You dont have javascript enabled! Please enable it! পার্বতীপুরের আক্রমণ, দিনাজপুর - সংগ্রামের নোটবুক

পার্বতীপুরের আক্রমণ, দিনাজপুর

দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানা। থানা সদরে পাকিস্তানীদের ক্যাম্প ছিল। পার্বতীপুর এবং সৈয়দপুরে রেললাইনের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের সব কিছুই পরিবহন করা হয়তো। সুতরাং এই রেল লাইনের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ রেল ব্রিজ রক্ষার্থে শক্ররা প্রহরা দিত। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন খালেদ তার দলবল নিয়ে ফিরে যাওয়ার পর কমান্ডার এটিএম হামিদুল হোসেন তারেক পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরের মাঝামাঝি রেলসেতুটি উরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেতুটির ওপরে এক প্লাটুন শক্র ও রাজাকাররা বাঙ্কার করে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়েছে। কমান্ডার প্ল্যান করলেন, দূর থেকে ২ ইঞ্চি মর্টার ও এসএমজির হ্যারাসিং ফায়ার দিয়ে কেটে পড়বেন। প্ল্যান মোতাবেক সেই রাতে সেতুটির পাশের গ্রামে গেলেন তিনি। কমান্ডার তারেক আর আবু এক বাড়িতে আর শাহনাজ ও অন্য চারজন রইল রাস্তার অপর পাশে এক বাড়িতে। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তারা শুয়ে পড়লেন। অনেক বেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে সকালের কাঁচা রোদে ঝলমল করছে গোটা এলাকা। বাইরে এসে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পেলেন, লোকজন দৌড়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। একজন গ্রামবাসী বলল, পাশের গ্রামে শক্র এসেছে। রাস্তা ধরে ওরা এদিকে আসছে। যে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সেটার সামনে ধান মাড়ানোর খোলা মাঠ। মাঠের ত্রিশ-চল্লিশ গজ দূরেই একটা আখক্ষেত। দৌড়ে আখক্ষেতের ভেতরে গেল সবাই। ওখানে এসএলআর হাতে পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বসে রইলেন। রাস্তা ও মাঠটাতে কেউ এলেই দেখতে পাবে, কারণ রাস্তাতা বাড়ির পেছন হয়ে মাঠের পাশ দিয়ে চলে গেছে। সামনের গ্রাম থেকে যুবক, যুবতী, ছেলেমেয়েরা দৌড়ে রাস্তা ধরে পেছনে পালাচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল। এখন আর রাস্তা দিয়ে লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে না। তবে গুলির আওয়াজ আসছে সামনের দিক থেকে। হঠাৎ দেখতে পাওয়া গেল একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। তার পেছনে ধাওয়া করছে দুজন পাকিস্তানী। মেয়েটা রাস্তা ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধারা যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়ির মাঠের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে চেষ্টা করল। কিন্ত তার আগেই বর্বর পাকিস্তানী মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। মাটিতে পড়ে মেয়েটা আর্তনাদ করে হাত-পা ছুড়ছে। আর শক্র উপুড় হয়ে ওকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করছে। পাঁচ হাত পেছনেই একজন শক্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। পুরো ঘটনাটা চোখের সামনেই আখক্ষেত থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরেই। এসএলআর টি তুলে দাঁড়ানো পাকিস্তানীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন কমান্ডার। গুলির ধাক্কা খেয়ে সে একটু পিছিয়ে গেল। এর মধ্যে এসএলআর-এর নল দিয়ে পরপর দুবার গুলি বের হলো। দড়াম করে পড়ে গেল সে। গুলির শব্দ ও সঙ্গীর অবস্থা দেখে দ্বিতীয়জন মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে চট করে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। আখক্ষেত থেকে উঠে তারেক গেলেন মৃত শক্রর কাছে। যাকে গুলি করেছিলেন সে একজন হাবিলদার। তার চাইনিজ এসএমজি ম্যাগাজিনসহ বান্ডুলিয়ারটা এবং চাইনিজ রাইফেল তুলে নেয়া হয়। হঠাৎ বাম পাশ থেকে শক্রর এক ঝাঁক গুলি এল মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। বিঙ বিঙ করে গুলিগুলো এপাশওপাশ দিয়ে চলে গেল। তারেক পালাতে পাগল আখক্ষেতের দিকে। কিন্ত আখক্ষেতের পাঁচ গজ দূরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। মনে হলো ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লেগেছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে গুলি আসছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসতে শুরু করল। ঠিক এই মুহূর্তেই ডানপাশের গ্রামের যেখানে শাহনাজ ছিল, ওখান থেকে এলএমজি ও এসএলআর-এর গুলি বাঁশঝাড় লক্ষ্য করে ছুটে গেল। বুঝতে পারা গেল শাহনাজ শক্রর পজিশন দেখে ফেলেছে। পুরোপুরি অ্যাকশনে নেমেছে সে। ২ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করা হলো বাঁশঝাড় লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠলো গোটা এলাকা। শাহনাজ মর্টার ফায়ার করেছে তার সঙ্গী পুরোদমে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত কিছুই দেখতে পারলেন না। কারণ বাড়িটা আড়াল করে রেখেছে বাঁশঝাড়টাকে। কয়েক মিনিট পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের ওদিক থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এলো। চিৎকার করে বলল ‘শক্র পালিয়ে গেছে’। তারেক প্যান্টটা হাঁটুর ওপরে তুলে ফেলতেই দেখলেন ঠিক হাঁটুর নিচে পায়ের মাংসের গোছাতে গুলি লেগেছে। দর দর করে রক্ত ঝরছে। পা চুয়ে চুয়ে রক্ত রাস্তায় বালি ভিজিয়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে রক্ত শুষে নিচ্ছে ব-টিং পেপারের মতো। রক্তের দিকে তাকিয়ে তারেক দেখল তার রক্তে ভিজে যাচ্ছে বাংলার মাটি। ইতিমধ্যে গ্রামের দুই-চারজন পাশে জড়ো হলো। তারা বলল, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি চলে যান। ওরা ওদের লাশ নিতে আসবে দলবল নিয়ে, প্রতিশোধের জন্য এই গ্রাম পুড়িয়ে দেবে। পাকিস্তানীরা এসেছিল ঘন্টা তিনেক পরেই। ওদের লাশ দুটো নিয়ে গেছে, তবে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। সাথে আশপাশের আরো দুই-তিনটা গ্রাম। লোকজন মারতে পারেনি, গ্রাম ছেড়ে সকলেই দূর-দূরান্তে চলে গেছে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত