You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.22 | নুরন্দী রেলস্টেশন যুদ্ধ, জামালপুর - সংগ্রামের নোটবুক

নুরন্দী রেলস্টেশন যুদ্ধ, জামালপুর

তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বে নুরন্দী রেলস্টেশন। এই রেলস্টেশনের উত্তর দিকে শেরপুর মহকুমা। পূর্বদিকে ময়মনসিংহ সদর মহকুমা এবং দক্ষিণ দিকে টাঙ্গাইল জেলা। নুরন্দী রেলস্টেশনটি জামালপুর থানায় অবস্থিত। ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্ত কামালপুর এবং পুরাখাশিয়া থেকে নুরুন্দী রেলস্টেশন প্রায় ৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, এলাকায় তাদের সেনা ইউনিট মোতায়েন করায় এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে স্থায়ী কোনো হাইড আউট সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। সীমান্ত এলাকা থেকে এই সময় বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনা হয়তো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিবহন ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করার লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ফোরক ব্যবহারের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে ময়মনসিংহ বাহাদুরবাদ ঘাটের মধ্যস্থলে জামালপুর এবং দিয়ারপুর রেলস্টেশনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইপিআর বাহিনীর নায়েক ফরহাদের নেতৃত্বে ৬০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠিত হয়। এই দলের মধ্যে ৬ জন ছিলেন এক্সপ্লোসিভ এবং ডিনামাইট বিস্ফোরণে পারদর্শী। যাদেরকে এই বিষয়ের উপর পৃথকভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য অতিরিক্ত ৫৪ জনের এই দলটিকে সাজানো হয়। ফরহাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা এই দলটিকে তিনটি সাবগ্রুপে বিভক্ত করা হয়। প্রথম গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন জাবেদ আলী, দ্বিতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ইলিয়াস চৌধুরী এবং তৃতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ডা. বাবর আলী। প্রত্যেক দলে ছিল সমান সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা। এদের সাথে ছিল ৬০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ এবং ৬টি এন্টি ট্যাংক মাইন। ২২ জুন রাতে ১১নং সেক্টরের অধীন মহেন্দ্রগঞ্জ সাব সেক্টরের কামালপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে নায়কে ফরহাদের নেতৃত্বে ৬০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এই অপারেশনের দায়িত্বে নিয়ে জামালপুর এলাকায় প্রবেশ করে। ২২ জুন ১৯৭১ ভোরবেলা ৬০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি মেরুর চরে এসে পৌঁছায়। এই স্থানে দিন যাপনের পর পুনরায় রাতে যাত্রা শুরু করে ২৩ জুন ভোরবেলা দলটি চরপুটিমারীতে পৌঁছে। গ্রুপ কমান্ডার এই গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে প্রাথমিক বেজ স্থাপন করেন। কর্দমাক্ত পথে এই সময় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চলা কষ্টকর ছিল। ২৪ জুন সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি জামালপুর জেলার লক্ষীরচরে এসে পৌঁছায়। গ্রামটি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর বরাবর উত্তর পাশে অবস্থিত। এই গ্রামের ৫ কিলোমিটার দূরত্বে পশ্চিম দিকে জামালপুর মহকুমা সদর দপ্তর। মাঝখানে ব্রহ্মপুত্র নদী। এমতাবস্থায় গ্রুপ কমান্ডার নায়েক ফরহাদ এলাকার জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং নিজ প্রচেষ্টায় অপারেশন এলাকায় পাকিস্তানীবাহিনীর সম্ভাব্য অবস্থান যাচাইয়ের চেষ্টা চালান। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থান বেশ শক্তিশালী ছিল যা ভেদ করে জামালপুর এবং পিয়ারপুরে প্রবেশ করা কষ্টকর হবে বলে বিবেচিত হয়। অপারেশনের মূল কমান্ডার নায়েক ফরহাদ অন্যান্য তিনজন গ্রুপ কমান্ডারের সাথে পরামর্শক্রমে সাথের সামান্য অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে জামালপুর এলাকায় প্রবেশ করা সম্ভব নয় ভেবে টার্গেটস্থল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাথের যোদ্ধারা কমান্ডারদের পরামর্শ মতে জামালপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বে নুরন্দী রেলস্টেশনটিতে আক্রমণ চালিয়ে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে স্টেশনটি উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান আশ্রয়স্থল থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর দক্ষিণ পাশে নুরন্দী রেলস্টেশনটির অবস্থান। নদীর তীর থেকে এর দূরত্ব ২ কিলোমিটার। ২৫ জুন সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধা দলটি ৩টি নৌকাযোগে লক্ষীরচরের পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে। পাশেই তুলশীর চরের মধ্যবর্তী স্থানে যেখানে ব্রহ্মপুত্র কিছুটা কম প্রশস্ত সেখান দিয়ে নদী পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন মধ্যরাত, চারদিকে অন্ধকার। বিনা বাঁধায় পর পর তিনটি নৌকা নুরন্দীর পাড়ে এসে ভিড়তে সক্ষম হয়। নুরন্দী রেলস্টেশনের কাছাকাছি অবস্থান থেকে নায়েক ফরহাদ ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠিয়ে স্টেশনের অবস্থা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেন। তথ্য মতে, ১০/১২ জনের একটি রাজাকার দল স্টেশন পাহারায় নিয়োজিত আছে। যুদ্ধের পরিকল্পনা মতে নায়েক ফরহাদ পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করে তিনদিকে পজিশন গ্রহণের নির্দেশ দেন। স্টেশনের দু’পাশে দু’জন গ্রুপ কমান্ডার জাবেদ আলী এবং ইলিয়াছ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেয়। মূল দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফরহাদ নিজে। সাথে ডাঃ বাবর আলী। নায়েক ফরহাদ ষ্টেশনের উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে রাজাকারদের আটক এবং নিরস্ত্র করেন। রাজাকারদের বেঁধে নৌকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিস্ফোরক বহনকারী দল তড়িৎ গতিতে প্লাস্টিক স্লাভগুলো রেললাইনের একাধিক স্থানে বসিয়ে ডেটনেটিং করে সেফটি ফিউজ এবং করডেক্স জুড়ে ২০০ গজের অধিক দূরত্বে এসে সেফটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২ মিনিট পরেই প্রচণ্ড শব্দে রেললাইন খণ্ড বিখন্ড হয়ে দূরে গিয়ে পড়ে। কমান্ডার নায়েক ফরহাদ অপারেশন শেষে ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড়ে গোপন আস্তানায় ফিরে সেই রাতেই বন্দি রাজাকারসহ বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকে সেক্টর হেড কোয়ার্টারে প্রেরণ করেন।
[৩০] এ এস এম শামছুল আরেফিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত