিস্ফোরক লাগাতে সমর্থ হয়। সে সময় দলের অপর অংশ যথাযথ অবস্থানে থেকে কভারিং-এর দায়িত্ব পালন করে, সে এক শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত। অতঃপর শক্রবাহিনী কোনো কিছু আঁচ করার আগেই বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। প্রচণ্ড শব্দে চারদিক তোলপাড়করে সেতুটি ধসে পড়ল। সেতু উড়ানোর পর এক অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন দেখা দিল। বিস্ফোরণের শব্দ নিশ্চয়ই নরসিংদীতে পৌঁছেছে। তাছাড়া দালাল বাহিনী নিশ্চয়ই তাদের সবকিছু জানাবে। এর ফলে সকালে পাকবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে, এসব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতিতে এরা অসহায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায় এবং হত্যা, সম্পদ বিনাশ ও ঘরবাড়ি পোড়ানোর পোড়া মাটি নীতি অবলম্বন করে থাকে। পুটিয়াতে এমনটি করা হবে এই আশঙ্কায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো যে, জনসাধারনকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। এছাড়া হানাদারদের সাথে এমন একটা নিশ্চিত মোকাবিলার সুযোগ নষ্ট করাও উচিত হবে না। অতএব শক্রর সতর্ক প্রতীক্ষায় নদীর উত্তর পাশে বিভিন্ন রেঞ্জের অস্ত্র নিয়ে পজিশন নেয়া হলো। কিন্ত সমস্যা হলো আশেপাশের গ্রামের হাজার হাজার উৎসাহী জনতাকে নিয়ে। এরা সকাল থেকেই ভিড় করেছে কীভাবে সেতু বিধ্বস্ত হলো, গত রাতে মুক্তিবাহিনী কী অসাধ্য সাধন করল তা দেখার জন্য। অনেক কষ্টে জনতাকে নিরাপদ অবস্থানে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্ত না, জনতা তো মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকতে চায়। এ যেন খালি হাতেই শক্রর মোকাবিলা করার উদ্যোগ। অবশেষে সকাল দশটার দিকে নরসিংদী থেকে হানাদারদের একটি শক্তিশালী সুসজ্জিত বাহিনী পুটিয়ার নিকটবর্তী হলো। তাদের এ অগ্রাভিযানে কোনো বাঁধার সৃষ্টি করা হলো না। এরা ইতস্তত গুলু ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে। কিন্ত মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো জবাব নেই। এতে করে পাকবাহিনী দ্বিগুণ উৎসাহে এগিয়ে এসে যেই মুক্তিবাহিনীর রেঞ্জের মধ্যে সড়কের উপরিভাগে উঠে এসেছে, অমনি এ পাড় থেকে একযোগে আক্রমণ করা হলো। একযোগে এলএমজি থেকে ব্রাশফায়ার করা হলো। পাকবাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম ধাক্কায় চৌদ্দজন নিহত হলো। এদের মধ্যে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনও ছিল। রাস্তার ওপরে থাকায় নিরাপদ অবস্থানে ব্যাক করার সুযোগ আর এরা পায়নি। যারা অক্ষত ছিল তারা কোনক্রমে পিছু হটে গিয়ে প্রায় একঘন্টা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে তাদের ৩১ জন নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়। এসব লাশ ফেলে রেখে অতঃপর অবশিষ্টরা রণে ভঙ্গ দিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পালিয়ে নরসিংদী ফিরে যায়। যুদ্ধ জয়ের পর জনগণের সে কি উল্লাস। সে দৃশ্য বর্ণনার নয়। ভোলার নয়। অপ্রতিরোধ্য ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পদাতিক বাহিনী বলে খ্যাত পাকবাহিনীর সুসজ্জিত দল অপেক্ষাকৃত অনেক ক্ষুদ্র, অনভিজ্ঞ, তুলনমূলকভাবে অল্প রেঞ্জের অস্ত্রবলে বলীয়ান মুক্তিবাহিনীর হাতে সম্মুখ সমরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পরাজিত হলো। জনতা তা উপভোগ করল আর তার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল। তাদের আত্মপ্রত্যয় যেন আকাশচুম্বি হয়ে দাঁড়াল। যুদ্ধে যে ৩১ জন নিহত হয় তার মধ্যে ক্যাপ্টেন সেলিম এবং সুবেদার ইস্কান্দরের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের সামরিক ব্যাজ এবং পরিচয়পত্র খুলে পরবর্তীতে তা ভারতে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। উপরন্ত প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। জনতা পাকবাহিনীর উল্লেখিত ৩১ টি লাশ নদী পার করে এপারে নিয়ে আসে। বিজয়ের এই খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী ও বিবিসি থেকে ফলাও করে উপুরযপরি প্রচার করা হয়।
[১২৭] সিরাজ উদ্দীন সাথী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!