You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | ২৫শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইন - সংগ্রামের নোটবুক

২৫শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইন
[প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]

সিপাহী আবদুল খালেক, মোজাম্মেম হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দীন এবং আরও অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া-দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসে ছিলাম। রাত পৌনে এগারটার সময় ঢাকা পিলখানা ই-পি-আর হেডকোয়ার্টার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কতৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ই-পি-আর হেডকোয়ার্টার আক্রমণের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ই-পি-আর হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদেরকে সশস্ত্র ভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪ নং ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এ-এস-আই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এ সংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আর-আর ও এস-পি হেডকোয়ারটারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এ-এস-আই, এস-আই, হাবিলদার, সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরি করেন এবং প্রত্যেককে ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মি. শাহজাহান ও আর-আই মি. মফিজউদ্দীন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতি নেতৃত্ব দান করেন।
পুলিশ সুপার ও আর-আর উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। আমরা সকল সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এ-এস-আই, এস-আই সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে হানাদার পাক-বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এ সময় অয়ারলেস এবং টেলিফোনে সব কিছু অচল করে দেয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহস্র ছাত্র-জনতা বড় গাছ, লাইটপোস্ট, ইট-পাটকেল ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরি করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এর মধ্যে চলছিল বৃষ্টির মোট গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাঙ্কের গর্জন। পাক হানাদারদের হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল-বন্দুক নয়ে ওদের হামলার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের অধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুনভাবে আহত হয় মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণরক্ষা করতে সমর্থ হন। পাকহানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সফল ব্যারাকে লাইট বোমা ও পেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়তে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।
*১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজারবাগ, রিজার্ভ পুলিশ লাইন অয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন।
সাক্ষাৎকার : আ. গণি তালুকদার, অফিস সহকারী (পুলিশ), ০৯-০১-১৯৭৪

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত