You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৫শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে বংশাল ফাঁড়ি, ঢাকা
[প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]

নবাবপুর থেকে বংশালের রাস্তায় ঢুকলে বায়ে নিশাত সিনেমা হল, ডাইনে দৈনিক সংবাদ’ অফিস, সেখান থেকে একটু খানি এগিয়ে গেলে বংশাল ফাঁড়ি। কিছুসংখ্যক সৈন্য মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে এই ফাঁড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা নিশ্চিন্ত মনে রাত্রির নিঃশব্দতার বুকে আর্মি বুটের খট খট শব্দ হেনে ফাঁড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছিল। এখানে কারো কাছে থেকে যে প্রতিরোধ আসতে পারে এমন কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, অবাধে ও সচ্ছন্দে তাদের হত্যালীলা চালিয়ে যাবে, একটি প্রাণীকেও রেহাই দেবে না। কিন্তু ফাঁড়িটির কাছে যেতেই এক পশলা বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি তাদের অভ্যর্থনা জানাল। ওরা ভীষণ চমকে উঠে পিছে হটে গেল। এটা কি একটা বিশ্বাস করবার মতো কথা। এক সামান্য ফাড়ির জনকয়েক পুলিশ, তাদের এতবড় সাহস হবে। কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, ওদের মধ্যে কয়েকজন সেই গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ফাঁড়ির ভেতর থেকে পর পর কয়েকবার রাইফেলের শব্দ শোনা গেল।
এবার দুপক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বংশালের পথে একটিও জনপ্রাণী নেই। ঘরে ঘরে দরজা জানালা বন্ধ। কোন সাড়া শব্দ নেই, শুধু ঘন ঘন মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দে বংশালের পথ আর দুধারের বাড়িগুলো থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। সৈন্যরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল।
ফাঁড়ির বেতরে কে কোথায় আছে, কারা কি করছে কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না। অপর পক্ষে অন্ধকার ফাঁড়িটার মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় পজিশন নিয়ে প্রতিরোধকারীরা তাদের লক্ষ করে গুলি ছুড়ছিল। রাস্তার আলোয় সৈন্যদের তারা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে এইভাবে ওরা বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারল না, তখনকার মতো সেখান থেকে পৃষ্টভঙ্গ দিল।
ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল, কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যরা তাদের কোন চিহ্ন রেখে যায়নি।
ফাঁড়ির পুলিশরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনও মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাঁদের সম্বল। এই সঙ্কট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাঁদের হাতে এল ?
বংশাল মহল্লার লোকের মুখে জানা যায়। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশদের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুণ্ডা আর তার কয়েকজন সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংগঠিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ফাঁড়ির পুলিশরা এ কাজে হাত দিতে সাহস করত না। আর মেশিনগান? শুধু বংশাল মহল্লা নয়, পাশাপাশি মহল্লার অনেকেই একথা শুনেছিল যে যারা শহরের মধ্যে একটিমাত্র লোক আছে যার হাতে একটি মেশিনগান আছে। সেই লোকটি হচ্ছে নাদির গুণ্ডা নামে পরিচিত নাদির মিঞা। কি করে সে এই মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল, একমাত্র সেই তা জানে।
প্রাক-স্বাধীনতার যুগে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষণচন্দর, তিন গুণ্ডা, নামে এক অপূর্ব কাহিনী লিখেছিলেন। কাহিনীর সেই তথাকথিত গুণ্ডারা স্বাধীনতা আন্দোলন উপলক্ষ্যে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু সত্য সত্যই এরা কেউ গুণ্ডা ছিল না। সরকারী প্রচারণায় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই শহীদদের গুণ্ডা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
নাদির গুণ্ডার ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়। সত্য সত্যই সে গুণ্ডামি করত। যেই পরিবেশে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই পরিবেশই তাকে এই পথে টেনে আনে। বয়স আর কত ? ত্রিশের কোঠার নিচেই ছিল। এই বয়সেই সে গুণ্ডা নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তবু সাধারণ গুন্ডাদের চেয়ে সে স্বতন্ত্র ছিল। তার পরিচিত যারা, এ কথাটা তাঁদের জানা ছিল যে, অনেকে বিপদে আপদে নাদির গুণ্ডার কাছে থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে। সে যে শুধু লোকের ঘৃণা বা ভয়েরই পাত্র ছিল তা নয়, কারু কারু কাছ থেকে সে শ্রদ্ধা পেয়েছে,ভালবাসাও পেয়েছে।
এই সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাস করা কঠিন অথচ সত্য। নাদির গুণ্ডার জীবনে এমনি এক ঘটনা ঘটল স্বাধীন বাঙলা আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে লোকতা কেমন করে যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আর সব কথা যেন ভুলে গেল সে। কেমন করে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।
একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নদির গুণ্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।
পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি। ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার সাহস আর নিষ্টার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লায় লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল।
তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পোউছত দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরছিল।
পঁচিশে মার্চের পর থেকেই লুন্ঠনরত সৈন্যের দল ঘরবাড়ি দোকানপাট ভেঙেচুরে ইচ্ছামতো লুটপাট করে চলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শহরের গোটা কয়েক রেশনের দোকান লুট হয়ে গেল। শহরের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠল। এভাবে রেশনের দোকান যদি লুট হয়ে যায়, তবে খাবে কি তারা? শেষ কালে কি না খেয়েই মরতে হবে? ভয়ে দিশেহারা মানুষ কি করবে পথ খুঁজে পায় না।
রেশন দোকানের মালিকরা ভয়ে দোকান খুলতে চায় না। এই দুর্দিনে সর্বসাধারণের অবস্থা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠলো নাদির। কিছু একটা করতেই হয়। ঐ শয়তানেরা এসে রেশনের চাল লুট করে নিয়ে যাবে আর তারা অসহায়ের মতো হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে, এ কিছুতেই চলবে না। কিন্তু কি করতে পারে সে ?
একদিন মহল্লার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল নাদির আর তার দলবল তাঁদের রেশনের দোকান ভেঙে বস্তা বস্তা চাল বের করে নিয়ে যাচ্ছে। শেষকালে নাদিরের এই কাজ! তারা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই তাদের আসলে ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইলো না। নাদির তাদের মুখের দিকে চেয়েই এই দুঃসাহসের কাজে হাত দিয়েছে। নাদির আর তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেই চাল মহল্লার ঘরে ঘরে ভাগ করে দিল। পাড়ার লোকে তখনকার মত কিছুটা চাল পেয়েয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজটা সেরে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাদির। তার মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। খবরটা ইতিমধ্যেই ছড়য়ে পড়েছে। মিলটারি জিপ তার সন্ধান নিয়ে ফিরছে।
এরপর দুঃসাহসী নাদির আর বেশিদিন কাজ করবার সুযোগ পায়নি। এপ্রিলের মধ্যভাগে গ্যাদা নামে এক কুখ্যাত গুণ্ডা তাকে মিলিটারিরি হাতে ধরিয়ে দিল। গ্যাদা ইতিমধ্যেই মিলিটারির দালালি করে আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নাদিরের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। একবার নাদিরের গুলিতে জখম হয়ে তাকে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল।
তখন রাত অনেক হয়েছে। নাদির একটি জিপে করে আসছিল। আরমানিটোলা ময়দানের কাছে এসে তার জিপটা একটা বাড়ির পাশে দাঁড়াল। ওরা আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। একটা সঙ্কেত পেয়ে মিলিটারির লোকেরা বিদ্যুৎ গতিতে এসে তার জিপটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাকে ধরে নিয়ে তাদের আস্তানায় চলে গেল। নাদির সেই যে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না কোনোদিন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!