You dont have javascript enabled! Please enable it!

নিউমার্কেট মোড়ে তাৎক্ষণিক অপারেশন, চট্টগ্রাম

শহরে অবস্থিত নিউমার্কেটের উত্তরে জুবলি রোড, দক্ষিণে সদরঘাট, পূর্বে স্টেশন রোড ও পশ্চিমে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকা অবস্থিত। ১ নভেম্বর কাস্টমস কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার লক্ষ্যে কোতোয়ালী মোড়ের তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব ইস্ট পাকিস্তান থেকে টাকা তুলে কাস্টমস-এর একটি গাড়ি নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে স্টেশন রোড হয়ে যাবে বলে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান। সেই তথ্য মোতাবেক কেসি-১ দলনেতা মাহবুব, মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্র, শফিউল বশর, রফিক (শহীদ) ও ফজলুল হক দৈনন্দিন ব্যয় ও রশদ ভাণ্ডারের জন্য অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে এই অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে নূর মোহাম্মদ মিন্টু তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব ইস্ট পাকিস্তানের বিল্ডিং-এর পাশে লুঙ্গি পড়ে ছাতা হাতে (ছদ্মবেশে) অবস্থান নেন। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধাও কোতোয়ালী থানা মোড়ে ছাতা হাতে লুঙ্গি পরা অবস্থায় অবস্থান নেন। মূল দল একটি ফিয়াট গাড়ি নিয়ে বর্তমান জিপিও-এর বিপরীতে নিউমার্কেটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রথম দুজনের সংকেতের জন্য অপেক্ষায় থাকে। মূল দলের কাছে তখন দুটি এস এমসি, চারটি রিভলবার ও দুটি হ্যান্ডগ্রেনেড ছিল। প্রথম দুজনের উদ্দেশ্য ছিল, যে গাড়িতে করে টাকাগুলো নেওয়া হবে সেটা ইশারার মাধ্যমে দেখিয়ে দেওয়া অর্থাৎ টাকা বহনকারী গাড়ি ব্যাংক থেকে বের হলেই প্রথম ব্যাক্তি তার ছাতাটি খুলে ধরবে; যার অর্থ হবে গাড়িটি রওয়ানা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কোতোয়ালীর সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটিও একইভাবে (ছাতা খুলে) ইশারা দেবে। তথ্যানুযায়ী টাকা বহনকারী গাড়িটি আসার সম্ভাব্য সময় ছিল সকাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে। কিন্ত এক অজ্ঞাত কারণে গাড়িটি আসেনি। সকাল সোয়া এগারটায় মূল দল অপেক্ষার অস্থিরতায় ভুগে উক্ত এলাকা ত্যাগ করে নিউ মার্কেট চত্বর হয়ে সিটি কলেজের দিকে যেতে থাকে। পথিমধ্যে গ্রুপ লিডার মাহবুব গাড়ি থেকে নেমে যান। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাগণ গাড়ি নিয়ে সিটি কলেজের দিকে যাওয়ার রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেন। এ দিকে পূর্বপরিকল্পিত অপারেশনটি করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধা রফিক যে কোনো একটা অপারেশন করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। তারা সিটি কলেজের দিকে আসার সময় নিউমার্কেটের মোড়ে একটা বুকস্টলের সামনে পুলিশের একজন সার্জেন্টকে দেখতে পান। এই অবস্থায় তাঁরা সার্জেন্টকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তৎক্ষণাৎ রফিক গাড়ি থেকে নেমে নিউমার্কেটের দিকে গিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্টকে রিভলভার দিয়ে গুলি করে দ্রুত গাড়িতে উঠে আসেন। সার্জেন্ট সাথে-সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রকাশ্য দিবালোকের এই ঘটনার সময় নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থানরত পাকসৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সনাক্ত করে ফেলে। বিলম্ব না করে তারা তাদের গাড়ি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু ধাওয়া করে। উপায়ন্তর না দেখে মুক্তিযোদ্ধাগণ গাড়ি নিয়ে সদরঘাটের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পাকসৈন্যরা গাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছুঁড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণের ফলে তাদের পেছনের পাক আর্মির গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত সদরঘাটের দিক থেকে হঠাৎ আরেকটি পাক আর্মির টহলযান এসে পড়ে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অপারেশন দল গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে রাস্তার পাশে পজিশন নেয়। ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ মিনিট প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি নিঃশেষ হয়ে গেলে তারা পিছু হটেন এবং পার্শ্ববর্তী ড্রেন অতিক্রম করে কোনোরকমে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর দুটি গাড়িই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুলিবিদ্ধ পুলিশ সার্জেন্ট নিহত ও কমপক্ষে চারজন পাকসেনা মারাত্মকভাবে আহত হয়। আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রফিক শহীদ এবং শফিউল বশর গুরুত্বর আহত ও গ্রেফতার হন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক গুলিতে আহত হলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ির ড্রাইভারও আহত হন। যদিও ‘দলনেতার এবং পরিকল্পনার বাইরে পরিচালিত যুদ্ধের পরিনাম’ সম্পর্কে এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা একটা শিক্ষা লাভ করেছিলেন; তবুও এ কথাও স্মরণ রাখতে হয়- দিবালোকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দুঃসাহসিক হামলা সাধারণ জনগণের মনোবল আরো বাড়িয়ে দেয়।
[৫৯৭] কে.এম.আহসান কবীর

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!