২৫শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে ঢাকার পিলখানা
[প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ২২ বেলুচকে পিলখানাতে আনা হয়েছিল। তাদেরকে এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিল। এবং পিলখানার ই-পি-আর এর সাথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনাল সিকিউরিটি ডিউটি করার জন্য ভার দেয়া হয়েছিল। ওরা এখানে আসাতে ই-পি-আরদের মাঝে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয়। ওদের এখানে আসাতে আমরা বুঝতে পারলাম যে হয়ত কিছু একটা ঘটতে পারে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাথেও আমার এ ব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছিল। ২৫শে মার্চ বেলা একটার সময় মেজর জামিল (পশ্চিম পাকিস্তানী), জেনারেল স্টাফ অফিসার, হেডকোয়ার্টার ই-পি-আর আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠান। তিনটা পর্যন্ত আমি তাঁর অফিসে বসে অফিসিয়াল কথাবার্তা বলেছি। তারপর তিনি আমাকে বললেন যে, তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রহরী এসে আমাকে নিয়ে যায়।
রাত আনুমানিক বারটার দিকে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি অনুমান করেছি যে, ২২ বেলুচ বাঙ্গালি ই-পি-আরদের উপর আক্রমণ করেছে। আমাকে যে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেদিকেও গুলি এসে পড়ছিল। রাত তিন-চারটার দিকে গোলাগুলি একটু কমে যায়। আমাদের যে সমস্ত বাঙ্গালি ই-পি-আর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তারা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ওরা অনেককে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬ মার্চ ঠুসঠাস গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
২৭ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আরেফ (পাঞ্জাবি), যে এই হেডকোয়ার্টারে কাজ করতো, আমাকে এসে বলল, “ইউ আর এ গাদদার, ইওর আংকেল ক্যাপ্টেন রফিক ইস অলসো এ গাদদার। উই আর গোইং টু শট ইউ আউট বোথ”।
১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে এখানে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। বন্দি অবস্থায় আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, কিন্তু কোন নির্যাতন চালানো হয়নি। পড়ে আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ রাতে বহু বাঙ্গালি ই-পি-আরকে হত্যা করা হয়। বন্দি অবস্থাতে অনেককে হত্যা করা হয়।
মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পিলখানার বাঙ্গালি ই-পি-আর’রা বাংলাদেশের জাতিয় পতাকা উত্তোলন করেছিল প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঝখানে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষের শীর্ষে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সমূহের মধ্যে প্রথম জাতিয় পতাকা এখানে উত্তোলন করা হয়েছিল। ল্যান্স নায়েক বাশার এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পড়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানায় অবস্থিত প্রায় ২৫০০ বাঙ্গালি সৈন্যের ৬ শতাধিক রাতের অন্ধকারে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাকি সবাই বন্দি হয়। আর তাদের পাঠানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার বধ্যভূমি মোহাম্মদপুর বন্দি শিবিরে। পরবর্তীকালে জি-এসিও/এস-সি-ও এবং সুশিক্ষিত প্রায় ৭ শতাধিক বাঙ্গালি সৈনিকদের হত্যা করা হয়েছিল বুলেট বেয়নেটের নির্মম আঘাতে। ঐ রাতে যারা পালাতে পেরেছিল তাদের অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। তারা প্রতি এলাকায় অমিতবিক্রমে পর্যুদস্ত করেছিল পাকিস্তানীদের প্রত্যক্ষ সম্মুখ যুদ্ধে।
বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনীর ১,০০০-এর মোট মূল্যবান জীবন স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিনযাপন করছেন।
আমি সেখান থেকে সুবেদার শহীদ জহীর উদ্দীন মুন্সীর বাড়িতে যাই। তাঁকে সমস্ত বিষয় অবগত করাই। তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে নায়েক নূর হোসেনের সঙ্গে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হন। তিনি আমাকে কি করতে হবে না হবে পরে জানাবেন বলে বললেন। আমি এবং হাবিলদার শহীদ বেলায়েত হোসেন রাত এগারটা পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষায় সিগনাল ওয়ার্কশপে বসে থাকি। আমরা দুজন আমাদের সিগনাল এর লোকজনকে কিছু একটা খবর আসবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। এবং ১৫-শাখার জনৈক সিপাহীকে এ সংবাদ পৌঁছে দেই। এছাড়া আমরা উভয়ে আমাদের অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত এন-সি-ও শহীদ নায়েক হাসেমকে জিজ্ঞেস করি যে, অস্ত্রাগারের কোন ডুপলিকেট চাবি তৈরি হয়েছে কিনা, যা আগে আপনাকে বলা হয়েছিল। তিনি বললেন যে, তার কাছে ডুপলিকেট চাবি আছে। এই সংবাদ আমরা শহীদ নায়েক সুবেদার শামসুল হক সাহেবকে কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে জানাই। তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে কোন রকম হামলা হলে প্রত্যেকে অনিতিবিলম্বে অস্ত্রাগারে চলে আসবে। এখানে আমি উপস্থিত থাকব, তোমরা লাইনে গিয়ে বিশ্রাম নাও এবং দুজন প্রহরী নিয়োগ কর। কিন্ত, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সে সুযোগ আসেনি।
২৫ মার্চ দিনগত রাত ১ টা পাঁচ মিনিটে প্রথম গুলির আওয়াজ হয়। আমরা প্রত্যেকেই সামরিক পোশাকে ব্যারাকে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমাদের প্রহরী আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে পশ্চিমারা আমাদেরকে আক্রমণ করেছে। তখন আমরা সবাই পূর্ব নির্দেশ মত অস্ত্রাগারে যাবার জন্য বের হয়ে পড়ি। কিন্ত দেখতে পেলাম গুলির আগেই ওরা সমস্ত পিলখানাকে অস্ত্রাগারসহ দখলে নিয়ে নিয়েছে। আমরা যখন বাইরে আসলাম তখন চারিদিক থেকে এল-এম-জি/এস-এম, জি’র ব্রাশ ফায়ার আমাদের উপর আসতে থাকে। তখন আমরা অন্যন্যোপায় হয়ে এদিকে-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি, অল্পসংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকি সবাই বন্দি হয়ে যায়। রাত ৪টায় সময় আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করায়।
৩নং গেটে কর্তব্যরত কয়েকজন বাঙ্গালি ই-পি-আর পসচিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। একজন লেফটেন্যান্টসহ ৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেন্টের লোক নিহত হয়। এই খন্ডযুদ্ধে বাঙ্গালিদের সঙ্গে কর্তব্যরত একজন পাঞ্জাবি ই-পি-আর মোহাম্মদ খানকেও হত্যা করা হয়। এই খণ্ড যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল গার্ড কমান্ডার নায়েক জহীরুল হক। সে তার সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঢাকায় অবস্থিত সিগনাল-এর প্রধান বেতার কেন্দ্র রাত বারটার সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়ার আগে বাংলাদেশের সমস্ত ই-পি-আর বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রহমা আওয়ান আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে সমস্ত বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য। আমাদের কর্তব্যরত অপারেটররা সংকেতের সাহায্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বাইরে কর্তব্যরত সেক্টর/উইং/বিওপি পর্যন্ত সমস্ত ই-পি-আরকে জানিয়ে দেন। ২৬ মার্চ সকাল দশটা পর্যন্ত আমাদের এইচ-এফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেট) চালু থাকে, যার মাধ্যমে ২৫ মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দি হয়ে গেছে। হয়ত কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দি হয়ে যাব এবং আর নির্দেশ দেবার সময় পাব না। তোমরা সমস্ত পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার উক্ত সংবাদ সীমান্তের চৌকি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে যে, ‘আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে এসেছে এবং ই-পি-আর’ এর ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দি হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়। এবং সমস্ত পশ্চিমে পাকিস্তানীদের বন্দি করে আমাকে রিপোর্ট দাও।
ভেসে আসছিল। অস্থির অধীর ছাত্র-জনতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই অসংখ্য কামান ট্যাঙ্ক, ও গোলাবর্ষণের আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে দেখলাম আগুন আর আগুন, জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, রাজধানী ঢাকা জ্বলছে। চোখ ফিরিয়ে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ভীষণ গুলি আরম্ভ হয়ে গেছে, বাড়িঘর জ্বলছে। সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর গোলাবর্ষণ ও আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, আমাদের ফোরস সবই মিরপুর থানায় জমায়েত হয়েছিল। অর্ধেকের হাতে ছিল লাঠি অর্ধেকের হাতে ছিল সাধারণ রাইফেল আর বিশ রাউন্ড গুলি। মিরপুর থানায় এভাবে বসে থাকলে সব একসাথে ওদের ঘেরাওর মধ্যে পড়ে কুকুর-বিড়ালের মত মরতে হবে ভেবে আমরা আমাদের ফোরসকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পজিশন নিতে বলি-আর আমার সিপাহীদের যাদের হাতে শুধু লাঠি ছিল তাঁদের চলে যেতে বলি আত্মরক্ষার জন্য। আমি আমার ফোরস নিয়ে মিরপুর ইটখোলার ভিতরে পজিশন নিয়ে পাকপশুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পালাই নাই-কারণ পালাবার ইচ্ছা আমাদের ছিল না। আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলাম। সামান্য রাইফেল নিয়েই আমরা পশুদের প্রতিরোধ করবো। প্রতিহত করবো, লড়বো-কিন্ত পিছু হটবো না। সারারাত আমি আমার সশস্ত্র ফোরস নিয়ে সেই ইটখোলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে বসেছিলাম। আর ঢাকার আকাশে দেখছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা, সকল নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সহিত পাকপশুদের কামান ও ট্যাঙ্কযুদ্ধের তান্ডবলীলা। রাত তিনটার সময় আমরা দেখলাম আমাদের চোখের সম্মুখে চারটি সশস্ত্র পাকসেনাদের ট্রাক চলে গেল, ট্রাকের পিছনে পিছনে যাচ্ছিল কামান বসানো ‘ডজ’। মিরপুর ই-পি-আর বাহিনীর সাথে আমরা পাক আর্মিদের একঘন্টা তুমুল সংঘর্ষ দেখলাম। কামান ও ট্যাঙ্কের কানফাটা গর্জনে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম পাক আর্মি সেই সশস্ত্র ট্রাকগুলো নিয়ে ফিরছে- তার পিছনে আরও তিনটি ট্রাক আসছিল। ঐ অতিরিক্ত ট্রাকে ছিল সংঘর্ষে পর্যুদস্ত বাঙ্গালি ই-পি-আর বন্দিরা। আমাদের সম্মুখ দিয়েই পাকপশুদের সশস্ত্র ট্রাকগুলো ই-পি-আর বন্দিদের নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছিল। আমি আমার সিপাইদের ওদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে নিষেধ করেছিলাম। ওদের গাড়িগুলো এগোচ্ছিল-সবাই চলে গেল। পিছনে দুটি গাড়ি থাকতেই আমার এক সিপাহী হঠাৎ ওদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতেই ওরা সবাই ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে কুকুরের মত। ভীষণ ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে যায় সিপাহীদের উপর। আমাদের উপর অসংখ্য গ্রেনেড, আরও পড়ছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মত অসংখ্য গুলি। আমরা আমাদের সামান্য রাইফেল নিয়েই পশুদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি-কিছুক্ষণ পর আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা গুলিবর্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি। আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল থাকলেও ওরা রাতের কালো অন্ধকারে সেই ভারী কামান, ট্যাঙ্ক বহর ও অসংখ্য মেশিনগান, গ্রেনেড ও সশস্ত্র সৈন্য নিয়েও আমাদের সামনে সদম্বে এগিয়ে আসতে সাহস পায় নাই। আমাদের দুর্জয় মানসিক শক্তির সামনে ওরা প্রথমত আসতে সাহস পায় নাই। সামান্য রাইফেল নিয়েই ওদেরকে প্রায় একঘন্টা প্রতিরোধের পর আমি আমার ফোরস নিয়ে পিছু হটছিলাম। আমার ফরস সব পিছনে চলে গিয়েছিল। আমি আমার দুর্জয় সিপাহীদের নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে ফাইট দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা নীরব- ওদের নীরবতা দেখে আমি ওদের ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটে চলে আসি। পিছনে এসে দেখলাম এক প্রাসাদের ছাদের উপর এক বিদেশী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বিদেশী ভদ্রলোক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু সে যায়গা নিরাপদ মনে না করায় আমরা সেই ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা এক সিপাহীর কথামত আমরা সবাই নিকটবর্তী অবসর-প্রাপ্ত পুলিশ সুপার মান্নান সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট যত্ন করেন। আমরা তার বাড়িতে চা-নাস্তা খেয়ে তার ছাদের উপরে গিয়ে দেখলাম পাক আর্মিরা ইটখোলার ভিতর ঢুকে আমাদিগকে সার্চ করছে-তখন ভর হয়ে গিয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তার বাসা থেকেই ধেয়ে আসতে থাকা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে বলেন কিন্তু আমার সিপাহীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং আমরা রাতের ফাইটে সাংঘাতিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় কল্যাণপুরের বাঙ্গালি এলাকায় চলে গিয়ে পুলিশের পোশাক ফেলে দিয়ে কলোনির বাঙ্গালি ভাইদের দেওয়া ছেড়া গেঞ্জি পড়ে কল্যাণপুর কলোনির ছাত্র-জনতার সাথে মিশে গিয়ে সেখানকার বাঙ্গালি জনতাকে সর্বতোভাবে সাহস দিতে থাকি। সকাল তখন দশতা বেজে গিয়েছিল। আমি আমার হাতে রাখা অচল অয়ারলেস সেটটা মেরামত করে সচল করে দিয়ে ঢাকার সব পুলিশ সেক্টর ডেড দেখলাম। মিরপুর থানার সহিত লাইন দিলাম, সেখান থেকে এক বাঙ্গালী কন্ঠ ভেসে আসছিল-জোর করে স্বাভাবিক করা সেই কন্ঠ বলছিল “মিরপুর থানা”-পরক্ষণেই এক অবাঙ্গালি পাকসেনা অয়ারলেস সেটে বলে ওঠে- “কোন শালা কাহা তোম বলতা হায়”। আমি বেশ বুঝতে পারি অয়ারলেসে বাঙ্গালি কন্ঠ শোনা গেলেও সেখানে পাকসেনাদের প্রভুত্ব বহাল রয়েছে। আমি এরপর আমার অয়ারলেস সেটতি অচল করে কল্যাণপুর কলোনির এক বাঙ্গালীর বাসায় রেখে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মসজিদে জনতার ব্যাকুল চাহনি কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। নামায শেষে বের হয়ে এসে পাশের এক ছোট ঘরে বসে আমি এমন সময় দেখলাম অসংখ্য দাঙ্গাবাজ বিহারি লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, পিছনে পাকসেনাদের গাড়ী। বিহারিরা সেখানে এসেই বাঙ্গালি কলোনিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু করে দিল। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের গাড়ি দুটো বিহারিদের বাঙ্গালি কলোনিতে লুন্ঠনে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা বিহারিদের তাণ্ডবলীলা আর সইতে পারলাম না-আমি আমার সিপাহীদের পজিশন নিয়ে বিহারিদের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলে দুজন বিহারি গুলি খেয়ে পড়ে যায়-আর সব বিহারি দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার মত কল্যাণপুর বাঙ্গালি কলোনি বেঁচে যায় বিহারি লুন্ঠন থেকে। আমাদের গুলিবর্ষণে বাঙ্গালি কলোনিতে আসন্ন পাক ও বিহারিরা হামলা ও লুন্ঠনের আশঙ্কায় সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মত পালাতে থাকে চারদিকে। এরপর আমি মিরপুর রাস্তার সামনে নদী পার হয়ে গ্রামের দীর্ঘ রাস্তা ধরে আমাদের সিপাহীদের নিয়ে অজানার পথে অদৃশ্য হয়ে যাই। `
[১৫৭] মেজর দেলাওয়ার হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত