You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৫শে মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া

৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ দেশে কী হচ্ছে তা নিয়ে যখন সারা দেশে বিপুল উৎকণ্ঠা, জাতির সেই ক্রন্তিলগ্নে দিক নির্দেশনাবিহীন দিশেহারা অসহায় জাতির পক্ষে সে সময় পুরো ৫০০ সৈন্যের একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মেজর (পরবর্তীকালে কর্নেল) শাফায়াত জামিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ’৭১-এ এটিই ছিল সবচেয়ে বড় নিয়মিত বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যোগদানের ঘটনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের মে মাসে এই ব্যাটালিয়ন লাহোর থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে স্থানান্তরিত হয়। ’৭১-এর নির্বাচনে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে এই ইউনিটের একটি কোম্পানিকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের হবিগঞ্জ পাঠানো হয়। নিরবাচনোত্তর সময়েও কোম্পানিটি সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান। ২৫ মার্চের আগেই তার কিছু কার্যকলাপ ইউনিটের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের সন্দিহান করে তোলে।
কুমিল্লা সেনানিবাস্থ ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সমূলে খতম করার জন্য পাকিস্তানীরা একটি নীল নকশা তৈরি করে ছিল। মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকেই কতগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের কারণে বাঙালি সৈনিকদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। দেখা যায়, ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির গান ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্দিকে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও জেসিওদের, বিশেষ করে আর্টিলারির সদস্যদের গতিবিধি ও চলাফেরা বৃদ্ধি পায়। রাতের বেলা ইউনিট লাইনের চারপাশে, অফিসারদের আবাসস্থল, অস্ত্রাগার ও কোয়ার্টার গার্ডের দিকে আর্টিলারির গান তাক করে রাখা হত। এছাড়া দিনের বেলায় যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সে জন্য গানগুলো বাইরের দিকে তাক করে রাখা হত। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানকারী ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থির লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়। তাছাড়া ইউনিট লাইনের বাইরে বাঙ্কার খনন করা হয়। কৌতূহলবশত কেউ জিজ্ঞাসা করলে ট্রেসিং করার অজুহাত দেয়া হত। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অস্ত্র সমর্পণের ব্যাপারে অসম্মত হলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত আগেই নির্ধারণ করে রাখে পাকিস্তানিরা। ব্রিগেড কমান্ডার ও ব্রিগেডের অন্যান্য অফিসারদের পূর্ব অবগতি ছাড়াই অপ্রত্যাশিতভাবে ইউনিট লাইন পরিদর্শন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ইউনিটের খেলার মাঠে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিওদের সাথে ব্রিগেডের অফিসার ও জেসিওদের দৈনিক খেলাধুলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেটা স্বভাবিক নিয়মে বছরে একবার বা দুইবার হয়ে থাকে। এমনকি খেলার মাঠ রক্ষার জন্য ইউনিটের প্রটেকশন পার্টিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়োগ করা হয়। সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে নিয়োগ করে সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা করা হলেও সকল স্তরের সদস্যদের ছুটির ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ আরোপ হয়নি। বরং ইউনিট অধিনায়ক এবং ব্রিগেড কমান্ডার উভয়েই যার যার প্রয়োজন ও ইচ্ছানুযায়ী ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ব্যাটালিয়ন অধিনায়কসহ ব্রিগেড কমান্ডার সপ্তাহে বেশ কয়েকবার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের উপদেশ দিতেন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেটা ছিল ব্যাতিক্রমী ঘটনা।
১০ মার্চ রেশন বোঝাই ১৭টি গাড়ি কুমিল্লা থেকে সিলেটে পাঠানো হয়। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার সামছুল হক এবং ১০ জন বাঙালি সৈনিককে কনভয়ের নিরাপত্তায় রাখা হয়। এই রসদপত্র বোঝাই কনভয়ের গন্তব্যস্থল ছিল সিলেটের খাদিমনগর। সেখানে মোতায়েন ছিল ৫৩ পদাতিক বিগ্রেডের অপর একটি ইউনিট ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। এই কনভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকও ছিল। রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেড সরিয়ে দুইদিনে কনভয়টি কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগে থেকেই অর্থাৎ পহেলা মার্চ থেকেই মেজর শাফায়াত জামিল তার চার্লি কোম্পানিসহ অবস্থান করছিলেন। রেশনের কনভয় খাদিমনগরে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি আদেশ পান। তাকে ৩৫ জন সৈনিক অর্থাৎ এক প্লাটুন এসকরট হিসেবে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রাস্তায় বড় বড় গাছের অসংখ্য ব্যারিকেড তুলে প্রায় ১২০ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। তিনদিন একটানা চলার পর রেশনের কনভয় নিয়ে মেজর শাফায়াত খাদিমনগর ৩১ পাঞ্জাবের অবস্থানে ১৬ মার্চ উপস্থিত হন।
সিলেট পৌছার পর ৩১ পাঞ্জাবের অধিনায়ক সাফল্যের সঙ্গে কনভয় নিয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য মেজর শাফায়াতকে ধন্যবাদ জানান। তারপর তাঁদের বহনকৃত অস্ত্রশস্ত্র কোতে জমা রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্ত পাকিস্তানিদের মনোভাব অনুকূল মনে না হওয়ায় সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। বিশেষ করে সিনিয়র এনসিওরা মেজর শাফায়াতকে জানায় যে, আমরা একটা অপারেশন এরিয়া থেকে এসেছি, তাই আমরা নিজেদের অস্ত্র অন্য রেজিমেন্টের অস্ত্রগারে জিমা রাখতে পারি না। অধিনায়ককে এ মতামত জানিয়ে দেয়া হলে তিনি চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকেন। ধারণা করা যায় যে, পাকিস্তানিরা এ বিষয়ে আর বেশি চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন বোধ করেনি কারণ, ২৫ মার্চের বাঙালি হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। মেজর শাফায়াতকে জানানো হয়, তার ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে পরবর্তী নির্দেশ আসবে। অবশ্য মৌখিকভাবে তাৎক্ষণিকভাবে বলা হয়, সিলেটে বিভিন্ন চা বাগানে কর্মরত অবাঙালি অফিসারদের পরিবারকে এসকরট করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে। তাঁদের জড়ো করতে সময় লাগবে এবং সে পর্যন্ত ৩১ পাঞ্জাবের সঙ্গে তাদরকে থাকতে হবে।
পরদিন ১৭ মার্চ মেজর শাফায়াত তার জন্য পরবর্তী করনীয় আদেশ আছে কি না জানতে চান। কিন্ত তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি। এমন কি কুমুল্লাস্থ নিজ ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলারও সুযোগ দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লায় বাঙালি সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। মেজর শাফায়াতের অধীনে জয়দেবপুর ও কুমিল্লায় উক্ত জেসিও ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুবাদে সুবেদার মেজর ইদ্রিসকে অত্যান্ত বিশ্বাসভাজন হিসেবে জানতেন। ইদ্রিস মিয়াকে তিনি বললেন, ‘কিছু বুঝতে পারছেন ইদ্রিস সাহেব? এরা আমাকে কোন অর্ডারও দিচ্ছে না, যেতেও দিচ্ছে না’। তিনি উত্তর দিলেন, ‘স্যার, সবই বুঝেছি। আপনি কিছু বলবেন না, আমি সিও সাহেবকে বলবো, তিনি যেন আপনাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে আসেন’। উল্লেখ্য, অধিনায়কের ওপর একজন সুবেদার মেজর প্রচুর প্রভাব খাটিয়ে থাকে। ক্যান্টেনমেন্টে অবস্থানরত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়া মেজর শাফায়াত ও তার দলকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অধিনায়ককে চাপ দেন। শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত ব্রিগেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শফির সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে আসেন। চারদিকে তখন চাপা উত্তেজনা।
মার্চের ১৮/১৯ তারিখে রাত প্রায় বারোটার সময় আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন বাঙালি সৈনিক এসে খবর দেয় যে, আজ রাতে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা হামলা চালাবে। এ খবর পাওয়া মাত্রই ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট মাহবুব ও লেফটেন্যান্ট কবীর সেনানিবাসে অবস্থানরত দুই কোম্পানির সৈনিকদের নিজ নিজ অস্ত্র কাছে রাখার নির্দেশ দেন। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মতো সেনানিবাসের অন্যান্য পাকিস্তানি পাকিস্তানী ইউনিটও অস্ত্রশস্ত্রসহ তৈরি থাকে। সে রাতে কোন হামলা হয়নি। ২০ মার্চ সকালে অস্ত্রগুলো যথারীতি কোতে জমা করা হয়। অধিনায়কের বিনা আদেশে কত (অস্ত্রাগার) হতে গভীর রাতে অস্ত্র বের করা এবং সকালে জমা দেয়ার ব্যাপারে কারো কাছে থেকে কোন কৈফিয়ত নেয়া হয়নি। ব্যাপারটি বেশ বিস্ময়কর। কারণ ইউনিট অধিনায়কের নির্দেশ ছাড়া দুইটি কোম্পানির অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকা স্বাভাবিক নিয়মে সম্ভবপর ছিল না। এটা সামরিক নিয়মের পরিপন্থী।
পহেলা মার্চে মেজর শাফায়াত জামিল এবং পাকিস্তানী অফিসার মেজর সাদেক নেয়াজকে সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের উক্তি ছিল ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ অনিবার্য ও অত্যাসন্ন। এ জন্য সৈনিকদের রণকৌশলগত বিন্যাস জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পাকিস্তানী শাসকচক্রের সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশবিশেষ। বেশি সংখ্যক বাঙালি সৈনিককে একত্রে সংগঠিত অবস্থায় রাখা তাদের কাছে নিরাপদ মনে হয়নি। তাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত কর বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাতে মার্চের ১ তারিখ ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর সাদেক নেয়াজ (অবাঙালি)-এর নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। এদিকে ২৪ মার্চ মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব প্রায় ২৫০ জন সৈন্যের একটি দলকে নকশাল অনুপ্রবেশ দমনের নামে সিলেটের শমসেরনগরে প্রেরন করা হয়। চার্লি কোম্পানি নিয়ে কোম্পানি কমান্ডার মেজর শাফায়াত অবস্থান নেন ব্রাম্মনবাড়িয়া-সিলেট সড়কে তিতাস নদীর ওপর শাহবাজপুর সেতু এলাকায়। এছাড়া মেজর সাদেক ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে তার সৈন্যদের নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা সড়কে নদীর ওপর উজানীচর ব্রিজের কাছে। উভয় কোম্পানি নিজ নিজ অবস্থানে তিতাস নদীর পাড়ের ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কার খুঁড়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরস্ত ওয়াপদা রেস্ট হাউস সংলগ্ন এলাকায় অফিসারবৃন্দ কিছু সৈনিক নিয়ে তাঁবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান নেন। নিয়মিতভাবে আশপাশের এলাকায় রেকির কার্যক্রম চলে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যুদ্ধাবস্থানে যাত্রার জন্য সৈন্যরা প্রস্তুত থাকে।
চার্লি কোম্পানিতে মেজর শাফায়াত জামিল (কোম্পানি কমান্ডার) ছাড়াও বাঙালি অফিসার ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবু কায়সার ফজলুল কবির। ডেল্টা কোম্পানিতে ছিলেন একমাত্র বাঙালি অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হারুন-অর-রশিদ এবং উভয় কোম্পানির মেডিক্যাল অফিসার (এমএ) নিয়োজিত হন বাঙালি অফিসার লেফটেন্যান্ট আখতার আহমেদ।
২২ মার্চ ঢাকা থেকে বদলি হয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ কুমিল্লা সেনানিবাস্থ ৪ ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করেন। তার আগে তিনি ঢাকায় অবস্থিত ৫৭ বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজর (বিএম) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। বিগ্রেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আকবার খান। মেজর খালেদ লক্ষ করেন যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিগ্রেড কমান্ডার তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ ব্রিগেড কমান্ডের ক্ষেত্রে বিগ্রেড মেজর ও ব্রিগেড কমান্ডার সার্বক্ষণিকভাবে পরসপর নির্ভরশীল। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৫৭ ব্রিগেড ঢাকা নগরীতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। সে সময় বাঙালি অফিসার হওয়ার দরুন মেজর খালেদকে ব্রিগেড কমান্ডার বিশ্বাস করতে পারেননি। তারই ফলশ্রুতিতে তাকে কুমিল্লাস্থ ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ইউনিটে যোগদান করেই তিনি সৈনিকদের উদ্বিগ্নতা লক্ষ করেন। তিনি অবগত হন যে, ৩ কমন্ডো ও ৫৩ আর্টিলারি রেজিমেন্ট ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্দিকে বাঙ্কার খনন করে ভারী অস্ত্র স্থাপন করেছে। যে কোন সময় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রান্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় ইউনিটের সদস্যবৃন্দ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ২৩ মার্চ ছিল ছুটির দিন। ২৪ মার্চ সকাল সাতটায় মেজর খালেদ মোশাররফ অফিসে উপস্থিত হতেই অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান তাকে সিলেটের সীমান্তবর্তী স্থানে শমসেরনগরে নকশাল অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য দায়িত্ব নিতে বলেন। অধিনায়কের এমন অস্বাভাবিক নির্দেশ পেয়ে মেজর খালেদের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কারণ তিনি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন। এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে একজন উপ-অধিনায়কের কোন বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার কথা নয়। এছাড়া কাচজে নতুন যোগদানের পর তার দায়িত্বসমূহ পুরোপুরি বুঝে নেয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। কিন্ত এত শীঘ্র অন্যত্র চলে যাবার নির্দেশ পেয়ে তিনি কিছুটা সময়ের প্রার্থনা করেন কিংবা অন্য কোন অফিসার নিয়োগের অনুরোধ জানান। অধিনায়ক এ পরামর্শের তোয়াক্কা না করেই অনতিবিলম্বে লেফটেন্যান্ট নির্দেশিত স্থানে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন।
অতঃপর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত মেজর খালেদকে কুমিল্লাস্থ ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে নিয়ে যান। বিগ্রেড কমান্ডার মেজর খালেদকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আর্মি ট্রুপস ছাড়াও ইপিআর-এর দুটো কোম্পানি কমান্ড করার জন্য তুমি ছাড়া অন্যকোন সিনিয়র অফিসার না থাকায় তোমাকেই যেতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে অগত্যা মেজর খালেদ শমসেরনগর যাওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণের দাবি উত্থাপন করেন। ব্যাপক এলাকার নকশাল অনুপ্রবেশ নিরোধকল্পে এক কোম্পানির অধিক জনবল, সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগের জন্য একটি ওয়্যারলেস সেট এবং বেশি সংখ্যক স্বয়ংক্রিয় ভারী ও হালকা অস্ত্র, মর্টার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদ সাথে নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি তার এ আবেদন প্রথমে নাকচ করলেও মেজর খালেদের অকাট্য যুক্তির জন্য সম্মতি দেন। মেজর খালেদ ব্যাটালিয়নে ফিরে এসে এডজটেন্ট ক্যাপ্টেন গাফফারকে পুরো ব্যাটালিয়ন থেকে ২৫০ জন চৌকস সৈনিক বাছাই করে আলফা কোম্পানি পূর্ণগঠনের নির্দেশ দেন। ব্যাটালিয়নের সকল ভারী অস্ত্র ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ব্রিগেড থেকে সরবরাহকৃত ২৬ টি লরিতে বোঝাই করা হয়। এ বোঝাই কার্যক্রমের দীর্ঘ সময় ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক খিজির হায়াত ও বিগ্রেড স্টাফ অফিসাররা উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করেন।
২৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কনভয় শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যাত্রার পূর্বে মেজর খালেদ মোশাররফ বাঙালি অফিসারদের সাথে আলাপকালে ইউনিটের সকলকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। কুমিল্লা সেনানিবাসে সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিনকে বিশেষভাবে সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়ে যান। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে প্রয়োজনে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে যান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌছতে প্রায় রাত ২টা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। রাস্তার ঘন ঘন ব্যারিকেড তুলে অগ্রসর হতে প্রচণ্ড জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। শহরের নিয়াজ পার্কের কাছে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা রাস্তায় শুয়ে পড়ে। তারা জানায়, সামরিক বাহিনীর কোন কনভয় যেতে দেয়া হবে না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এমসিএ লুৎফুল হাই সাচ্চু এবং এমসিএ আলী আজমসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা বলেন, পাকিস্তান বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের ওপর গুলি চালিয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশে মিলিটারি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাঙালি সৈনিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এটা হতে দেয়া যাবে না। এভাবে কয়েক ঘন্টা যাবৎ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথাবার্তা বিনিময় হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর শাফায়াত জামিল ব্যাপারটি অবগত হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনিও জনগণকে বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান কিন্ত নেতৃবৃন্দকে ব্যারিকেড সরানোর ব্যাপারে সম্মত করা সম্ভব হচ্ছিল না। অতঃপর মেজর শাফায়াত জামিলের ক্যাম্পে কতিপয় নেতৃবৃন্দকে ডেকে নেয়া হয় এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয় যে, বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙালিদের রেজিমেন্ট, বাঙালির প্রয়োজনের সময়ে এ রেজিমেন্ট পিছিয়ে থাকবে না। কিন্ত এ মুহূর্তে কনভয়কে বাধা দেয়া ঠিক হবে না।
২৫ মার্চ সকাল সাড়ে সাতটায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ব্যারিকেড তুলে ফেলার এবং সেনাবাহিনীর চলাচলে বাধা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর মেজর খালেদ মোশাররফের যানবাহন পুনরায় শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ২৫ মার্চে যাত্রার আগের রাতের খাবারের সময় মেজর খালেদের সাথে মেজর শাফায়াতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। মেজর খালেদ বলেন, পাকিস্তানিরা পার্লামেন্ট বসতে দেবে না, ক্ষমতা হস্তান্তরও করবে না। একটা জাতিকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা জেনোসাইড ঘটানোর পরিকল্পনা আঁটছে। আমাদের সর্বতোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। অসামরিক পোশাকে বিমানে করে বেশ কিছু পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন ঢাকায় এনেছে তারা। এ ছাড়া জাহাজে করেও অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয়েছে। হত্যাযজ্ঞ ঘটানো হবেই এবং তাহলে বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাই তারা আগে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ফেলার চক্রান্ত করছে। মেজর খালেদের এই সচেতন ভাবনা চাকরিরত বহু বাঙালি অফিসারের ভিতরে অনুপস্থিত ছিল।
মেজর খালেদকে মেজর শাফায়াত আগে থেকে চিনতেন না। উভয়ের সাক্ষাতে পারস্পরিক খবরাখবর বিনিময় ছাড়াও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। খালেদ অয়ারলেসের একটি পৃথক ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করে দেন এবং সময় সুযোগে আলাপ করতে বলেন। এ ব্যাবস্থায় মেজর শাফায়াত খানিকটা আশ্বস্ত হন এবং সংকটময় মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটা ভরসা খুঁজে পান। মেজর শাফায়াত সুবেদার ওয়াহাবের মাধ্যমে কুমিল্লা সেনানিবাসের সকল প্রকার অস্বাভাবিক ঘটনা জানতে পারেন। যাওয়ার প্রাক্কালে মেজর শাফায়াত জামিলকে আলাদাভাবে ডেকে সতর্ক থাকতে বলেন এবং ওয়্যারলেসের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেন।
মেজর খালেদ তাঁর যানবাহনসহ শ্রীমঙ্গলে পৌছতে সকাল প্রায় এগারটা বেজে যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে শমসেরনগরে যাবার পথ মেজর খালেদের জানা ছিল না। অবশ্য ব্রিগেড হেডকয়ারটার থেকে নির্দেশ ছিল মৌলভীবাজার হয়ে যেতে। মেজর মোশাররফ স্থানীয় ব্যক্তিদের শমসেরনগর যাওয়ার কি কি পথ রয়েছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে, মৌলভীবাজার হয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল রাস্তা দিয়ে অথবা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সোজা রাস্তায় যাওয়া যায়। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে রাস্তাটি অনেক সোজা ও কম দূরত্বের কিন্ত বেশ দুর্গম ও বন্ধুর। যানবাহরকে নিয়ে এই জঙ্গলময় প্পাহাড়ি রাস্তা ও চা বাগানের মধ্য দিয়ে রওয়ানা দেন মেজর খালেদ। বেশ কষ্টসাধ্য বিকল্প রাস্তা দিয়ে বেলা দুটোর দিকে কনভয়টি শমসেরনগর পৌছে। সেখানকার ডাকবাংলোতে মেজর খালেদ ক্যাম্প স্থাপন করেন।
মেজর খালেদের কনভয় দিয়ে যাবার পূর্বনির্দেশিত পথ ছিল মৌলভীবাজার হয়ে শমসেরনগর। কিন্ত তিনি ভিন্ন পথ ধরে শমসেরনগর পৌঁছান। মৌলভীবাজারের পথে ৩১ পাঞ্জাব আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। সে পথে মেজর খালেদকে যেতে নির্দেশ দেয়া হলেও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থানের কথা তাঁর কাছে অজ্ঞাত রাখা হয়। ব্যাপারটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, মেজর খালেদ সে পথে গেলে জানমাল বিপন্ন হতে পারত। এখানে মেজর খালেদ নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞাবান সামরিক কর্মকর্তার পরিচয় দেন। সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত ফাঁদ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় খালেদের পক্ষে।
মেজর খালেদ ও লেফটেন্যান্ট মাহবুব দুপুরের খাবার সেরে শমসেরনগরের আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণে বের হন। তিনি সেখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক দেখতে পান। ব্রিগেড কমান্ডার ও ইউনিট অধিনায়কের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোন কিছুরই বাস্তব মিল খুঁজে পাননি। নকশাল দলের অনুপ্রবেশ কিংবা উপদ্রপ বিন্দুমাত্র দেখা যায়নি। ইপিআর-এর দুটো কোম্পানি এখানে থাকার কথা কিন্ত বাস্তবে নেই। শমসেরনগর বিমান বন্দরে প্রহরারত ইপিয়ার-এর একজন সুবেদার এবং কয়েকজন সিপাহীকে জিজ্ঞাসা করে বিশেষ কোন বিষয় কিংবা প্রতিকূল তথ্য জানা যায়নি। শুধু জানা যায়, চা বাগাবের পাকিস্তানি ম্যানেজার এবং কর্মকর্তাবৃন্দ ঢাকা চলে গেছে। অন্যকোন সমস্যা সেখানে নেই। ইতোমধ্যে সেনা টহল দল নিয়োগ করে আশপাশের পরিস্থিতি অবলোকনের ব্যবস্থা করা হয়।
মেজর খালেদের পুরো ব্যাপারটাতে একটা কূটকৌশল রয়েছে বলে ধারণা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত কতৃক যা কিছু বলা হয় তা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। একজন জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে বিশেষ করে উপ অধিনায়কের সাথে ইউনিট অধিনায়কের প্রবঞ্চনামূলক ব্যবহারে খালেদ আশ্চর্য হন না। এ কুমতলবপূর্ণ দুরভিসন্ধিমূলক আচরণে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দুপুর পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে সুফল পাওয়া যায়নি।
মেজর খালেদ ও লেফটেন্যান্ট মাহবুব শমসের নগরের ডাকবাংলোতে বসে আছেন। এমন সময় এক ব্যক্তি জানায় যে, শমসেরনগর বাজারে পাকিস্তানি অফিসার ও সৈনিকরা কারফিউ জারি করে স্থানীয় লোকজনদের ওপর অত্যাচার করছে। উক্ত দলটি মেজর খালেদের ক্যাম্পের সম্মুখ দিয়ে মৌলভীবাজার যেতে প্রহরীর মাধ্যমে পাকিস্তানি অফিসারকে ক্যাম্পে ডেকে পাঠানো হয়। অফিসারটি মেজর খালেদকে এখানে দেখে অবাক হন। তার কথাবার্তায় অসংলগ্নভাব উপলব্ধি হয়। কথোপকথনে জানা যায়, ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বেশ কিছু সৈন্য সিলেট থেকে মোউলভীবাজার এসে দুদিন আগে ক্যাম্প স্থাপন করেছে। সেই অফিসারের অস্বস্তিকর আচরণ মেজর খালেদ মোশাররফকে সন্দিহান করে তোলে। পাঞ্জাবী অফিসারটিকে ক্যাম্পে থাকাকালীন তার স্টেনগানটি সবসময় নিজের কাছেই সতর্কভাবে রাখতে দেখা যায়। এতে সন্দেহ আরো গভীর হয়। এ সৈন্যদলটির আগমন সম্পর্কে কোন আগাম তথ্য জানানো হয়নি। এটাও অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হয়। অফিসারটি তার দলসহ বিদায়কালে মেজর খালেদকে তাদের থাকার আমন্ত্রণ জানান, কারণ তাদের ক্যাম্পটি অনেকটা সুবিন্যস্ত রয়েছে। থাকা খাওয়ার ব্যাপারে বেশ সুবিধা হবে।
সেদিন বিকেলেই স্থানীয় জনসাধারণের মাধ্যমে মেজর খালেদ মোশাররফ জানতে পারেন ঢাকায় ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে। কিন্ত কেউ সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারেনি। ক্রমশ লোকমুখে জানা যায় যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী অসংখ্য লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং এ হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও পাকবাহিনী নৃশংস অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য লোক জীবন বাঁচানোর জন্য ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্ক, কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নির্দোষ নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর বর্বরোচিতভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে ও হত্যা করছে। ঢাকা শহর একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
মেজর খালেদ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। অনেকক্ষণ পর যোগাযোগ হয়। মেজর খালেদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আহে আরো নিশ্চিত হওয়ার কথা ভাবলেন। মেজর খালেদ মোশাররফ ওয়্যারলেসের হ্যান্ডসেট ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত (অধিনায়ক ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কিংবা লেফটেন্যান্ট আমজাদ (পাঞ্জাবী)-এর কন্ঠস্বর শোনা যায়। তাদের কাছে খোলামেলা আলাপ করা কিংবা সর্বশেষ সঠিক পরিস্থিতি জানা সম্ভব ছিল না। অত্যান্ত সংক্ষিপ্ত আলাপে বোঝা যায় যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত এবং ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি অংশ কুমিল্লা থেকে ২৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে এসেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত মেজর খালেদকে জানালেন, সবকিছু স্বাভাবিক। তাকে মূল ইউনিটে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করা হোক। কিন্ত অধিনায়ক এর জবাবে মেজর খালেদকে সেখানেই অবস্থান করার কথা পুনরব্যক্ত করেন।
কিছুক্ষণ পর পুনরায় ওয়্যারলেসে যোগাযোগ হয় ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে। তিনি বাঙালি অফিসার এবং ইউনিটের এডজুটেন্ট। তার কথার ইঙ্গিতে মেজর খালেদ বুঝতে পারেন ক্যাপ্টেন গাফফারের কাছাকাছি পাকিস্তানি অফিসার রয়েছে। সুতরাং সব কথা বলা সম্ভব নয়। মেজর খালেদ জানিয়ে রাখলেন, মেজর শাফায়াতের সাথে বার্তাবিনিময় হলে তার সাথেও যেন আলাপ করেন।
এর বেশ কিছুক্ষণ পর মেজর শাফায়াতের কল আসে। তিনি মেজর খালেদকে জানান ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে নির্মমভাবে গণহত্যা চালিয়েছে। এখনও অবিরত ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ আলাপ হয় ২৬ মার্চ সন্ধ্যাবেলা। মেজর শাফায়াত জামিল লোকমুখে শুনেছেন যে, ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে লোকজন কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসছে। আরো জানা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সান্ধ্যা আইন জারি হয়েছে এবং এটা কার্যকরী করতে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্ত সেখানকার জনসাধারণ সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে মিছিল বের করেছে। এমতাবস্থায় মেজর শাফায়াত ও ক্যাপ্টেন গাফফার পরপর তাদের করণীয় সম্পর্কে মেজর খালেদকে সিদ্ধান্তের জন্য অনুরোধ জানান।
মেজর খালেদ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক। অপরদিকে জ্যেষ্টতম বাঙালি অফিসার। সেই হিসেবে তার কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্ত মেজর খালেদ তাদের সবুজ সংকেত দেয়ার আগে কিছুটা ভাববার সময় নেন। তিনি তাৎক্ষণিক কোন জবাব না দিয়ে পরে জানানোর কথা বলেন। মেজর খালেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রায় ১২০ মাইল দূরে অবস্থান করছেন। ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে গণহত্যার নির্ভুল খবর পাওয়া বেশ কঠিন ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও প্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ নেই যে, পরামর্শ নেবেন। একদিকে সামরিক শৃঙ্খলা ও করতব্যবোধ অন্যদিকে বিবেকের দংশন তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মেজর খালেদ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেন। তিনি কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। তাঁর সাথের বাঙালি সৈনিকরাও বেশ উদ্বিগ্ন। তারা শুধু নির্দেশের অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত বিবেকের তাড়নায় সকল চিন্তার অবসান হয়। স্থির হয় বিদ্রোহ করবেন। তিনি লেফটেন্যান্ট মাহবুবকে দৃঢ় কন্ঠে বলেন, এই মুহূর্তে আমি স্বাধীন বাংলার আনুগত্য স্বীকার করলাম। তুমি সব সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলে দাও, আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নই। তিনি আরো বলেন, আমরা ঢাকার দিকে যাত্রা করব। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একত্র করতে হবে। লেফটেন্যান্ট মাহবুব ও নির্দেশ সৈনিকদের জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথে তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। মেজর খালেদ সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, অত্যন্ত কঠিন সংগ্রাম শুরু হল। সকলকে স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও জাতির জন্যে আত্মীয়স্বজনসহ, আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা বিসর্জন দিতে হবে।
এদিকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর শাফায়াত কুমিল্লা থেকে নির্দেশ পান, আরো লোক আসছে। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্ত কারা আসছে তা বলা হল না। ব্রাভো কোম্পানিটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের সাথে কুমিল্লায় ছিল। এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন গাফফার অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারের নির্ভেজাল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ক্যাপ্টেন গাফফার পরবর্তীকালে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত তেমন জটিল প্রকৃতির লোক ছিলেন না। সুকৌশলে তাঁকে আয়ত্ত করা যেত”। ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁকে বুঝাতে সক্ষন হন যে, ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈনিকদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা উচিত।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত কুমিল্লাস্থ অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করার ব্যাপারে ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে আলাপ করেন। ব্রিগেড কমান্ডারের অনুমতি সাপেক্ষে ৩০টি ৩ টনের গাড়িতে ব্যাটালিয়নের সকল অস্ত্রশস্থ, গোলাবারুদ ও রসদ ভান্ডারসহ ২৫ মার্চ রাত আটটায় ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছেন। অফিসারদের পরিবারবর্গ কুমিল্লা সেনানিবাসে রয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মতিনও তাঁর ব্র্যাভো কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। তবে জাঙ্গালিয়ায় এক প্লাটুন সৈনিক রেখে যান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পর বলেন, যুদ্ধ আসন্ন। তাই ব্রিগেড কমান্ডার তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২৫ মার্চ ব্যাটালিয়নটির অবস্থান দাঁড়ায়-
*আলফা কোম্পানির অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১২০ মাইল এবং কুমিল্লা থেকে ১৭০ মাইল দূরে শমসেরনগরে। এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ।
*ব্র্যাভো, চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানির অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মতিন, মেজর শাফায়াত ও মেজর সাদেক নেয়াজ (অবাঙ্গালি)
*হেডকোয়ার্টার কোম্পানিসহ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অবস্থান নেয়।
*৭০/৮০ জন লোক হিসেবে কুমিল্লায় ইউনিট লাইন প্রহরাসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কাজে থেকে যায়।
*এক প্লাটুন সৈন্য কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ গ্রিড স্টেশনের প্রহরায় রাখা হয়। এর মধ্যে কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার এমএ জলিল।
লেফটেন্যান্ট খিজির হায়াতের সাথে আসেন ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট আমজাদ (অবাঙালি) ও লেফটেন্যান্ট (ডা.) আবুল হোসেন। লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন এসেছিলেন আখতারের বদলি হিসেবে অস্থায়ী কর্তব্য। লেফটেন্যান্ট আখতারের পোস্টিং অর্ডার নিয়ে এসেছিলেন তিনি। লেফট্যানেন্ট আখতারের পোস্টিং হয় আজাদ কাশ্মীরের একটি গ্যারিসনে। অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াতের ভাষায় যুদ্ধ আসন্ন। তাই লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেনকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে এখানে আসতে ব্রিগেড কমান্ডার নির্দেশ দিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এসেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত মেজর শাফায়াতকে রাত এগারোটায় নির্দেশ দিলেন, তাঁর কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১৩ মাইল দূরে শাহবাজপুর পুলের কাছে প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করতে। মেজর শাফায়াত নির্দেশ পেয়ে প্রস্তুতি নেন এবং রাত দুটোয় সময় রওয়ানা হয়ে রাত তিনটায় সেখানে পৌছেন। ২৬ মার্চ সকাল ছ’টায় আবার খবর আসে কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফেরত যেতে হবে, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। সকাল সাতটায় আবার ফেরত যাত্রা শুরু হয়। কিন্ত ফেরত পথ কন্টকহীন হল না। কয়েক ঘন্টা আগে রাস্তা ছিল নির্বিঘ্ন। আর সকাল হতে না হতেই অসংখ্য ব্যারিকেডে রাস্তা পরিপূর্ণ। বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। মেজর শাফায়াতের বুঝতে বাকি রইল না, সেনাবাহিনীর গতিরোধ করার জন্যই ওই কাজ করা হইয়াছে। মেজর শাফায়াতকে ১২ মাইল রাস্তায় অন্তত কুড়ি জায়গায় এরকম ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হতে হয়। রাস্তা ও আশপাশের এলাকা একেবারে নির্জন ফাঁকা। ব্যারিকেড তুলে এ পথটুকু অতিক্রম করতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। সকাল দশটায় ক্যাম্পে ফিরে মেজর সাদেক নেয়াজ, ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট আমজাদ, লেফটেন্যান্ট আখতার, লেফটেন্যান্ট আমজাদ এদেরকে নিয়ে কমান্ডিং অফিসার বসে আছেন। মেজর শাফায়াতের সাথে ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কবির। অধিনায়কসহ অন্যদেরও বেশ গম্ভির দেখাচ্ছিল। পিনপতন শব্দও নেই। অধিনায়ক সামরিক ভঙ্গিতে মেজর শাফায়াতকে বললেন, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মতিনকে কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পাঠানো হয়েছে সান্ধ্য আইন কার্যকর করার জন্য। মেজর শাফায়াতকে নির্দেশ দিলেন, এক্ষুনি পুলিশ লাইনে গিয়ে পুলিশদের নিরস্ত্র করতে হবে। মেজর শাফায়াত সবিনয়ে জবাব দিলেন, পুলিশদের নিরস্ত্র করতে গেলে অহেতুক গোলাগুলি রক্তপাত হবে। অধিনায়ক অবশ্য চেয়েছিলেন, মেজর সাদেক নেয়াজ গিয়ে প্রয়োজনবোধে শক্তি প্রয়োগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করবে। রক্তপাত এড়ানোর জন্য মেজর শাফায়াত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, পরদিন তিনি নিজে গিয়ে পুলিশদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসবেন। এ কথায় তখনকার মতো নিবৃত হলেন খিজির হায়াত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত আসন্ন ষড়যন্ত্রের পুরোপুরি আভাস পেয়ে যান। ২৫ মার্চের আগেই তিনি একটি দুঃসাহসী কাজ করে ফেলেন। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্প্রতি ব্রিটিশ নির্মিত অস্ত্রের পরিবর্তে চীনা অস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে। ব্রিটিশ অস্ত্রগুলো তখনও ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারেই জমা হয়েছে। সময়াভাবে তা জমা করা হয়নি। মেজর শাফায়াত গোপনে সেসব অস্ত্র রেশন বহনকারী যানবাহনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনার ব্যবস্থা করেন। ব্রিটিশ নির্মিত সবগুলো অস্ত্র অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ২৫ মার্চের আগেই চাল ও আটার ব্যাগের মধ্যে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে আসা হয়। এটা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা সাধারণভাবে ব্যক্ত করার মোট নয়। বিশেষ করে অধিনায়কের অনুমতি ছাড়া একেবারে অজ্ঞাতে একটি অতিরিক্ত সেট অস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে অপারেশন এলাকায় আনা সেনাবিধি অনুযায়ী মারাত্মক অপরাধ। ২৫ মার্চের ক্রাকডাউন তখনও হয়নি। যুদ্ধের জন্য কোন আনুষ্টানিক ঘোষনাও নেই। অথচ ইউনিটের দুজন অফিসার হাতিয়ার স্থানান্তরের মতো বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২৬ মার্চ দুপুরের দিকে সিগন্যাল জেসিও নায়েক সুবেদার জহির তার ওয়্যারলেস সেট ইন্টারসেপ্ট করে কিছু অসম্পূর্ণ মেসেজ পেয়ে যান। মেসেজগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তা মেজর শাফায়াতকে জানান। পাক আর্মির দুটো স্টেশনের মধ্যে উর্দু ও ইংরেজিতে কথাবার্তাগুলো ছিল এরকম, ট্যাঙ্ক, এমুনিশনের দরকার। হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা কর। আমাদের অনেক হতাহত হচ্ছে। ইবিআরসি (East Bengla Regimental Centre)-এর অর্ধেক সৈন্য অস্ত্রসহ অথবা অস্ত্র ছাড়া বেরিয়ে গেছে। এ মেসজটি পেয়ে মেজর শাফায়াত দুশ্চিন্তায় পড়েন। অযাচিতভাবে যুদ্ধ যে শুরু হয়ে গেছে এটা তার কাছে কুয়াশামুক্ত অথবা দিবালোকের মোট সুরযাভা দেখার মতো স্পষ্ট হয়। লেফট্যানেন্ট হারুন, লেফটেন্যান্ট কবীর ও লেফটেন্যান্ট আখতারকে নিয়ে তিনি পরিস্থিতি বিশ্লেষন করতে বসেন। মেসেজগুলো পড়ে সবাই বিচলিত ও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি যে গুরুতর এ বিষয়ে সবাই একমত হয়। বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের মনোভাব মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন মেজর শাফায়াত। তিনি বুঝতে পারেন এরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল এবং বিদ্রোহী মনোভাবেও এরা বেশ অগ্রগামী। কেবলমাত্র কতৃপক্ষের আদেশের অপেক্ষা। তারা প্রস্তুত। মেজর শাফায়াত এবার আশ্বস্ত হন।
বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি দেখতে পান শত শত লোক ঢাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে চলে আসছে। নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোরের ঐসব লোকদের দেখতে জনস্রোতের মতোই মনে হয়। নায়েক সুবেদার জহিরের ইন্তারসেপ্টড মেসেজটিতে তরুণ অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কবীর ও লেফটেন্যান্ট আখতার খুব বিচলিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মেজর শাফায়াত ওয়্যারলেস সেটে মেজর খালেদের সাথে যোগাযোগ করে অল্প সময়ে পেয়ে যান। জহিরের প্রাপ্ত মেসেজটি ঢাকার স্থানীয় ভাষায় তাঁকে শুনিয়ে তাঁর মতামত চাওয়া হয়। মেজর শাফায়াত মেজর খালেদকে বলেন, আমরা বিদ্রোহের জন্য সবাই তৈরি। আপনি অনতিবিলম্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসুন। মেজর শাফায়াতের এ আলাপ চলাকালে লেফট্যানেন্ট কর্নেল খিজির হায়াত, মেজর সাদেক নেয়াজ ও লেফটেন্যান্ট আমজাদ সাঈদ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্ত আলাপটি ঢাকাইয়া ভাষায় হওয়াতে তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি।
ব্যাপারটি সেনা শৃংখলার দৃষ্টিতে দেখলে অত্যন্ত কঠিন ঘটনা। একটি কোম্পানি স্থানান্তর করতে অধিনায়কের নির্দেশ ছাড়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্ত এ ক্ষেত্রে একজন জুনিয়র মেজর (কোম্পানি কমান্ডার) ইউনিটের উপর অধিনায়ককে ১২০ মাইল দূরবর্তী অবস্থান শমসেরনগর থেকে সেনাদলসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসার অনুরোধ জানাচ্ছেন। কত দৃঢ় মনোভাবের অবস্থায় পৌছালে অধিনায়কের কমান্ড ভেঙে যায় এবং জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা ক্ষমতা অনুশীলিত হয় এটাই তার শ্রেষ্ট উদাহরণ।
ওয়্যারলেসের ওপার থেকে মেজর খালেদের পক্ষেও বেশি কথা বলা সম্ভব হয়নি। শাফায়াত যেহেতু সিদ্ধান্ত কামনা করেছেন তাই মেজর খালেদ শুধু বলেন যে, তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন। সেদিনের এই ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যটি মেজর খালেদের মুখ থেকে বের হয় ইতিবাচক অর্থ নিয়ে। মেজর শাফায়াত যেন বিদ্রোহের সবুঝ সংকেত পেয়ে যান এবং এতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এরপর থেকেই জুনিয়র অফিসাররা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তবু তার মনে হয় অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন অধীনস্ত সদস্যের নিকট থেকে মতামত নেয়া আবশ্যক। এটা এমন একটা সিদ্ধান্ত যা রাইফেলের বুলেটের সাথে তুলনীয়, একবার ব্যারেল ত্যাগ করলে আর ফিরে আসে না। এক্ষেত্রেও সামান্য ভুলের জন্য জীবন ও সবকিছু বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। তিনি একজন অফিসার ও একজন জেসিওকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভাববার জন্য সারারাত সময় দেন।
সন্ধ্যার সময় মেজর শাফায়াত সৈনিকদের তাঁবু এলাকায় যান। তখন কয়েকজন সৈনিক এনসিও তাঁকে জানায় দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে। তারা সম্পূর্ণ সচেতন এবং স্রেফ অফিসারদের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। তারা আরো জানায়, ঐ নির্দেশ প্রদানে দেরি হলে তারা নিজস্ব সিদ্ধান্তে স্ব স্ব অস্ত্র সমেত পালিয়ে যাবে। এমনকি পরবর্তী দুদিনও তারা অপেক্ষা করতে রাজি নয়।সৈনিকদের এই মনোবল ও সাহস দেখে মেজর শাফায়াত অত্যন্ত আশান্বিত ও গর্বিত হন। যদিও দু’ একজন অফিসার ও জেসিও দ্বিধান্বিত ছিলেন, তবু মেজর শাফায়াত সে মুহূর্তে যেন এক ধাপ এগিয়ে যান। সুবেদার মেজর ইদ্রিস অধিনায়ককে নিয়ে সৈনিকদের তাঁবুর আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এ তৎপরতার জন্য কয়েকজন বাঙালি এনসিও রাতের বেলা মেজর শাফায়াতের তাঁবু পালাক্রমে প্রহরা দেয়। সাধারণত প্রহরীর দায়িত্ব পালন করা সিপাইদের কাজ। কিন্ত এনসিওদের স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সতর্কতার চরম প্রকাশ লক্ষ করা যায়। অবাঙালি অফিসার মেজর সাদেক ও লেফটেন্যান্ট আমজাদ সেই রাত নির্ঘুম কাটান এবং মেজর শাফায়াতের তাঁবুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। শেষ রাতে মেজর শাফায়াতের সাথে টেলিফোনে আলাপ করে। সে জানায়, ১২টা ট্রাকসহ পাকিস্তানি আর্মি ৫ মিনিট আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা দিয়েছে।
স্বাভাবিক নিয়ম হল কোন বড় কাজে মূল পরিকল্পনা ও আদেশ অফিসাররা দিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র আদেশ বাস্তবায়নে এবং ছোটখাটো আদেশ নিষেধ হয় জেসিও/এনসিওদের নিকট থেকে। কিন্ত সেই সময়ে রাষ্ট্রোদ্রোহিতার মতো বিশাল অথচ ভয়ানক সিদ্ধান্তের জন্য সৈনিকরা আর কালবিলম্ব করতে রাজি ছিল না, সৈনিকদের কথাবার্তার সুস্পষ্ট একটা উত্তাল সুর পরিলক্ষিত হয়। এতে মেজর শাফায়াতের মনোবল যেমন বেড়ে যায় তেমনি এর মাধ্যমে সৈনিকদের দেশাত্মবোধের পরিচয়ও পাওয়া যায়। মেজর শাফায়াত দুপুরের পর মেজর খালেদের সাথে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ক্যাপ্টেন গাফফার অধিনায়ককে অনুরোধ করেন ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একত্র করার নির্দেশ দিতে। তিনি সেই মতে, সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার নির্দেশ দেন। একমাত্র শমসেরনগরে অবস্থিত মেজর খালেদ ও তার কোম্পানি ছাড়া অন্যান্যরা সকলে এখানে চলে আসে।
ক্যাপ্টেন গাফফার ব্যাটালিয়নসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছার পর এমসিও লুৎফুল হাই স্বেচ্ছায় ক্যাপ্টেন গাফফারের সাথে দেখা করে জানতে চান যে, তাঁদের কি করণীয়? জবাবে ক্যাপ্টেন গাফফার বলেন, যথা সময়ে আমরা আমাদের কর্তব্য সাধন করব। তিনি চলে যাবার পর ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি অফিসাররা তাকে জিজ্ঞেস করেন, লুৎফুল হাইয়ের এখানে আসার কারণ কি? ক্যাপ্টেন গাফফার বলেন, তিনি আমার আত্মীয় এবং আমার সাথে এমনিই দেখা করতে এসেছেন। মিথ্যা বলে তাঁদের সন্দেহ দূর করেন। ক্যাপ্টেন গাফফার মেজর শাফায়াতকে সমস্ত পরিকল্পনা কথা অর্থাৎ ব্যাটালিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার কথা এবং অন্যান্য কোম্পানিগুলো জড়ো করার কথা বলেন। মেজর শাফায়াত সমস্ত বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং এনসিওদের নিয়ে একটা সভা ডেকে বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ, সেহেতু সবাইকে সজাগ এবং প্রস্তুত থাকতে হবে।
২৫ মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার ওয়্যারলেসের মাধ্যমে মেজর খালেদকে সমস্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন। মেজর খালেদ বলেন, “আমরা শমসেরনগর থেকে আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে অগ্রসর হব এবং তোমরা যদি পার পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেফতার কর”। রাত ২টার দিকে ক্যাপ্টেন গাফফার অবাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেন। কিন্ত সে পরিকল্পনা অনিবার্য কারণে ভেস্তে যায়। মেজর সাদেক নেয়াজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএন্ডবি রেস্ট হাউসে ক্যাপ্টেন গাফফারের কক্ষে তার পার্শ্বে ম্যাগাজিন ভর্তি চাইনিজ স্টেনগান নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকায় সে যাত্রায় পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি।
২৬ মার্চ রাত বারটায় শমসেরনগর থেকে মেজর খালেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাস্তায় তাঁদের অগ্রযাত্রা খুব ধীর গতিতে হচ্ছিল। কারণ সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে এবং কোথাও কোথাও রাস্তা কেটে দেয়া হয়েছে। এইসব প্রতিবন্ধকতা দূরে কিংবা মাটি ফেলে চলার উপযোগী করে তাঁকে অগ্রসর হতে হয়।
স্থানীয় জনগণ আড়াল থেকে সৈনিকদের তৎপরতা অবলোকন করে। তারা যখন নিশ্চিত হয় যে, সৈন্যদল বাঙালি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তারা নিজেরাই ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করে। এভাবে ধীর গতিতে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় ভোর সাড়ে পাঁচটায় কনভয়টি হবিগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে সাতছড়িতে পৌঁছে যায়। মেজর খালেদ সৈনিকদের কিছু সময় বিশ্রাম দিয়ে অয়ারলেসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াতের সাথেও আলাপ হয়। তিনি আশ্বাস দেন যে এখানে সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। মেজর শাফায়াতও তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং কনভয় আসতে এত বিলম্ব হচ্ছে কেন জানতে চান। মেজর খালেদ জানান, তিনি খুব নিকটে পৌঁছে গেছেন। কনভয় নিয়ে আবার রওয়ানা দেন মেজর খালেদ। সকাল ৬ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দশ মাইল দূরে মাধবপুরে পৌঁছেন। এরপর মেজর শাফায়াতের সাথে পুনরায় আলাপ (ওয়্যারলেস সেটে) করেন। মেজর শাফায়াত মেজর খালেদকে জানান, সকাল ১০টার সময় কর্নেল খিজির হায়াত একটা কনফারেন্স ডেকেছেন। এদিকে মেজর খালেদের নিকট খবর পৌছেছিল যে, কুমিল্লা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি সেই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছে। একদিকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অগ্রযাত্রা অন্যদিকে কনফারেন্সের সংবাদে মেজর খালেদ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। কনফারেন্সের পরিকল্পনায় বিপজ্জনক কিছু থাকতে পারে। তিনি শাফায়াতকে তখনই নির্দেশ দেন তার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ অবিলম্বে যেন সমস্ত পাকিস্তানি অফিসার ও সৈনিককে গ্রেফতার ও নিরস্ত্র করা হয়। তিনি আবার রওয়ানা দেন। পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত হন।
২৭ মার্চ সকাল নয়টায় অধিনায়কের অফিসে মিটিং ডাকা হয়। সকল অফিসার এ মিটিংয়ে উপস্থিত থাকবেন। মেজর শাফায়াত এ মিটিংয়ের আগেই বিদ্রোহের চূড়ান্ত ঘটনা ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লেফটেন্যান্ট কবির লেফটেন্যান্ট হারুন এবং বেলায়েত, শহীদ মুনিরসহ কয়েকজন জোয়ানকে সাথে নিয়ে অফিসারস মেসে যান। সকলেই সশস্ত্র। অস্ত্রের ম্যাগাজিন এমোনিশন লোডেড। ইউনিটের অন্যান্য সৈনিকরাও সশস্ত্র প্রস্তুত। মেসে পৌঁছে অধিনায়কসহ মেজর সাদেক নেয়াজ এবং লেফটেন্যান্ট আমজাদ ও লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন। মেজর সাদেক নেয়াজের কক্ষে রক্ষিত ৮টি ম্যাগাজিনসহ তার স্টেনগানটা সরিয়ে ফেলার জন্য লেফটেন্যান্ট আখতারকে পাঠান মেজর শাফায়াত। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে লেফটেন্যান্ট আখতারকে পাঠান মেজর শাফায়াত। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে সবাইকে নিয়ে অধিনায়ক অফিসে চলে আসেন। অফিস ছিল তাঁবুতে। পাকিস্তানি অফিসার তিনজন তাঁবুতে। চেয়ারে বসা মাত্রই লেফটেন্যান্ট কবির ও লেফট্যান্ট হারুন তাঁবুর দুপাশে দাঁড়ান। আর মেজর শাফায়াত চিৎকার করে অবাঙালি অফিসার তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন ওঠেন, “you have declared war against the unarmed people of our country. You have perpetrated genocide on our people. Under the circumstances we owe our allegiance to the people of Bangladesh and the elected representatives. You all are under arrest. Your personal safety is my responsibility. Please do not try to influence others.”
বিদ্রোহের আনন্দে সৈনিকরা মহা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। একজন বৃদ্ধ একটি দোনালা বন্দুক দিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে শ্লোগান দিয়ে ওয়াগদার কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসে। আনন্দ শ্লোগানে সৈনিকরাও যোগ দেয়। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি পতাকা বাঁশদণ্ডে উড়িয়ে দেয়া হয়। লেফটেন্যান্ট আখতারকে দিয়ে বন্দি অফিসার তিনজনকে থানা হাজতে পাঠানো হয় এবং তাদের সাথে যেন জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সু আচরণ করা হয় সে রকম নির্দেশ জারি দেন মেজর শাফায়াত। শত শত সৈনিকের মুহুর্মুহু শ্লোগানে অবাঙালি সৈন্য ও বিহারীরা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। গ্রামের লোকজন এদের ধরে ফেলে এবং বিক্ষুব্ধ উত্তেজিত জনতার হাতে তারা মারা যায়। সেনাবাহিনীর চাকরীর ধরনটা এমন যে প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই সকলকে খুব কাছাকাছি কাজ করতে হয়। এজন্য সেনাসদস্যদের থাকার ব্যবস্থা, আবাসিল এলাকা, অফিস, প্রশিক্ষণ, মাঠ, ক্লাব, মেস ইত্যাদি সকল সামাজিক প্রতিষ্টানগুলো অত্যন্ত কাছাকাছি হয়ে থাকে। সার্বক্ষণিক একত্রে থাকার সুবাদে চিন্তা-ভাবনা অভ্যাস-কার্যকলাপ, আচার-আচরণ এবং মনমানসিকতায় পদমরযানুযায়ী সকলের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরি হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক এমন যে, অনেক সময় নিকটাত্মীয়ের চেয়ে সহকর্মীরাই বেশি আপনজন হয়ে ওঠে। কিন্ত এমন গভীর সম্পর্কীয় হরিহরআত্মার ব্যাক্তিদের যখন গ্রেফতার কিংবা হত্যা করার পরিবেশ সৃষ্টি হয় ব্যাপারটি কতটুকু অস্বাভাবিক হলে সম্ভব এটা শুধুমাত্র অনুমান করে পুরোপুরি মুল্যায়ন করা যাবে না। অপরদিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত একজন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক। তিনি হয়ত ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশে ষড়যন্ত্র করার প্রয়াস চালান। অথচ বাঙালি অফিসার ও জোয়ানরা উপরের নির্দেশে কিংবা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বদের পরামর্শ ছাড়াই চরম বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেয় ও তা কার্যকরী করে। লৌহকঠিন সামরিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে, গভীর সখ্য উপেক্ষা করে অধিনায়কসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও জোয়ানদের জীবন বিপন্ন করার মতো শক্ত কাজ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এভাবে আত্মোসৎসর্গের বাসনাদীপ্ত ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা তাঁদের দেশপ্রেম ও সাহসের জন্য কিংবদন্তি হয়ে রইল।
মেজর খালেদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছতে বেলা ৩টা বেজে যায় এবং মেজর শাফায়াতের সাথে মিলিত হয়ে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে মেজর খালেদ তাঁর পরিকল্পনা সবাইকে জানান। শমসেরনগর থেকে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে ইউনিটের বাঙালি অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসে মেজর খালেদ তাঁর কর্মপরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে, আমরা মেঘনা নদীকে উত্তরে রেখে পশ্চিমে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করব এবং দক্ষিণে কুমিল্লা (ময়নামতি) সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষার বন্দোবস্ত করব। উত্তর পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে সিলেটে আর একটি ঘাঁটি স্থাপন করব। এই পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে ভৈরববাজারে দুটো কোম্পানি পাঠিয়ে দেন। আর একটা দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হতে বলেন। মেঘনার পূর্ব পাড়ে একটা প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরির ব্যবস্থা করেন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চতুর্দিকে এবং তিতাস নদীর তীরে একটা অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। ২ লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি দিয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবার জন্য পাঠিয়ে দেন। তিনি শায়েস্তাগঞ্জের খোয়াই নদীর দু’পাশে অবস্থান নেন। শ্রীমঙ্গলে তাঁদের সাথে স্থানীয় সংগ্রামী আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ইপিআর এবং আরো কিছু সৈন্য (অবসরপ্রাপ্ত ছুটিতে থাকা এবং মূল ইউনিট হতে বিচ্ছিন্ন) যোগ দেয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবদুর রব (অব.) এদের নেতৃত্ব দেন। এ পুরো দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে লড়াই করে। লড়াইয়ে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনেক হতাহত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে পাকিস্তানিরা আর টিকে থাকতে না পেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। সিলেট শহর পর্যন্ত তদেরকে ধাওয়া করা হয়।
ক্যাপ্টেন গাফফারকে ১৮ জন সৈন্য নিয়ে গোকনঘাটে পাঠান হয়। ঢাকা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত সম্বলহারা বেশুমার জনতা পালিয়ে আসতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফার ২৫০ জন পলায়নপর পুলিশ ও ইপিআর নিয়ে একটি কোম্পানি সংগঠিত করেন। তৃতীয় দিনে অর্থাৎ ২৯ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর বিমান চারটি স্যাবর জেটের এফ ৮৬-এর সাহায্যে তার এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে সংগঠনের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন আহত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মেজর খালেদ যোগাযোগ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কাজী রকিবউদ্দিন। তিনি সবসময় সাথে থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। বলাবাহুল্য, রসদ সরবররাহ, যানবাহন সংগ্রহ, সৈনিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, আর্থিক সাহায্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই মহকুমা প্রশাসক অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। মহকুমা পুলিশ অফিসারও সক্রিয় সহযোগিতা করেন। এরপর আলী আজম, লুৎফুল হাই সাচ্চু, মাহবুবুর রহমান, হুমায়ূন কবীর, জাহাঙ্গীর ওসমান প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দেখা করতে আসেন এবং সবরকম সাহায্য সহযগিতার পূর্ণ আশ্বাস দেন। সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে উভয়পক্ষ একমত হয়। বস্তুগত সহযোগিতা ছাড়াও মহকুমা প্রশাসক রকিব ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের খবর প্রচার করার মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় প্রচার কাজটি বিদ্রোহের ব্যাপারে সর্বব্যাপী অত্যন্ত কার্যকর হয়। তিনি পুলিশের ও তিতাস গ্যাসের অফিসের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে এবং টেলিফোনে বাংলাদেশের সমস্ত জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের কাছে খবর প্রেরণ করে বলেন যে, মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতাযুদ্ধ করছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শক্রমুক্ত করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে সকল বিদ্রোহীদের এখানে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তাহের উদ্দিন ঠাকুর, লুৎফুল হাই সাচ্চু প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা হয়। তাদেরকে বাঙালি সৈনিকদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের কথা জানান। নেতৃবৃন্দ জানতে চান কিভাবে তারা সৈনিকদের সাহায্যে আসতে পারেন। মেজর খালেদ বলেন, এ মুহূর্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে যদি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা সম্ভব হয় তবে যুদ্ধকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। গোলাবারুদ ও অস্ত্রের প্রকট স্বল্পতা রয়েছে। বর্তমান মজুদ দিয়ে পাকিস্তানি সৈনিকদের সাথে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হবে না। নেতৃবৃন্দ এসব কথা শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগরতলায় যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর পাঞ্জাবী সদস্যদের সাথে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি অগ্রবর্তী দলের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিরা অনেক হতাহত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। ২৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে শক্রসেনা বিমান হামলা চালায়। এ হামলায় নিজস্ব বাহিনীর একজন সৈনিক মারা যায়।
২৫ মার্চে ৫৩ পদাতিক বিগ্রেডের অবস্থান ছিল কুমিল্লা (ময়নামতি) সেনানিবাসে। ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। তিনি একজন অবাঙালি অফিসার। এছাড়া ব্রিগেড সদর দপ্তরে আরো দুজন অবাঙালি অফিসার ছিলেন। তাদের একজন ব্রিগেড মেজর (BM) মেজর সুলতান এবং ডিএ এন্ড কিউএমজি (DAA &QMC-Deputy Assistant Adjutant and Quarter Master General) সংক্ষেপে ডি কিউ-এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর আগা বোখারী। একমাত্র বাঙালি অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মকবুল আহমেদ। তিনি ব্রিগেডের জিএসও-৩ (শিক্ষা)। অর্থাৎ General Staff Officer-3 (Education)-এর দায়িত্ব পালন করতেন। এ ব্রিগেডের অধীনে অন্যান্য ইউনিট-২৪ এফ এফ রেজিমেন্ট, অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার (অবাঙালি), লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুবের (অবাঙালি) অধিনায়কত্বে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সিলেটে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতেমীর (অবাঙালি) অধিনায়কত্বে ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের আগে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে থাকলেও সেদিনই ইউনিটটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয়। এ ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান (অবাঙালি)। এছাড়া কুমিল্লা সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুব মালিকের (অবাঙালি) অধিনায়কত্বে ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি এবং একটি ৮৮ মর্টার ব্যাটারি অবাঙালি অফিসারের কমান্ডে ছিল। বাঙালি অফিসার মেজর হাবিবুল্লাহ বাহার-এর কমান্ডে ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আয়ুবের (বাঙালি) কমান্ডে ব্রিগেড ওয়ার্কশপ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ.এন.এম জাহাঙ্গীরের (বাঙালি) অধিনায়কত্বে ৪০ ফিল্ড এম্বুলেন্স ছিল। এ ছাড়া কুমিল্লায় আরো কয়েকটি ছোট ছোট লজিস্টিক ইউনিট ছিল। স্যাটিক সিগন্যাল কোম্পানি, এলএলপি (Station Supply Depot) মিলিটারি পুলিশের একটি শাখা এবং সিএমএইচ (Combined Military Hospital)। লেফটেন্যান্ট জাহেদ হাসান খানের অধিনায়কত্বে ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থান করলেও এটা ১৪ পদাতিক ডিভিশন, ঢাকা এর নিয়ন্ত্রনে ছিল। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবাঙালি অফিসার লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান ছাড়াও ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান (কোয়ার্টার মাস্টার), মেজর সাদেক নেয়াজ (ডেল্টা কোম্পানি এবং লেফটেন্যান্ট আমজাদ সাঈদ। বাঙালি অফিসাররা ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ (উপ-অধিনায়ক), মেজর শাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন, ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার, লেফটেন্যান্ট মাহবুব, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ফজলুল কবীর, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হারুন। এ ছাড়াও দুজন বাঙালি মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। তারা হলেন লেফটেন্যান্ট আখতার এবং লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন।
২৭ মার্চ অফিসার ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীন কুমিল্লা সেনানিবাসে বাড়ি বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের খবর পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপস্থিত হন। তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসের অবশিষ্ট বাঙালি সেনাসদস্য ও সকলের পরিবার বর্গকে উদ্ধারের চেষ্টায় ২৮ মার্চের সন্ধ্যায় কুমিল্লা ফেরার প্রয়াস পান। কিন্ত সেনানিবাসের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি বিশাল এক কনভয়কে এগিয়ে আসতে দেখেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান। এবং এক কোম্পানি সৈন্যসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথিমধ্যে- এন্ডারসন খালে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ২৯ মার্চের দুপুর বেলায় পাকিস্তান কনভয় এন্ডারসন খালের ব্রিজের মুখে পৌছামাত্র ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীনের এম্বুশ পার্টি আক্রমণ চলায়। পাকিস্তানীদের একটি জীপ বিধ্বস্ত হয় অন্যটি পালিয়ে যায়। এতে একজন অফিসারসহ বেশ ক’জন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হয়।
২৯ মার্চ বিকেলে কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিয়ার হেডকোয়ার্টারের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী আর্টিলারি গান ও থ্রি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। যে সব বাঙালি সেনা রিয়ারের দায়িত্বে ছিল তারা সংগঠিত হয়ে প্রবল বাঁধা দেয়। দুপক্ষের মধ্যে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। রাত নেমে এলে পাকিস্তানি আক্রমণ কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসা। তখন কয়েক জন জেসিও এবং এনসিও-এর নেতৃত্বে অধিকাংশ সৈন্য তাঁদের পরিবারবর্গসহ সেনানিবাসের মরণ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮/১০ জন সেনা এ যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। পাকিস্তানিদেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার এম এ সালাম এসময় অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে যুদ্ধ করে বেরিয়ে আসা সৈনিকরা অবশ্য তখনই মুক্তাঞ্চলে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেনি, মে মাসের দিকে এদেরই একটা বড় অংশ বিবিরবাজার এলাকায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে যোগ দেয়। জাঙ্গারিয়া গ্রিড স্টেশনে আগে থেকেই অবস্থানরত ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুনও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়। প্লাটুনটির কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার এম এ জলিল। এই অবস্থায় কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ৩০ মার্চ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আহত অবস্থায় ৫৩ ফিল্ড আর্টিলারির অফিসার লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি পরবর্তীকালে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
[১৫৭,৬৫১,৬৭৭] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!