You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.15 | নারায়ণগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নৌকমান্ডো অপারেশন ২ - সংগ্রামের নোটবুক

নারায়ণগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নৌকমান্ডো অপারেশন ২

১৫ আগস্টের অপারেশন শেষে বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলো থেকে কমান্ডোদের অধিকাংশই আবার পলাশীতে ফিরে আসে। এরপর সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম শেষ তাদের মধ্যে নতুন করে পুনরায় গ্রুপ বিভাজন শুরু হয়। এই নতুন বিভাজনের আওতায় তাদের অপারেশন-স্থলও বহুলাংশে পরিবর্তত হয়ে যায়। কেউ কেউ নতুন দলের সাথী হয়ে ফিরে যায় আগের নৌবন্দরেই, যেখানে এর আগে সে একবার অপারেশনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কাউকে কাউকে নতুন পরিকল্পনা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় অন্য কোনো এলাকায়, যেখানে এর আগে সে আর কোনদিনই যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলনায়কেরও পরিবর্তন ঘটে। তবে এই পরিবর্তন সব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে অবশিষ্ট ৭ জন সাবমেরিনারের মধ্যে। সাবমেরিনারদের একজন ইতোমধ্যেই ফুলছড়ি ঘাটে নিহত হয়েছেন। পলাশী ক্যাম্পের নতুন গ্রুপ বিভাজনে পরবর্তী ব্যাচের নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌকমান্ডোদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরা এর আগে কখনোই কোনো অপারেশনে অংশ নেয়নি। মধ্য আগস্ট-পরবর্তী অপারেশনের জন্যে নারায়নগঞ্জে এবং তার আশপাশ এলাকার নেতৃত্বের দায়িত্বভার আগের মতোই সোপর্দ থাকে সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের ওপর। প্রথম অপারেশনের সফলতার পর এবার তিনি আরো সাহসী হয়ে ওঠেন অভিযানের ব্যাপারে। কমান্ডো দল পরিচালনার কাজে তার দক্ষতা যেমন বেড়েছে তেমনি সম্প্রসারিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকা সম্পর্কে তার পরিচিতি। ফলে, ওই এলাকার জন্য তার নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি একরকম স্থায়ী হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জ বন্দরে প্রথম অপারেশন সফল করার পরদিন ১৬ আগস্ট তিনি সদলবলে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন পলাশীর দিকে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আগরতলার নিউক্যাম্পে এসে জড়ো হয় নৌকমান্ডোদের একটি দল। এবারো সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে এই কমান্ডো দল পর্যায়ক্রমে অভিযান চালাবে তারাবো, দাউদকান্দি প্রভৃতি ফেরিঘাটে। ঢাকা এবং মুন্সিগঞ্জ এলাকাও অভিযানের আওতাভুক্ত। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পরপর ২২ জনের এই কমান্ডো দল আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে আগরতলার নিউক্যাম্প ত্যাগ করে নারায়ঙ্গঞ্জের দিকে যাত্রা শুরু করে। দলের সাথে এবার আগের তুলনায় সাজসরঞ্জাম অনেক কম। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে স্টেনগান, এসএমজি এবং লিমপেট মাইনই প্রধান। দলনায়কের সাথে এবার ট্রানজিস্টার দেয়া হয়নি। তার প্রয়োজনও নেই। এ যাত্রায় কোথায় কীভাবে এবং কখন অপারেশন করা হবে তা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবেন দলনায়ক। এ ব্যাপারে পলাশীর বিশেষ কোনো নির্দেশ নেই। তবে সতর্কতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে চলার প্রশ্নে তাদেরকে সবসময় কঠোর নির্দেশনায় বারবার হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। ২২ জুন নৌকমান্ডোর এই দলটি যাত্রাপথে ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর ত্রিপুরার মেঘালয় হয়ে একদিন পর সীমান্তবর্তী হাতিমারা ক্যাম্পে এসে পৌঁছে। এই ক্যাম্প থেকে কুমিল্লার কসবা সীমান্ত এলাকা দিয়ে তারা প্রবেশ করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। কসবা থেকে নবীনগর পর্যন্ত এসে পৌঁছে পায়ে হেঁটে। এরপর কিছুদূর নৌপথ। নবীনগর থেকে একটি ছোট লঞ্চ দখল করে নেয় কমান্ডোরা। লঞ্চটি সেখানে একটি নদীর ঘাটে বাঁধা ছিল। কমান্ডোরা এক রকম জোর করেই ছিনিয়ে নেয় লঞ্চটি। এরপর নিজেরাই তা চালিয়ে নিয়ে আসে নারায়ণগঞ্জের দিকে। লঞ্চের ইঞ্জিনে বসেন দলনায়ক আবিদ এবং গতিপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য হাল ধরে মননু নামক একজন কমান্ডো। এর আগে এই কমান্ডো চট্টগ্রামের বহিরনোগর অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। অদক্ষ হাতে আঁকাবাঁকা পথে লঞ্চ চালিয়ে তারা এসে পৌঁছে আড়াইহাজার থানার ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে। সোনারগাঁয়ে মুসারচর গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয় কমান্ডোরা। নৌকমান্ডোরা মুসারচরের আশ্রয় থেকেই ডেমরা, কাঁচপুর, জাঙ্গালিয়া ও সিদ্ধিরগঞ্জের বিশ্বগুদামে অপারেশন পরিচালনা করে। মাইন লাগিয়ে বিশ্বগুদামে (সাইলো) উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে তারা। দূর থেকে এটা সম্ভব বলেও মনে হয়েছিল। কিন্ত বাস্তবে এ কাজটি ছিল একেবারেই অসম্ভব। আট-দশটি মাইন লাগিয়েও সাইলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরেও সেখানে অভিযান চালানো হয়। দুটি মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। কিন্ত তাতে গভীর মাটিতে অর্ধাংশে প্রোথিত সাইলো সামান্যই কেঁপে উঠেছিল মাত্র। তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বললেই চলে। দলনায়ক আবিদের নেতৃত্বে মননু, সিরাজ ও খোকন নামক তিনজন কমান্ডো সাইলোর শক্ত দেয়ালে মাইনের ব্যর্থ পরীক্ষা চালিয়ে অবশেষে ক্ষুন্নমনে ফিরে আসে। সাইলো গুড়িয়ে দেবার কিংবা উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা এরপর পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে হয় তাদের। কমান্ডোরা এবার মনযোগ দেয় তারাবো ফেরিঘাটের দিকে। রাজধানীর সাথে সড়কপথে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি প্রভৃতি এলাকার যোগাযোগের ব্যাপারে এই ঘাটের ফেরি সার্ভিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানীদের সামরিক যান এবং অন্যান্য রসদবাহী পরিবহন চলাচলের কারণে অহর্নিশ ব্যস্ত থাকে এই ফেরিঘাট। মাইন লাগিয়ে ঘাটের ফেরি ডুবিয়ে দেয়া সম্ভব হলে ঢাকার সাথে একটি বিশাল এলাকার যোগাযোগ সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ করে দেয়া যায়। বিশেষ করে কুমিল্লা সেনানিবাসের সাথে ঢাকার সামরিক সদর দফতরের সার্বক্ষণিক সংযোগ এতে মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে। দলনায়ক আবিদ জসিম নামে একজন কমান্ডোকে সাথে নিয়ে ১২ নভেম্বর দিনের বেলা তারাবো ফেরিঘাটের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। নদীতীরের কোনো স্থান অধিকতর নিরাপদ হবে, তা নির্ধারণ করা হয় পর্যবেক্ষণের সময়। ঘাটের পরিবহন পারাপার করছে দুটি ফেরি। এই ফেরি নদীর দুপাড়ের দুটি ঘাটের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। ঠিক হলো, দুটি ফেরিতেই মাইন লাগানো হবে। অচল করে দেয়া হবে ফেরিঘাট। ওইদিন সন্ধ্যার পরই অলিপুর বাজারের কাছে মুসারচরের আশ্রয় ক্যাম্পে পরামর্শ-বৈঠকে বসে কমান্ডোরা। বৈঠকে যগ দেয় স্থানীয় কয়েকজন স্থল-মুক্তিযোদ্ধাও। দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনার পর ফেরিঘাটে সম্মিলিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। অপারেশনের সময় নদীর পাড়ে স্থল মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেবে এবং কমান্ডোরা নদী সাঁতরে এগিয়ে যাবে ফেরিঘাটের দিকে। অপারেশনে সর্বাধিক তিন থেকে ৪ জন নৌকমান্ডো অংশ নেবে। প্রতিটি ফেরিতে দুটি করে মাইন বসাতে পারলেই যথেষ্ট। দেদিক থেকে দুটি ফেরির জন্য দুজন কমান্ডো হলেই চলে। কিন্তু অপারেশনের সাফল্য পুরাপুরি নিশ্চিত করার জন্য দলে কমান্ডোদের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। বৈঠকে আলোচনার এক পর্যায়ে স্থল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোদের অপারেশনের গোপনীয়তার বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে বুঝিয়ে দেয়া হলো। স্থল মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের গোপনীয়তার ব্যাপারে স্বভাবতই ততটা সতর্ক নয়, যতটা সতর্ক নৌকমান্ডোরা। যে কারণে এ ব্যাপারে তারা আবেগের বশে ভুল করে বস্তে পারে। আর এই ভুলের পরিণতি হবে মারাত্মক। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোদের কাছ থেকে এই গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে আশ্বাস পাবার পর বৈঠক শেষ হয়। এরপর প্রস্তুতি নেবার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়। অপারেশনের যাত্রা শুরুর তখনো ঘন্টা তিনেক বাকি। এই সময়ের মধ্যে সকলকেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
রাত ১০টা। নৌকমান্ডো এবং স্থল-মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং অস্ত্রশস্ত্র সাথে নিয়ে মুসারচরের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায় শীতলক্ষ্যার দিকে। কিন্ত ক্যাম্প ছেড়ে কিছুদূর এগোনোর পরই তারা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রাতের অন্ধকারের মধ্যে অসংখ্য মানুষ দেখা যাচ্ছে চারদিকে। ক্ষেতের আলপথ ধরে দলে দলে তারা ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে। প্রায় প্রতিটি দলের সাথেই মহিলা এবং শিশু রয়েছে। অনেকের মাথায় এবং হাতে ছোটবড় বিভিন্ন আকারের পোঁটলাও দেখা যায়। বুঝাই যাচ্ছে এই উদ্বাস্তুরা যার যার পরিবার নিয়ে পালাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পথিমধ্যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ দেখল এই পলায়নের দৃশ্য। তারপর পলায়নপর কয়েকজনকে ডেকে থামানো হয়। জানতে চাওয়া হলো তারা পালাচ্ছে কেন এবং কোথায়ইবা যাচ্ছে। কিন্ত এদের কেউই এ প্রশ্নের জবাব দিল না। জবাব দেবার মতো সময়ই যেন নেই। যেন পেছনে পাকিস্তানীরা তেড়ে আসছে তাদের হত্যা করার জন্য সেরকম আতঙ্ক সকলের মধ্যে। তবে দু-একজন দাঁড়িয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকে। তাদের কাছে পলায়নের কারণ শুনে চমকে উঠে সবাই। গ্রামবাসীরা শুনছে আজ রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালাবে পাকিস্তানীদের ওপর। যুদ্ধ হবে ভয়ঙ্কর। গ্রামবাসীরা যুদ্ধের মধ্যে ক্রস ফায়ারে পড়ে মরতে চায় না। এই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যই তারা পালাচ্ছে। এবার ভীষণভাবে দমে গেল মুক্তিযোদ্ধারা। গ্রামবাসীরা এ খবর কোথায় পেল। তাহলে কি ফেরিঘাটে কমান্ডোদের অপারেশন চলাবার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে ? কিন্ত তাতো হবার কথা নয়। অন্ধকার রাস্তায় থমকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। গ্রামবাসীদের মধ্যে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে তার খবর পাকিস্তানীদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হতে পারে। সম্ভাব্য সেই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য তারা গোপনে মরণফাঁদ তৈরি করবে, এটা খুব সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় ফেরিঘাটে অপারেশন চলানো ঠিক হবে কি না সংশয় দেখা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত অপারেশন থেকে পিছিয়ে আসার যুক্তিতে কেউই মুখ খুলল না। ফেরিঘাট এলাকার সত্যিকার অবস্থা না জেনে কিছুতেই পিছু হটা যাবে না। ঘাটের কাছাকাছি নদীর পাড় পর্যন্ত পৌছতে হবে। সেখান থেকে ফেরিঘাট স্পষ্টই দেখা যায়। অবশেষে পলায়নপর গ্রামবাসীদের মধ্যদিয়েই তারা হেঁটে এগোতে থাকে। রাত ১১টার দিকে ফেরিঘাটের অদূরে শীতলক্ষ্যা-পারের একটি নির্জন স্থানে এসে দাঁড়ায় তারা। জায়গাটা আবছা অন্ধকারময়। ফেরিঘাট সোজা নদীর দুইপার উজ্জ্বল সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল করছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের গাড়ি নিয়ে দুটি ফেরি মাঝনদী বরাবর একটি অপরটিকে পাশ কেটে যাচ্ছে। দুটি ফেরিতেই সশস্ত্র সৈন্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রচুর লোকজন চলাচল করছে ঘাটে। দোকানগুলোর বেশিরভাগই খোলা। পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। নদীর কোনো পারেই নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কমান্ডোরা কিছুক্ষণ এই দৃশ্যাবলি পর্যবেক্ষণ করার পর অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্তেই অটল থাকে। কিন্ত ফেরিঘাটের যা অবস্থা তাতে এখনই অপারেশন শুরু করা যাবে না। গোটা পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। রাত গভীর হবার সাথে সাথে ঘাটে লোকজনের চলাচল কমে যাবে। ওই সময় পাকিস্তানীদের আনাগোনাও কমবে। তখন স্থির অবস্থায় পাওয়া যাবে ফেরি। চলতি ফেরিতে মাইন লাগানোর ঝুঁকি নেয়া কোনোমতেই ঠিক হবে না। এইরকম ঝুঁকি নিতে গিয়েই ফুলছড়ি ঘাটে জীবন দিতে হয়েছে সাবমেরিনার রকিবকে। কমান্ডোরা কেউই তা ভুলে যায়নি। সুতরাং জেনেশুনে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করা যাবে না। শীত মওসুমের পুরো দাপট শুরু না হলেও বেশ ঠন্ডা পড়েছে। বছরের এই সময়টিতে বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভালো শীত পড়ে। এই শীতে এতটা পথ সাঁতরে কস্টিউম, পেটে গামছায় বাঁধা মাইন, কোমরে ছুরি, পায়ে ফিনস এবং প্রায় বস্ত্রহীন কমান্ডোরা সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অদূরে ফেরিঘাটের দিকে। রাত ১টার দিকে ঘাটে মানুষের কোলাহল কমে আসে। ফেরির ইঞ্জিনও থেমে গেছে। দুটি ফেরিই তখন স্থির হয়ে আছে নদীর দুইপারে। আর দেরি করা চলে না। ফেরিঘাটে স্থির থাকতে থাকতেই তাতে মাইন লাগাতে হবে। ঘাটের দিকে মুখ করে তিনজন কমান্ডো হামাগুড়ু দিয়ে নেমে পড়ে নদীতে। ওপারের ফেরিটি টার্গেট করেছে রহিম এবং গনি। এপারের ফেরিতে মাইন লাগাবে জসিম। নদীর অনেকখানি পথ তিনজন একসাথে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। এরপর তারা ভাগ হয়ে যায় দুদিকে। পেছনে স্থল-মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় নদীর পাড়ে। তারাও প্রস্তুত। নদীর কোনো ঘাটেই গাড়ি নেই। ফলে ফেরিও নড়ছে না। ফেরির ওপর ক্লান্তিতে ঝিমুচ্ছে কয়েকজন সৈন্য। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে কেউ কেউ নদীর দিকেও তাকায়। নদীতে কোনো ঢেউ নেই। পানির ওপর চিকচিক করে কেবল সার্চলাইটের অসংখ্যা আলোর কণা। এই আলোর তীব্রতা ফাঁকি দিয়ে তিনজন কমান্ডোই নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায় ফেরির কাছে। এরপর ডুব দিয়ে মাইন বসিয়ে দেয় যথাস্থানে। একটুও শব্দ না করে মাইনগুলো শামুকের মতো সেটে থাকে ফেরির ইস্পাত-শরীরে। এরপর ফিরতি সাঁতার। চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে একডুবে অনেকখানি সরে আসে তারা ফেরির কাছ থেকে। পানিতে মাথা ভাসিয়ে দিয়ে দুপায়ের ফিনস দুলিয়ে সাঁতরে আলোর সীমানা পার হয়ে আসে। সবকিছু ঘটে যায় নির্বিবাদেই। এরপর নির্দিষ্ট পার দিয়ে ডাঙ্গায় উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় কমান্ডোরা মুসারচরের দিকে। ঠিক এই সময় বিস্ফোরণের কয়েকটি শব্দ হয় পেছনে। মুহূর্তে উবে যায় পাকিস্তানী সেন্ট্রিদের ক্লান্তি। একই সাথে নদীর দুই পারের ঘাট গর্জে ওঠে মেশিনগান। এই শব্দ ক্রমেই এগিয়ে যায় আশপাশের গ্রামগুলোর দিকে। রাত শেষ হবার আগেই আগুন জ্বলে ওঠে অসংখ্য বাড়িঘরে। মেশিনগানের অবিরাম শব্দের মধ্যে অসহায় মানুষের আর্তচিৎকারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নদীতীরের গ্রামগুলোতে। নির্বিকার গুলির মুখে ঝাঁঝরা হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ। এরা সেই মানুষ যারা এই এলাকায় একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হতে পারে এমন গুজব শোনার পরেও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। এই রকম অনেক যুদ্ধের গুজবই তারা আগে বহুবার শুনেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো যুদ্ধ হয়নি। গ্রামবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ এবারো সেই রকম যুদ্ধ না হবার আশা নিয়ে পালিয়ে যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছিল। গভীর রাতে ফেরিঘাটে মাইন বিস্ফোরণের পর এই হতভাগ্যরাই পাকিস্তানীদের বর্বর আক্রোশের শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। আর যারা সময়মতো পালাতে পেরেছিল তাদের অনেকের বাড়িঘর আগুনে ভস্মীভূত হলে সেযাত্রা তারা অন্তত প্রাণে বেঁচে যেতে পেরেছিল।
নভেম্বরের শেষের দিকে বেশ শীত পড়েছে বাংলাদেশের গ্রাম্য জনপদগুলোতে। হিমশীতল হয়ে আছে নদ-নদীর পানি। শহরাঞ্চলের মানুষেরা শীতের তীব্রতা খুব বেশি অনুভব না করলেও গ্রামের মানুষ বিশেষ করে রাতে গাঁয়ে চাদর-কাঁথা জড়ানো শুরু করে দিয়েছে। মুসারচরের গ্রামেও খুব শীত পড়ে একাত্তরের নভেম্বরে। নৌকমান্ডোদের আশ্রয়-ক্যাম্পে কাঁথা কম্বলের ভারি অভাব। গ্রামবাসীরা চাল-ডাল দিয়ে তাদের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেও সঙ্গত কারণেই কমান্ডোদের জন্য প্রয়োজনীয় এতগুলা শীতবস্ত্র জোগার করতে তারা ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় আশ্রয়-ক্যাম্পে অবস্থান অসম্ভব কষ্টকর হয়ে ওঠে। এই অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যেই একদিন ক্যাম্পে শিকার খুঁজে পাওয়ার একটি খবর এসে পৌঁছে। জানা গেল এমভি তুরাগ নামে একটি রসদবোঝাই জাহাজ মুন্সিগঞ্জের কাছাকাছি ধলেশ্বরী নদীর শেষ সীমানায় তিন নদীর মোহনা বরাবর নোঙ্গর করেছে। জাহাজে মালামালের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে গম। অল্পকিছু অস্ত্রশস্ত্রও আছে সেখানে। চমৎকার শিকার। কোনো অবস্থাতেই এমন শিকার হাতছাড়া হতে দেয়া যায় না। সোনারগাঁয়ের মুসারচর থেকে জায়গাটি অনেক দূর। জাহাজের সংখ্যাও মাত্র একটি । কিন্ত তা সত্ত্বেও কমান্ডোরা জাহাজটি ধ্বংশ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বাংলাদেশের কোনো বন্দর কিংবা জলচত্বরে পাকিস্তানীদের একটি জাহাজও অক্ষত রাখতে রাজী নয়। নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুর এলাকায় মধ্য আগস্ট থেকে নৌকমান্ডোরা যে হারে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে শক্র জাহাজ ধ্বংস করতে থাকে তাতে ওই এলাকায় কোনো বন্দরেই পাকিস্তানীরা আর জাহাজ ভেড়াতে নিরাপদ বোধ করেনি। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিশাল এই এলাকার নৌ বন্দরগুলোর প্রায় জাহাজশুন্য হয়ে পড়ে। ওই সময় খুব সাহস করে রসদবাহী জাহাজ বন্দর বন্দর এলাকায় ঢুকলেও সেটি আর ফিরে যেতে পারেনি। কমান্ডোদের এই মরণাঘাত থেকে বাঁচাবার জন্যই সম্ভবত এমভি তুরাগ বন্দর এলাকার বাইরে তিন নদীর মোহনায় একটি জেগে ওঠা চরাভূমির কাছাকাছি নোঙ্গর করে রাখা হয়। পাকিস্তানীরা হয়তো ধারণা করেছিল নৌবন্দরগুলোর আশেপাশে জড়ো হাওয়া কমান্ডোদের চোখ অতদূরে গিয়ে পৌছবে না। আর পৌঁছলেও অবস্থানগত কারণে এই জাহাজে তারা খুব শহজে হামলা চালাতে পারবে না। মুন্সিগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের জরুরি খাবার-চাহিদা মেটানোর জন্যই জাহাজটি সেখানে আনা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জাহাজের মালামাল খালাস না করে তা আটকে রাখা হয় ধলেশ্বরীর মাঝনদীতে। এরপর সেটিকে নিরাপত্তার কারণেই সম্ভবত সরিয়ে নেয়া হয় আরেকটু দূরে মেঘনা-শীতলক্ষ্যা-ধোলেশ্বরীর মোহনায়। এই জাহাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব বেশি জোরদার করা হয়নি। অবস্থানগত সুবিধার কারণেই হয়তো এ শৈথিল্য। ত্রি-মোহনায় একাকী জাহাজটি এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, মুন্সিগঞ্জের দিক থেকে নদী পার হয়ে সেখানে কোনো কমান্ডো অভিযান চালানো একেবারেই সম্ভব নয়। নদীর পারের সর্বত্রই পাকিস্তানী সৈন্যদের নিশ্ছিদ্র প্রহরা। এর বিপরীতে উল্টাদিকের গ্রাম থেকে অভিযান চলানো হয়তো সম্ভব হবে। কিন্ত তা হবে সরবোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং যাত্রাপথটিও হবে প্রচণ্ড রকম বিপদসঙ্কুল। সেক্ষেত্রে সাহস করে অভিযান চালাতে হলে কমান্ডোদের প্রথমে একটি নদী পার হয়ে কর্দমাক্ত বালুচরায় উঠতে হবে। এরপর পায়ে হেঁটে চরাভূমি অতিক্রম করে নামতে হবে আরো একটি নদীতে এবং সেই নদী সাঁতরে যেতেত পারলে তবেই পৌছা যাবে জাহাজের কাছে। শেষ নভেম্বরের প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে এমন অভিযানের পরিকল্পনা চিন্তা করাও কঠিন। অভিযান চালানর জন্য এরপর যে পথটি বাকি থাকে তা হচ্ছে নৌপথ। নৌকা নিয়ে ঘুরপথে জাহাজের কাছে যাওয়া। নৌকমান্ডোদের জন্য তৃতীয় এই পথটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা সে ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ নির্দেশনা এমনকি অস্ত্রশস্ত্র বা জনবলও তাদের নেই। কিন্ত তাই বলে জাহাজটিকে উন্মোক্ত নদীতে এভাবে অক্ষত ভেসে থাকতেও দেয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত তুরাগ ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকমান্ডোরা বিপদসঙ্কুল দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেয়। মুসারচরের ক্যাম্প থেকে ১৫ জন কমান্ডোর একটি দল প্রস্তুত হলো মুন্সিগঞ্জের জন্য। একটিমাত্র জাহাজে অপারেশনের জন্য এত কমান্ডোর প্রয়োজন নেই। কিন্ত যাত্রাপথ এবং অবস্থানগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ দল ভারি করা হলো। নিরাপদ পথ ধরে প্রায় সারাদিন হেঁটে এই দলটি বিকালের দিকে এসে পৌঁছে মুন্সিগঞ্জ সোজা অপর পারের কলাগাছিয়া নামক একটি গ্রামে। গ্রামের ধনী পরিবার বেপারি বাড়িতে তারা আশ্রয় নেয়। এই বাড়ির চার ছেলেমেয়ে সুবির, কবির, নাসির ও আলো কমান্ডোদের সেবায় সার্বক্ষণিক নিবেদিত প্রাণ। নানারকম হুকুম ফরমাশ খাটতে ন্যূনতম ক্লান্তি নেই তাদের। দলনায়ক আবিদ ওইদিন সন্ধ্যার পর এমদাদ এবং মননুকে সাথে নিয়ে নদীর নিরাপদ পাড়ে দাঁড়িয়ে এমভি তুরাগের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আসেন। দূর থেকে জাহাজের ক্ষীন আলোতে ডেকের ওপর সান্ত্রীদের চলাচল লক্ষ্য করা গেছে। জাহাজে আরো সৈন্য আছে বলেও অনুমান করা হয়। কিন্ত এর আশপাশ আর কোনো প্রহরা নেই। নারায়ণগঞ্জ বন্দর কিংবা তারাবো ফেরিঘাটের তুলনায় নিরাপত্থা ব্যবস্থা এখানে তেমন জোরালো নয়। এই পরিস্থিতিতে জাহাজ অপারেশনে অযথা বেশসংখ্যক কমান্ডো পাঠাবার প্রয়োজন নেই। তিন থেকে চারজন কমান্ডোর একটি দলই যথেষ্ট। কলাগাছিয়ার আশ্রয় শিবিরে আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে মাত্র তিনজন কমান্ডো বাছাই করা হলো। এই তিনজন হচ্ছে মননু, এমদাদুল এবং মতি। মতি মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় কমান্ডো, মননু এবং এমদাদের বাড়ি যথাক্রমে ফরিদপুর এবং যশোর। পরদিন রাত ১০টার দিকে ৩ জন কমান্ডো প্রস্তুত হয় অপারেশনের জন্য। গাঁয়ে চাদর জড়িয়ে রাখার মতো শীত। অন্যদিনের তুলনায় যেন ঠাণ্ডা একটু বেশিই পড়েছে। এমন অবস্থায় উদোম শরীরে অল্পক্ষণের মধ্যেই কাপন ধরে যায় কমান্ডোদের। প্রচণ্ড এই শীতের মধ্যে ঠাণ্ডা পানির দুটি নদী সাঁতরাতে হবে তাদের। এর মাঝখানে একটি আছে বালু ও কাদার নদী। দুই নদীর মধ্যবর্তী নতুন জেগে ওঠা চরাভূমি এটি। নদী সাঁতরে যাবার চেয়েও এই কর্দমাক্ত চরাভূমি অতিক্রম করা অনেক বেশি দুরূহ কাজ। তারপরেও কমান্ডোরা প্রস্তুত। পথ যত বন্ধুরই হোক, তা অতিক্রম করতে হবে। মাইন লাগাতেই হবে জাহাজে। বেপারি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে শরীরে ভালো করে তেল মেখে নেয় সবাই। এতে কিছুটা যদি গরম থাকা যায়। নদীর পাড়ে স্থল মুক্তিক্সোদ্ধাদের একটি দল প্রস্তুত রেখে ৩ জন কমান্ডো হাতে হাত ধরে নেমে পড়ে নদীতে। নদীর উপর কুয়াশার হালকা আস্তরণ ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। কুয়াশার এই সফেদ চাদর ভেদ করে জাহাজের অবস্থান পর্যন্ত আর দৃষ্টি যায় না। কেবল অনুমাএর ওপর নির্ভর করে দিক নির্দেশনা ঠিক রাখতে হচ্ছে। এভাবে প্রথম নদীটি পার হতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায়। সামনে কাদাবালুর চরাভূমি। কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডেবে যাচ্ছে কমান্ডোরা। আবার কোথাও শক্ত বালু। প্রচণ্ড শীতে শরীরে কাঁপন ধরেছে এরই মধ্যে। চামড়ায় চিমটি কেটেও বোধ পাওয়া যায় না। হাঁটুর নিচের দিকের পুরাটাই অবশ প্রায়। দুঃসহ এই কষ্টকর চরাভূমির ঠাণ্ডা কাদা ভেঙ্গে এরপর তারা এসে পৌঁছে আরো একটি নদীর তীরে। এই নদীতেও সাতার৪ কাটতে হবে তাদের। তারপর টার্গেট। সাদা কুয়াশার মধ্যে অদূরে নোঙ্গর করা জাহাজের আলো এবার কিছুটা চোখে পড়ছে। কমান্ডোরা আবার হাতে হাত বেঁধে নেমে পড়ে পানিতে। জাহাজের কাছাকাছি এসে তারা ডুব দেয়। মাথা তোলে জাহাজের শরীর ঘেঁষে। এরপর মাঝখানে একজন কমান্ডো রেখে অপর দুজন সরে যায় দুদিকে। নিঃশব্দে মাইন লাগিয়ে দেয় শ্যাওলামুক্ত করা ইস্পাতের সাথে। কাজ শেষ। জাহাজের পেছনদিকে এসে কমান্ডোরা একত্রিত হয়। এখন পালাতে হবে। ওপরে ডেকে সান্ত্রীদের বুটের পদচারণা শোনা যায়। কারো কারো কথাবার্তাও কানে আসে। তবে বিপদের কোনো আলামত কোথাও নেই। কেউ কিছু টের পায়নি। জাহাজের শরীর ছেড়ে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে একসাথে ডুব দেয় কমান্ডোরা। ভেসে ওঠে অনেকটা দূরে গিয়ে। তারপর চিৎ সাঁতার। নদীর তীরে এসে তারা আবার প্রবেশ করে কাদার রাজ্যে। ইচ্ছা করলেও এই রাজ্য খুব দ্রুত পার হওয়া সম্ভব নয়। চরাভূমির মাঝামাঝি আসার পর প্রথম একটি মাইনের বিস্ফোরণ শোনা যায় পেছনে। সাথে সাথে জ্বলে ওঠে জাহাজের সার্চলাইট। একই সাথে গর্জে ওঠে সান্ত্রীদের মেশিনগান। কমান্ডোরা এখনো এই মেশিনগানের গুলির আওতার মধ্যেই রয়েছে কিন্ত কোনোভাবেই দৌড়ে এগিয়ে যাবার মতো অবস্থা নেই। নিরুপায় কমান্ডোরা শুয়ে পড়ে কাদার মধ্যে। পেছনে পরপর চারটি মাইন বিস্ফোরণ শোনা গেল। কমান্ডোরা পেছনে কান খাড়া রেখে অনেকটা হামাগুড়ি দেয়ার মতো করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। এভাবে কাদার নদী পাড়ি দিতে সময় লেগে গেল অনেক। এরপর শেষ নদীটি পার হয়ে তারা নিরাপদেই তীরে এসে পৌঁছে। কিন্ত সেখানে তখন আরেক বিপদ। হঠাৎ রাইফেলের গুলি কল করার শব্দ। অদূরে কে একজন বলে ওঠে, ‘হ্যান্ডস আপ’। অজানা বিপদের আশঙ্কায় চমকে ওঠে কমান্ডোরা। অন্ধকারে নদীর তীরে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায় সবাই। সমস্ত শরীর কাঁপছে থর থর করে। যতটা না ভয়ে, তার চেয়েও বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে তারা শীতে। তাদের দাঁত পেটানোর শব্দ এমনকি অন্ধকারের অস্ত্রধারীরাও শুনতে পাচ্ছে। দু-হাত ওপরে তোমা একজন কমান্ডো তোতলানো আওয়াজে কয়েকবারই একটি বিশেষ সাংকেতিক শব্দ আওড়াল। কিন্ত তার এই শব্দের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝা গেল না। নদীতে নামার আগে এই সাংকেতিক শব্দটি নৌকমান্ডো এবং স্থল মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মুখস্থ করে নিয়েছিল। কথা ছিল, অন্ধকারে যখন মুখ চেনা যাবে না তখন এই শব্দই হবে তাদের পরিচয়ের সংকেত-পাসওয়ার্ড। কিন্ত এখানে সংকেত বারবার আওড়ানো সত্ত্বেও এর অনুকূলে অপরপক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেল না। বরং অস্ত্রধারীদের কঠোর নির্দেশ তাদের কানে এলো। কমান্ডোরা এবার সত্যি ভয় পেয়ে যায়। নদীর এই পারে কোনো পাকিস্তানীর থাকার কথা নয়। এলাকাটি মোটামুটি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বলা যায়, এটা তাদের জানা আছে। যদি তাই হয়, তাহলে এই অস্ত্রধারীরা কারা ? রাজাকার নয়তো ? কিন্ত তাই বা কেমন করে হয়। রাতে যেখানে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রবেশ করতে সাহস পায় না , সেখানে হীনবল রাজাকার আসবে কেমন করে। নৌকমান্ডোরা এবার চারদিকে যতদূর দেখা যায় ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। না, এটা সেই জায়গা নয়, যে জায়গা দিয়ে তারা নদীতে নেমেছিলো। অপারেশন থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সেখানে স্থল-মুক্তিযোদ্ধাদের অপেক্ষা করে থাকার কথা ছিল। সাংকেতিক বাক্যও তাদের জানা আছে। বুঝা গেল, এরা সেই স্থল মুক্তিযোদ্ধা নয়, অন্য কেউ। তবে মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চয়। আসলে কমান্ডোরা ফিরতি পথে ঠিক জায়গামতো এসে পৌছতে পারেনি। নদী সাঁতরে তারা চলে এসেছে অনেকটা ভাটিতে। এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের কোনো পূর্ব যোগাযোগ নেই। বিষয়টি পরিষ্কার হবার পর কমান্ডোরা অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাদের পরিচয় দেয়। ফলে, ঘনিয়ে আসা একটি আত্মঘাতি বিপদ অল্পের জন্য পাশ কেটে যায়। কমান্ডোরা এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়েই বেপারি বাড়ির দিকে পা দেয়। দূরে একটি গ্রামের ভেতর থেকে এসময় ক্ষীণকন্ঠে ধ্বনিত হয় আযানের বানী। ভোর হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জ অপারেশনের বিস্তীর্ণ জলসীমায় বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণকারী নৌকমান্ডোরা হচ্ছে: আবিদুর রহমান (দলনায়ক), হাবিবুল হক খোকন, সাইদুর রহমান মননু, এমদাদুর হক, আব্দুর রহিম (ছোট), জসিম উদ্দিন, আবুল, চুননু, রব্বানী, আব্দুর রহিম (বড়), মনোজ, মতিন, সোবহান, আবু মুসা চৌধুরী, গফুর, মাহবুবুর রহমান মিলন, শ্যামল কর্মকার, ওসমান গণি, ফজলু, ফাককী, আজম প্রমুখ। নৌকমান্ডো অপারেশন এবং নৌকমান্ডোরা শৌর্য-বীর্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বীরগাথা।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত