You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.11 | পঞ্চনন্দপুর সম্মুখ সমর, নবাবগঞ্জ - সংগ্রামের নোটবুক

পঞ্চনন্দপুর সম্মুখ সমর, নবাবগঞ্জ

ভোলাহাট থানা ভবন হেডকোয়ার্টার থেকে মুক্তিবাহিনীর টহল ও প্রতিরোধ তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা সদা সতর্ক। ১১ জুলাই, ১৯৭১ সালে বাঙ্গাবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধা ভেজালু থানা ভবনে খবর নিয়ে আসলেন যে, বেগুনবাড়ীর সুলতানের মা কলেরায় অসুস্থ, তাঁকে ছুটি দেয়া দরকার। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান অস্থির হয়ে পড়লেন। সুলতানকে ছুটি দেয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীর ডিউটি টিম লিডার হাফিজুর রহমান হানসুকে অনুরোধ জানানো হলো। বীরযোদ্ধা সুলতানকে ছুটি দিয়ে তাঁকে এগিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্য সেকশন কমান্ডার সাজেদ আলীর (মুজাহিদ-চৌকিদার) নেতৃত্বে একটি টহল দল পাঠানো হলো। সিনিয়র সেকশন কমান্ডার সৈয়দ আঃ রাজ্জাক রাজা মিয়া সাজেদ আলী কমান্ডারকে বললেন, তোমরা বুধবারীহাট পর্যন্ত যাবে এবং ২/১ রাউন্দ গুলি ছুঁড়ে পাকবাহিনীর উপস্থিতি বুঝে সুলতানকে নদী পার করে দিবে। মুক্তিবাহিনীর টহল দল বের হলো। এই দলে ছিলেন (১) সেকশন কমান্ডার সাজেদ আলী, (২) রমিজউদ্দিন, (৩) সুলতান, (৪) সাইফুদ্দিন, (৫) ইপিআরের নায়েক ওয়াশিল মোল্লা, (৬) ইপিআর তাজা (৭) অজ্ঞাত। এছাড়া ২জন রেকির দায়িত্বে ছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন- (১) দলদলী ইউনিয়নের আদাতালা গ্রামের মো. মুখলেশুর রহমান ও অপর একজন (২) গোহালবাড়ী ইউনিয়নের কানারহাট গ্রামের মুনসুর (পরবর্তীতে পুলিশে কর্মরত)। মুক্তিযোদ্ধারা ভোলাহাট থানা ভবন থেকে বের হয়ে রহনপুরগারমী রাস্তা দিয়ে চললেন এবং পোল্লাডাংগা গ্রামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করলেন। সেখানে চা পান করে বুধবারীহাট পর্যন্ত যাবার জন্য আগে ওই দু’জনকে রেকি করার উদ্দেশ্যে পাঠানো হলো। রেকি মুখলেশের হাতে দেয়া হলো গামছা। সিগন্যাল নির্ধারণ করা হলো “বপদ হলে কিংবা শক্রর অবস্থান বুঝে গামছা উড়িয়ে জানান দিবে”। আর মুনসুরকে দেয়া হলো “মাথায় মাথাইল (মাথাল), হাতে লাঠি ও রশি”। সিগন্যাল নির্ধারণ করা ছিল “বিপদ হলে কিংবা শক্র পক্ষের অবস্থান বুঝে লাঠিতে মাথাইল ঘুরাবে”। প্রেরিত রেকিদের এইরূপ সংকেত দেখে মুক্তিযোদ্ধা লড়াকু টহল দল বুঝতে সক্ষম হবে সামনে শক্রবাহিনী আসছে কিংবা তাদের উপস্থিতি আছে এর প্রেক্ষিতে তাঁরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্ত রেকিদল ফিরে আস্তে কিংবা সিগন্যাল দিতে ব্যর্থ হয়। তাঁরা পাকবাহিনীর আগমনের মুখে গ্রামে আত্মগোপন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা পোল্লাডাংগা গ্রামে চা পান করে সুলতানকে এগিয়ে নিয়ে চললেন। তাঁরা বর্তমান ময়ামারী ঈদগাহ ময়দানের কাছ দিয়ে উঠে পূর্বমুখী রাস্তা ধরে অগ্রসর হন। অল্প কিছু দূর এগিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান আদালতা-পঞ্চনন্দনপুর গ্রামের একপাল গরু ভোরাহাটমুখী রাস্তা ধরে আসছে। গরুর পালের পেছনে একদল পাবলিক, তার পেছনে রাজাকার এবং সব পেছনে পাক হানাদার বাহিনী আড়াল হয়ে কেউ রাস্তা দিয়ে আবার কেউ রাস্তার নীচে জমি দিয়ে সামরিক কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। পাকবাহিনীর এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ভোলাহাট দখল করা। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন পাকবাহিনীকে দেখে ফেলেন এবং তৎক্ষণাৎ “ওস্তাদ! পাঞ্জাবী! পজিশন” বলেই রাস্তার দু’দিকে ভাগ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত পজিশনে গেলেন। রাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পজিশনে গেলেন কমান্ডার সাজেদ আলী ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতান। অন্যরা রাস্তার উত্তর দিকে পজিশন নেন। কভারিংয়ে ছিলেন ইপিআর ওয়াশিল মোল্লা ও তাজা। পজিশন নেয়া জমিগুলোতে ওই সময়ে বোনা আউশ ধান আবাদ ছিল এবং ধানের শীর্ষ ফুটন্ত অবস্থায় ছিল। দক্ষিণের পজিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ছিল জমির ঢালু (নীচ) আইল যেখানে পজিশন নেয়ার উপযুক্ত অবস্থান ছিল না। দ্রুত যে যার মতো পজিশনে যান। পজিশন নেয়ার সাথে সাথেই গোলাগুলি শুরু হলো। হানাদার বাহিনী বৃষ্টির মতো ক্রসিং গুলি বর্ষণ করছিল। জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা ধীরগতিতে গুলি ছুঁড়ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর লড়াকু টহল দলের কাছে অস্ত্র ছিল ৫টি MMR-4 রাইফেল ও ২টি ষ্ট্যান্ডগান। বিরযোদ্ধা সুলতানের কাছে মাত্র ৫টি গুলি ছিল। গুলি বিনিময়ের সময় তাঁর গুলি শেষ হয়ে যায়। কমান্ডার সাজেদ আলী সুলতানের বাম পাশে অল্প দূরে পজিশনে ছিলেন এবং সুলতান গুলি চাইলে কমান্ডার সাজেদ গুলির চারজার (এতে ৫টি গুলি থাকে) চালিয়ে দিলেন। চারজারটি একটু দূরে গিয়ে পড়ে। সেটি কুড়াতে গিয়ে সুলতান একটু উঁচু হয়ে পড়লে পাক বাহিনীর গুলি তাঁর বাম পাজরে বিদ্ধ হয়। সাথে সাথে সুলতান শহীদ হন। শহীদ সুলতান মুজাহিদ বাহিনীর এলএমজি ম্যান ছিলেন। হানাদার বাহিনীর তীব্র গুলি বর্ষণের মধ্যে কমান্ডার সাজেদ তাঁর রাইফেলের সিলিং দিয়ে সুলতানের বাম পা বেঁধে লাশ আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু আটিসহারা ও তিতভ্যাটের গাছে বাধা প্রাপ্ত হ্ন এবং সাজেদ আলী কমান্ডারের পা জখম হয়। এর ফলে লাশ টেনে আনা সম্ভব হয়নি। লড়াই শুরু হবার পর আকাশ গড়িয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। গুলি শেষ হয়ে যাবার দরুন মুক্তিবাহিনী বাধ্য হয় পিছু হটে আসে এবং থানা ভবনে ফিরে আসে। মেজর সাজ্জাদের নেতৃত্বে পাক হানাদার বাহিনীর ১৮ জনের দল তাদের ছত্রছায়ায় রাজাকার ও পিস কমিটির সদস্যসহ ঘাইবাড়ী, মুশরীভূজা আদালতা পঞ্চনন্দনপুর গ্রামের শতাধিক মানুষকে বাধ্য করে সাথে এনেছিল, হানাদার বাহিনীর কাছে ছিল এলএমজি, এসএমজি, ষ্ট্যান্ডগানসহ ভারী অস্ত্র, ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে আসার পর হানাদার বাহিনী শহীদ সুলতানের লাশ রাস্তায় নিয়ে অত্যাচার করে এবং দ্বিতীয়দফা বারপাড়ার রাজাকার ইলিয়াস, শহীদ সুলতানের বুকে ২ রাউন্ড গুলি করে। এরপর পাকিফৌজ মুশরীভূজা এলাকার মো. জামশেদ আলী ও শামসুদ্দিন মুন্সি মারফত শহীদ সুলতানের লাশ মুশরীভূজা পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর শক্রবাহিনী গরুর গাড়ীতে করে তার লাশ মুশরীভূজা পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর শক্রবাহিনী গরুর গাড়ীতে করে তার লাশ রহনপুরে নিয়ে যায় এছাড়া হানাদার বাহিনী স্থানীয় পাবলিককে “টিক্কা খান জিন্দাবাদ; ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিতে বাধ্য করে এবং শক্রবাহিনী পঞ্চনন্দনপুর গ্রামের অফসার হোসেনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় বেধড়ক লাঠিপেটা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান সম্মুখ সমরে শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে ঐ দিন বিকেলে মোহদীপুর থেকে এসে ক্যাপ্টেন আলতাফ হোসেন, আকতার আলী খান (কচি খান) ও সিরাজুল ইসলাম বুদ্ধসহ ১৪ জনের মুক্তিবাহিনীর একটি দল সাজেদ আলী কমান্ডারকে সাথে নিয়ে শহীদ হওয়া স্থান পরিদর্শন করেন। এবার মুক্তিবাহিনী এই দল ঘাইবাড়ী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। কিন্তু শক্রপক্ষের কোন সন্ধান না পেয়ে থানা ভবনে ফিরে আসে। সুলতান শহীদ হবার পর মুক্তিবাহিনীর টহল তৎপরতা ও প্রতিরোধ সংগ্রাম জোরালোভাবে শুরু হলো। পরদিন ১২ জুলাই সুলতান শহীদ হওয়ার সংবাদ বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়। এই ছিল ভোলাহাটে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখ সমরের ঘটনা প্রবাহ।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত