পুবাইল রেলওয়ে ব্রিজের যুদ্ধ, ঢাকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইনে টঙ্গীর অদূরে বালু নদীর উপর পুবাইল ব্রিজ অবস্থিত। এটি টঙ্গী থেকে ১০কি.মি. উত্তর পূর্ব দিকে এবং কালিগঞ্জ থেকে ৮ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মার্চের শেষ দিকে ভাওয়াল রাজবাড়ি ও সমরাস্ত্রকারখানা দখল করে নেয়। আনুমানিক ২৯ মার্চ এর দিকে পূবাইল রেলওয়ে স্টেশন এবং রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পাকবাহিনী অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে তারা এ অবস্থান থেকে এলাকার নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালাত। ফলে লোকজন বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায় এবং দেশের মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে সার্বক্ষণিক ভাবে ব্যস্ত রাখে। এই এলাকায় পাকসেনাদের এক কোম্পানি জনবল অবস্থান নিয়েছিল। প্রায় ৫০-৬০ জনের একটি পাকিস্তানী সৈন্য দল পূবাইল রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় এবং আনুমানিক ৩০-৪০ জনের একটি দল পূবাইল রেলওয়ে স্টেশন ও রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অবস্থান নিয়ে ছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে ১২/১৩ জনের একটি দল মেজবাহ উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে ৪০ জনের একটি দল মো. রুহুল আমিন সরকারের নেতৃত্বে এবং ২০ জনের একটি দল অরুণ ডি কস্তার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছিল। মিত্রবাহিনী এ যুদ্ধে মর্টার এবং আর্টিলারির ব্যবহার করেছিল।
নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন বেড়ে যায়। তারা বিভিন্নভাবে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবার পর এলাকায় পাকবাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন এলাকা তাদের অবস্থান গুটিয়ে নেয়। পূর্ব রণাঙ্গনের কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া ও নরসিংদী এলাকা থেকে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে টংগীর কাছাকাছি পূবাইল রেল স্টেশনে জড়ো হতে থাকে এবং সেখানে অবস্থান আরো জোরদার করে। ৮/৯ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জের পতনের পর পাকিস্তানীরা ট্রেনে করে পূবাইল-রেলওয়ে স্টেশনে জড়ো হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়ে পুবাইল এলাকায় বালু নদীর পূর্বপাড়ে পিপুলিয়া ও কাকলিয়া গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে। মিত্রবাহিনীর মর্টারগুলো ব্রিজ থেকে ২ কি.মি. পূর্ব দিকে নলছটা গ্রামে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানীদের একটি দল বালু নদীর পশ্চিমপাড়ে রেলওয়ে ব্রিজ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় এবং অপর একটি দল রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে ১৩ ডিসেম্বর বিকালে রেকি সম্পন্ন করে এবং পাকিস্তানী অবস্থানের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৩ ডিসেম্বর রাত ৮ টার দিকে মিত্রবাহিনী পাকিস্তানী অবস্থানের উপর গোলান্দাজ গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রথম গোলাটি নিজেদের অবস্থানের উপর পড়ে এবং সাথে সাথেই একজন ভারতীয় সৈনিক মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রুহুল আমিন সরকার তাঁর দল ও মিত্রবাহিনীর একটি প্লাটুন নিয়ে দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে বালু নদীর অতিক্রমণ করে উলুখোলা বাজার হয়ে পূবাইল রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে রেল লাইনে ব-কিং পজিশন নেয় এবং রেল লাইনে মাইন পুঁতে রাখে। মেজবাহ উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় এক প্লাটুন সৈন্য পাকিস্তানী অবস্থানের উপর ক্রমাগত গুলিবর্ষণ করতে থাকে। অরুণ ডি কস্তার নেতৃত্বে তার দলটি দক্ষিণ দিক দিয়ে বালু নদী অতিক্রম করে ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র এলাকায় পাকিস্তানীদের ঘেরাও করে ফেলে।
পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন প্রতিদিন খাবার ও অন্যান্য রসদ সামগ্রীসহ ট্রেনে করে ঢাকা-টঙ্গী থেকে পূবাইল রেলওয়ে স্টেশনে আসত। ১৩ ডিসেম্বর ভোরে ট্রেনে করে রসদ নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে পালিয়ে আসা পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ে ট্রেনটি রওয়ানা হলে মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের সাহায্যে ট্রেনটি উড়িয়ে দেয় এবং বেশকিছু পাকিস্তানী সৈন্য এখানে হতাহত হয়।
মিত্রবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানী বাহিনী রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে এবং আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়। তখন মেজবাহউদ্দিন সরকার তার দল নিয়ে নদী অতিক্রম করে ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হন। ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থানরত পাকিস্তানীরা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ে এবং একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কিছু পাকিস্তানী সৈন্য টঙ্গী দিকে পালিয়ে চলে যায়।
এখানে ৮/৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েক জন আহত হয় ও আনুমানিক ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফ আকন্দ শহীদ হন এবং একজন ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। এছাড়াও কাজী শহজাহান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত