You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | ২৫ শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

২৫ শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী
[প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি রাজারবাগ রিজার্ভ অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের রিজার্ভ অফিসের বাইরে সহস্র বিক্ষুব্ধ জনতা বড় বড় গাছ ও ইট-পাটকেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করছিল। সন্ধ্যার সময় এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিস আক্রমণ করবে। এ সংবাদ শোনার পর আমি রাত সাড়ে ন’টার সময় তেজগাঁ থানায় কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে ঢাকা সেনানিবাসে পাক হানাদারদের মনোভাব কি তা জানাবার জন্যে টেলিফোনে অনুরোধ করি। তিনিও পাক হানাদার কতৃক রাজারবাগ রিজার্ভ অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনেছেন বলে জানান। এরপর আমি তেজগাঁয় আবার টেলিফোন করে জানতে পারি যে তখন পাক হানাদারদের প্রায় ৮০-৯০টি সশস্ত্র ট্রাক ও জিব তাদের থানার রাস্তা ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করতে তারা দেখেছেন। রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের ওপর পাক-হানাদারদের এমন উলঙ্গ হামলার সংবাদ শুনে আমাদের আর-আই একেবারে হতবাক হয়ে যান। এরপর আমরা পুলিশ রিজার্ভের অস্ত্রগার থেকে প্রয়োজন মতো অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার জন্যে রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের চারিদিকে পজিশন নিয়ে শক্রর অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত পরিবেশ একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলি। আমরা বাইরে অনেক দূর থেকে পাক হানাদারদের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। আমরা শুধু পজিশন নিয়ে শক্রর অপেক্ষা করছিলাম। অয়ারলেস ও টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সারা শহর অন্ধকার, নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ। আনুমানিক মধ্যরাতে পাকহানাদাররা প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাসপাতালের গেট (দক্ষিণ দিক) থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমরা তার পাল্টা জবাব দেই এবং পাকপশুদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে ভারী অস্ত্র, শেল, কামান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। আমাদের ওপর সাংঘাতিকভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ হতে থাকে। আমরা প্রথমে আত্মসমর্পণ করিনি এবং আত্মসমর্পণ করার মতো কোন দুর্বলতাও আমরা দেখাইনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের উদাত্ত আহবান অনুযায়ী আমরা আমাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে সমস্ত পাকহানাদারদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এবং এভাবে আমাদের সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাকহানাদারদের প্রাণপণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে করতে আমরা জীবনদান করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে তখন পাকপশুদের মোকাবেলা করছিলাম। আমাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যে ওরা গভীর রাতে রিজার্ভ অফিসের উত্তর দিকে টিনশেড ব্যারাকে লাইট বোমা ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করছিল আমাদের এমন কতিপয় বীর সিপাহী নিদারুণভাবে দগ্ধিভূত হয়ে শহীদ হন। অনেকে সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে সেখানেই মৃতবৎ পড়ে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে এবং সমস্ত ব্যারাক পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমরা উপায়ন্তর না দেখে ছাদের ওপর গিয়ে আত্মরক্ষা করতে থাকি। এবং পাকহানাদাওরদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি। আমরা ব্যারাকে চারিদিকে লেলিহান আগুনের শিখায় কিছুমাত্র দমে যাইনি, আর আমাদের মনোবল কোন সময়ই দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওদিকে কামান, শেল আর ট্যাঙ্কের গর্জন ও বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ চলছিল। কামান ও শেলের প্রচণ্ড আঘাতে আমাদের কয়েকটি পাকা ব্যারাক ও প্রাচীরঘেরা মোটর ওয়ারকশপ মাটিতে ধসে পড়ে। ফলে আমাদের বীর সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সুবিধামত স্থান গ্রহণ করে চারিদিকে জ্বলন্ত আগুন, অবিরাম শেলিং ও কামানের গর্জনের মধ্যে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিল পাকপশুদের। আমাদের অনেক বীর সিপাহীকে প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হতে আমি দেখেছি স্বচক্ষে। এমনিভাবে পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে করতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়, ভোর হয়ে যায় এবং বেলা উঠে যায়। এরপর আমাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় দেখে আমরা আর কোন উপায়ন্তর পাই না। ইতিমধ্যে পাক হানাদাররা আমাদের পুলিশ লাইনে ঢুকে পড়ে। তখনও আমরা আত্মসমর্পণ করিনি। এবং পাক হানাদারদের হাজারো হুমকির মুখেও আমাদের মনোবল এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওরা ব্যারাকে ঢুকে আমাদেরকে বন্দি করে এবং ছাদের উপর থেকে আমাদেরকে নিচে নামিয়ে এনে বুটের লাথি এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। আকস্মাৎ এক হানাদার পাক পশু হাতের বন্দুক দ্বারা আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলে আমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে এবং তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তিনঘন্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পাই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এস-আই, এ-এস-আই, হাবিলদার সুবেদার, নায়েক, সিপাহীরা আমরা প্রায় দেড়শত বীরযোদ্ধা পাক হানাদারদের হাতে বন্দি হই। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনাহারে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়। ২৯শে মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব ই.এ. চৌধুরী রাজারবাগে আমাদের পুলিশ লাইনে আসেন এবং পাক হানাদারদের মেজরের সাথে কথোপকথনের পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়- “আব তুমলোগ চালা যাও, আয়েন্দা কাল ভোর ছয় বাজে মিল ব্যারাকমে তমলোগ রিপোর্ট করেগা, আওর উহাই তোমলোগ রাহেগা-ইদার হামলোগকা জোয়ান রাহেগা।
*১৯৭১ সালের পূর্বে রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের প্রসিডিং সেকশনের এ এস ই আই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সাক্ষাতকারঃ মোঃ আসমত আলী আকন্দ, এস, আই অব পুলিশ, ১০-০১-১৯৭৪

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত