You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাঁচদোনার যুদ্ধ, নরসিংদী

২৫ মার্চ ১৯৭১ খ্রি. ২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ঢাকার প্রায় ২৫ মাইল উত্তরে জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে। এ ব্যাটালিয়নটি ছিল ঢাকা সেনানিবাসস্থ ৫৭ পদাতিক ব্রিগেড্রের অধীনে, কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার খান। ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব’ পালনের নামে ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কম্পানিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়মনসিংহে এবং ‘এ’ কম্পানিকে টাইঙ্গাইলে। ‘বি’ কম্পানি ও ‘ডি’ কম্পানি থাকে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে জয়দেবপুরে, ‘বি’ কম্পানির একটি প্লাটুন ছিল গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি প্রহরায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি কম্পানিও মোতায়েন ছিল। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ৩টায় লে. জেনারেল টিক্কা খানের টেলিফোন নির্দেশে ‘বি’ কম্পানির বাদবাকি সৈন্যদের গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ‘ডি; কম্পানির একটি ছিল রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপো প্রহরায়। এখানে দুই প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্যও প্রহরায় ছিল। ২৬ মার্চ সকালে জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে ২ হেডকোয়ার্টার কম্পানির অংশ (ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ) ২৬ মার্চ সকালেই ২ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। বাঙ্গালি অধিনায়ক লেঃ কাজী আব্দুর রকীব ২৫ মার্চ বিকেলে ২ ইষ্টবেঙ্গলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লেঃ কর্ণেল মাসুদকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় আগের দিন। দুঃখজনকভাবে লেঃ কর্ণেল রকীব সিদ্ধান্ত নেন ২ ইষ্টবেঙ্গলের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ না দেয়ায় ২৬ মার্চ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে সব সৈনিকসহ প্রথমে টাঙ্গাইল পৌছেন। সেখানকার কম্পানিসহ ২৬ মার্চ তিনি ময়মনসিংহে পৌঁছে বিকেলের মধ্যে বিদ্রোহী ১৪ উইং ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতা সংগঠিত করেন। সংঘবদ্ধ সেনাদলের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার। এ পর্যায়ে তিনি ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার উত্তর এবং পশ্চিম দিক অবরুদ্ধ রেখে পাকিস্তানীদের সবচেয়ে অপ্রত্যাশীদ দিক পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করার। এ আক্রমণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মেজর শফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে দুই কম্পানি ইপিআর নিয়ে নরসংদী পাঁচদোনায় পৌছেন। ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর সদর দফতর পিলখানায় বাঙালি সৈনিকদের ওপর পাকিস্তানী ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট অতর্কিত আক্রমণ করে ঘুমন্ত, বিশ্রামরত ও অপ্রস্তুত বাঙালি সৈনিকরা প্রায় ছিল নিরস্ত্র ও যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেন তারা সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়ান। কিন্ত অপরিকল্পিত এ প্রতিরোধ কার্যকরী হলেও দীর্ঘমেয়াদী করে স্থায়ী ফলাফল লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। বহু সৈনিক ঘুমন্ত এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মারা যান। বাকিরা বিচ্ছিন্নভাবে পিলখানা ত্যাগ করেন। এদের বেশিরভাগই দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে আপাতত আপদমুক্ত হন। পিলখানা ত্যাগ করা ইপিআর সৈনিকদের একটি দল নিয়ে নায়েব সুবেদার সুলতান আহমেদ ১ এপ্রিল পাঁচদোনার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন। এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং ছুটিতে থাকা বহু সৈনিকও এ পর্যায়ে নিজেদের ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের দলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেন। পাঁচদোনার মাইল চারেক পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পারে ডাঙ্গা এলাকায় একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়া হয়, একটি অগ্রবর্তী অবস্থান নেয়া হয় নরসিংদী-ঢাকা রাস্তার মাধবদী বাজার এলাকায়। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান থাকে পাঁচদোনায়। ৩১ মার্চ ইপিআর কম্পানি দুটি নরসংদী পৌঁছার সঙ্গেই কোথা থেকে এসে জোটে বাঁধনহারা একঝাঁক ছাত্র-জনতা, যুদ্ধের আদ্যক্ষরটির সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই কোনদিন। এই স্বেচ্ছাসৈনিকদের কাছে কোন প্রতিবদন্ধকই অনতিক্রম্য নয়, কোন পরিমাণ রক্তই বেশি মনে হয় না। ১ এপ্রিল বেসামরিক ও সামরিক যানবাহনে পাকবাহিনীর একটি সেনাদল ঢাকা থেকে নরসংদীর দিকে যাত্রা করে। নরসংদী ও পাঁচদোনার মাঝামাঝি স্থানে তারা মুক্তিবাহিনী কতৃক অতর্কিত আক্রান্ত হয়। বহু প্রাণ দিতে হয় তাদের। শক্রর নিরাপদ পশ্চাদপসরণ বিপদসঙ্কুল হয়। পাকিস্তনানীরা ব্যাপকভাবে আর্টিলারি ফায়ার হানতে শুরু করে আক্রান্ত সেনাদলকে নিরাপদে পিছিয়ে আনতে। আর্টিলারি গোলার মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর্টিলারি গোলাবর্ষণ পরদিনও (২ এপ্রিল) অব্যাহত থাকে। দু’টি স্যাবর (এফ-৮৬) বিমান উপর্যুপরি আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী অবস্থানের ওপর। ৭ এপ্রিল আবারও দু’টি স্যাবর নরসংদী আক্রমণ করে নাপাম বোমান ফেলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বেসামরিক এলাকার সমূহ ক্ষতি সাধন করে। ১ এপ্রিল থেকে আশুগঞ্জ-ভৈরব লালপুর এলাকায় ২ ইষ্টবেঙ্গল প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত মেজর খালেদ মোশাররফের ৪ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান নিরাপদ রাখা। যাতে এই দুটি ব্যাটালিয়ন ওই এলাকার একত্রিত হয়ে সমন্বিত যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। পাকিস্তানীরা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এলাকায় ২ এবং ৪ ইষ্টবেঙ্গলের একত্রিত হওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হয় এবং অনুধাবন করে এই দুটি ব্যাটালিয়নের যৌথ শক্তি মোকাবিলা করা হবে দুরূহ। কাজেই ২ এবং ৪ ইষ্টবেঙ্গল একত্রিত হওয়ার আগেই তাদের বিচ্ছিন্ন করা ছিল পাকিস্তানীদের সর্বাত্মক প্রয়াস। শক্রর ভৈরব দখলের আক্রমণ পরিকল্পনায় একটি আক্রমণকারী দল ব্যবহার করবে ঢাকা-নরসিংদী সড়ক, মেঘনা নদী হয়ে একটি সেনাদল আসবে দক্ষিণ দিকে থেকে নৌযানে। এদের সুযোগমত নির্বাচিত স্থানে নামানো হবে। আশুগঞ্জ এবং আজবপুরের মাঝামাঝি সোহাগপুরে এবং মধ্যেরচর এলাকায় হেলিকপ্টারযোগে (এমআই-৮) নামানো হবে এক কম্পানি করে সৈনিক। নরসিংদী এলাকায় রণকৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এ কারণেই। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার জিঞ্জিরার দক্ষিণে কলাতিয়া গ্রামে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (কমান্ডো) সদস্য মাহফুজ আলম বেগ অস্ত্র ও বিস্ফোরকের প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহে বেগ তার কর্মস্থল পাকিস্তানের করাচী থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি নরসিংদী এলাকার মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতির খবর পেয়ে আরও পাঁচজন ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকসহ এপ্রিলের ৬ তারিখে পাঁচদোনায় ক্যাপ্টেন মতিউরের সঙ্গে যোগ দেন। তাদের সঙ্গে ১টি এসএমজি এবং ৪টি চীনা রাইফেল। ৮ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান একটি দুঃসাহসী অ্যাম্বুশ কার্যকর করার জন্য স্বেচ্ছাসৈনিক আহবান করেন। তিনি খোলাসা করে বুঝিয়ে দেন যে, অ্যাম্বুশে কেউই বেঁচে আসতে পারবেনা। তিনি নৌসেনা বেগকে নির্বাচন করেন এম্বুশে কমান্ডার হিসাবে। ৯ জন সৈনিক মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অ্যাম্বুশের জন্য এগিয়ে আসেন। বেগসহ মোট ১০ জন। তাদের দেয়া হয় ৩টি এলএমজি, ২টি কারবাইন এবং ৫টি ৩০৩ রাইফেল। সঙ্গে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় গুলি এবং হ্যান্ডগ্রেনেড। ক্যাপ্টেন মতিউর অ্যাম্বুশ দলকে দু’টি এম্বুশ পাতার নির্দেশ দেন। তিনি শক্রর গতিবিধি সম্পর্কে আবছা খবর পান। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া পরিচালিত যুদ্ধ কখনও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। কিন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের কোন সূত্র তখন ছিল না এবং শক্রর চলাচল ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করার তখন না ছিল কোন মাধ্যম, না ছিল সময়। বাধ্যবাধকতা, উপস্থিত বুদ্ধি আর বাঁধভাঙ্গা সাহসই মাত্র ছিল তখনকার যুদ্ধের উপাদান। ক্যাপ্টেন মতিউর জানালেন, ৮ এপ্রিল পাকিস্তানী একজন ফ্লাগ অফিসার (ব্রিগেডিয়ার অথবা মেজর জানারেল) ঢাকা থেকে তারাব ফেরি পার হয়ে নরসংদীর দিকে কোথাও আসবেন এবং দিনাদিনই তিনি একই রাস্তায় ফেরত যাবেন। পাকিস্তানী অফিসারের নাম, পদ বা পদবী কিছুই ক্যাপ্টেন মতিউর দিতে পারেননি। যেহেতু তখন হাতে সময় নেই, তিনি দ্রুত অ্যাম্বুশ দলকে অবস্থানে রওয়ানা হতে বলেন এবং নির্দেশ দেন যেন ঢাকায় ফেরত যাওয়ার পথে পাকিস্তানী এই অফিসারকে অ্যাম্বুশ করা হয়। ৯ এপ্রিল মাধবদী বাজার এলাকায় সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করে আরেকটি অ্যাম্বুশ করার আদেশ দেন। প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মতিউর জানালেন, শক্রর একটি দল ঢাকা থেকে পাঁচদোনা আক্রমণের জন্য আসার কথা। এবারও শক্রর সম্ভাব্য সংখ্যা এবং অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হল না। অ্যাম্বুশ দলকে দায়িত্ব দেয়া হল অগ্রসরমান শক্রকে বিপর্যস্ত করার এবং তাদের অগ্রাভিযানকে যতক্ষণ সম্ভব বিলম্বিত করার। পাকিস্তানী ফ্লাগ অফিসারকে অ্যাম্বুশ করার সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। এই র‍্যাংকের একজন পাকিস্তানী অফিসার হত্যা বা বন্দী করতে পারা হবে এক বিরাট সাফল্যের কাজ। পাঁচদোনা যুদ্ধের সময় যত কাজেরই হোক না কেন, এ অস্ত্র দীর্ঘ সময় বহন করার জন্য সত্যিই কষ্টকর। নরসিংদী-কাঁচপুর রাস্তায় দড়কান্দি গ্রামের কাছে এসে রাস্তার কাছে আসতে খাল পেরুতে হল। দুপুর ১২টার দিকে রাস্তার পাশে উঠতেই তারা লক্ষ্য করল ফ্লাগ উড়িয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কমান্ডার তাঁর স্টাফ কার নিয়ে তখনই তাদের সামনে দিয়ে ঢাকার দিকে চলে গেল। স্টাফ কারের সামনে চারটি মোটর সাইকেলে মিলিটারী আউট রাইডার। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের বিষয়। কয়েকটি সেকেন্ড সময় পেলেই তারা শক্রকে পেয়ে যেত, মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে। লক্ষ্যবস্তু হাতছাড়া হওয়ার হতাশা, অবসাদ এবং ক্লান্তি সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। একটু দূরে নিরাপদ স্থানে সবাই জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। মাধবদী বাজারের কাছে করইতনী এলাকায় অ্যাম্বুশের স্থান নির্বাচন করা হল বিকালেই। রাতের মধ্যেই অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করা হল। কিন্ত রণকৌশলগত বিবেচনায় বড় ধরনের ভুল হয়ে গেল। ১০ জনের এই ছোট্ট দলটি রাস্তার এক পাশে অবস্থান না নিয়ে প্রচলিত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের মতো রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নিল। যুদ্ধ অংক নয়, যুদ্ধের কোন বাঁধাধরা ব্যাকরণও নেই। শান্তির সময়ে যুদ্ধের নিয়ম-নীতি বলে যা শিখি, বাস্তবে তা কেবলই বিবেচ্য বিষয় বিধায় পরিবর্তনশীল। পরিবেশ, পরিস্থিতি, শক্রর বিস্তারিত তথ্য, নিজ শক্তি ও ফায়ার পাওয়ার, যুদ্ধের ধরন ও আকার, আবহাওয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা (বেতার ও ভূ-পৃষ্টের) ইত্যাদি বিষয়ের বিবেচনার ওপর নির্ভর করে যুদ্ধের প্রকৃতি। অ্যাম্বুশ অবস্থান গ্রহণে যা ভূল হয়েছিল ফলাফলে দেখা গেল, তা ছিল অজ্ঞাত আশীর্বাদ। কুয়াশার কারণে দৃষ্টি বেশি দূর যায় না। ভোর ৭টার দিকে দেখা গেল শক্রর বিশাল গাড়ীর বহর এগিয়ে আসছে। ধীর গতিতে আসছে জিপ, দেড় টন পিকআপ ও ৩টন লরি। খেয়াল করে তারা দেখতে পেল, গাড়ীবহরের আগে হেঁটে আসছে একদল সেনা, রাস্তার দু’ধারেও প্রসারিত হয়ে এগিয়ে আসছে তারা। অ্যাম্বুশ দলের বুঝতে বাকি রইল না, শক্রর এটি পরিকল্পিত ট্যাকটিক্যাল মুভ। (এডভান্স টু কন্ট্যাক্ট)। পথে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ মোকাবিলায় তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মুহূর্তেই অ্যাম্বুশ দল বুঝে ফেলল, অগ্রসরমান শক্রর শক্তির তুলনায় তারা নস্যি। তাদের তখন দুটো পথ খোলা-অবস্থান ত্যাগ করা, ফলে শক্রর কোন বাঁধা এবং সতর্কতা ছাড়া অতর্কিতে পাঁচদোনা প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করতে পারা; দ্বিতীয়, যতটুকু সম্ভব শক্রর ক্ষতিসাধন করা এবং তাদের অগ্রাভিযান বিলম্বিত করা। এর ফলে ক্যাপ্টেন মতিউর শক্র আগমনের পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে পারবে। মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনা, জেনেও তারা দ্বিতীয় পথটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়। শীতল সাহস, গভীর কর্তব্যবোধ ও নিরেট দেশপ্রেমই কেবল অবস্থানে রাখতে পারে এ যোদ্ধাদের। নৌবাহিনীর কমান্ডো বেগ, নৌসেনা সিরাজ, সৈনিক বাবু এবং বাকি ৭ জন গণযোদ্ধার এরা সবাই ছিল। ঘটনা ঘটছে সব চকিতে। শক্র দ্রুত এগিয়ে আসছে। অগুনিত গুলি উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। বরফ-ঠাণ্ডা বায়ু নিয়ে এরা অপেক্ষা করে আছে, কখন শক্র তাদের অস্ত্রের কার্যকরী দূরত্বের মধ্যে আসবে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির তাণ্ডব যখন একসঙ্গে শুরু হল, তখন হঠাৎই পণ্ড হল শক্রর অগ্রাভিযান। তিনটি ৩ টন লরি গুলির আঘাতে গড়িয়ে পড়ল রাস্তার পশ্চিম দিকে। শক্র পেছনে দৌড়ে গিয়ে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। অগ্রাভিযানকালে শক্রর যে গুলি ছিল লক্ষ্যহীন ও অনুমাননির্ভর, অ্যাম্বুশ দলের গুলির পর তাদের অবস্থান জাহির হয়ে যায় এবং মর্টার, রিকয়েলেন্স রাইফেল এবং গুলি আসতে থাকে। সরাসরি এলএমজি ফায়ারতো বাবুর বাম পায়ে গুলি লাগে। অ্যাম্বুশ কমান্ডার বেগ এলএমজির হাল ধরেন। তখন ২০০ গজ দূরত্বে শক্রর অবস্থান। বৃষ্টির মতো গুলি আসছে, মাথা তোলাই অসম্ভব। শক্রর চলাচল লক্ষ্য করে বোঝা যাচ্ছে, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের পথ বন্ধ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছে। মৃত্য দাঁড়িয়ে সামনে। কিন্ত এদের বেঁচে থাকতেই হবে। যে যুদ্ধ অনুকূল ফলাফলের মাধ্যমে শেষ করতে হবে, সে যুদ্ধের কেবলই শুরু-এপ্রিলের সবেমাত্র ৯ তারিখ। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানীরা ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে ঢাকা-নরসিংদী রাস্তার ধরে পাঁচদোনা আক্রমণ করে বিমান বাহিনীর সহায়তায়। গত ১০ দিনে ক্ষয়ে এসেছে প্রতিরোধের শক্তি। এরই মধ্যে ডাঙ্গা এবং বাবুরহাটে মোকাবিলা করা হয়েছে শক্র আক্রমণ। গুলি আর খাদ্যের অভাব তীব্র। বিশেষ করে গুলি এবং খাদ্যের বিতরণ ব্যবস্থায় মারাত্মক ক্রটিও দেখা দেয়। কোন কোন অবস্থানে প্রচুর গুলি থাকলে বিতরণের ক্রটির কারণে গুলিশূন্য হয়ে পড়ে। কয়েকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান অপর দিকে রণকৌশলগত শুরুতে ওই অবস্থানগুলোর ওপরই শক্রর আক্রমণ চাপ বাড়তে থাকে। লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় ১১ এপ্রিল বিকেলে ক্যাপ্টেন মতিউর সিদ্ধান্ত নেন পশ্চাদপসরণের।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!