You dont have javascript enabled! Please enable it!

ন্যাশনাল জুট মিলের যুদ্ধ, গাজীপুর

গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলায় ন্যাশনাল জুট মিলস অবস্থিত। এটি উপজেলা সদর থেকে ৮ কি.কি. উত্তরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কালিগঞ্জ-কাপসিয়া রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ন্যাশনাল জুট মিলেও তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। শীতলক্ষ্যা নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পাকবাহিনী অবস্থান নেয়। মূলতঃ কুমিল্লা-ঢাকা রেল লাইনকে মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করে তা সরবরাহ লাইন হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল পাকবাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য। ঘোড়াশাল-কালিগঞ্জ ব্রিজের কালিগঞ্জের দিকে অবস্থানরত পাকসেনারা এবং জুট মিলে অবস্থানরত পাকসেনারা স্থানীয় গ্রামগুলোতে অত্যাচার চালাত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করত। মুক্তিযুদ্ধ যখন আস্তে আস্তে তিব্র আকার ধারণ করে তখন অন্য সেক্টরে সেনা প্রেরণের প্রয়োজনে অক্টোবরের প্রথম দিকে তারা ন্যাশনাল জুটমিল থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত মিলের সার্বিক নিরাপত্তা অফিসার ছিল মোঃ আব্বাসী এবং ম্যানেজার ছিল মি. রিজভী। যারা উভয়ই পাকিস্তানী। এর ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে নির্বিঘ্নে তাঁদের ঘাঁটি স্থাপন করতে পেরেছিল। নভেম্বরের শেষ দিকে আবার ক্যাম্প স্থাপন করে মিলের কর্মচারীদের নিকট মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরও সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। মিলের প্রশাসনিক অফিসার মি.আবু তালেব এবং প্রোডাকশন অফিসার মি.ইসমাইল গোপনে মুক্তিবাহিনীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করে এবং চতুর্দিকে হিন্দু অধ্যষিত এলাকার মুক্তিবাহিনিকে সক্রিয় করে তোলে। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা ন্যাশনাল জুটমিল হতে উত্তরে কাপাসিয়ার দিকে এগুতে থাকে। প্রায় ২ কি.মি. উত্তরে যাওয়ার পর জামালপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এমতাবস্থায় পাকিস্তানীরা পিছু হতে ন্যাশনাল জুট মিলে ফেরত আসে। উপরোক্ত ঘটনায় প্রায় ৫০-৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্যের একটি দল ক্ষিপ্ত হয়ে ১ ডিসেম্বর আনুমানিক বিকেল পাঁচটায় ন্যাশনাল জুট মিলের ১৪২ জন কর্মকর্ত- কর্মচারীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ছিল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে ন্যাশনাল জুট মিল রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা এহেন ঘটনাকে আজও আশ্রুসিক্ত নয়নে কারবালার প্রান্তরের সাথে তুলনা করেন। পাকসেনারা তাঁদের এরূপ হীন কর্মকাণ্ডের পর আর সে এলাকায় থাকাকে নিরাপদ মনে করেনি।
ঐ দিনই অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি দল নদীপথ ও স্থলপথে ন্যাশনাল জুটমিলে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এতে পাকসেনাদের বেশ কয়েকজন নিহত হয়। কিছু পাকিস্তানী সেনা নদীপথে কালিগঞ্জের দিকে এবন কিছু পূবাইলের দিকে সড়কপথে পালিয়ে যায়। ১৪ ডেসেম্বর সকালে পলাশ থেকে পালিয়ে আসা পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ন্যাশনাল জুট মিলস থেকে প্রায় ২ কি.মি. পশ্চিমে ঈশ্বরপুরের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পলায়নপর পাকসেনাদের এক সংঘর্ষ হয়। এখানেও এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আব্দুল আজিজ এবং এখানেই মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হসেন শহীদ হন। মোজাফফর হসেন গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শক্রর বিরুদ্ধে নিজের অস্ত্রকে সক্রিয় রেখেছিলেন। যুদ্ধে পাকবাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত ও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে আরো যারা নিজের জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তারা হলেন কমান্ডার সিরাজ, মোঃ নাজিম উদ্দিন গাজী ও মোবারক আলী মোড়ল।
এই যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর ৫/৭ জন মারা যায় এবং ৩ জন ধরা পড়ে। অবশিষ্ট পাকিস্তানী সোইন্য ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ন্যাশনাল জুটমিলের ১৪২ জন মৃত কর্মকর্তা কর্মচারীর মধ্যে ৭৬ জনকে মিলের পাশে গণকবর দেয়া হয় এবং বাকি ৬৬ জনকে তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। ঈশ্বরপুরের মাঠে পাকিস্তানী বাহিণির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর শহীদ হন। বর্তমানে ন্যাশনাল জুটমিলের পার্শ্বে শহীদদের স্মরণে স্থানীয় উদ্যোগে গণকবরের উপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!