You dont have javascript enabled! Please enable it!

নাজিরপুর যুদ্ধ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) উত্তর সীমান্তে কলমাকান্দা থানার একটি গ্রাম নাজিরপুর। কলমাকান্দা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা। ভারত সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কলমকান্দা থানা সদরের অবস্থান। কলমাকান্দা থানা সদর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে নাজিরপুর গ্রাম। এখান থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদী।
নেত্রকোনা মহকুমা এলাকা পাকিস্তান ৭১ উইং রেঞ্জার্স বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ময়মনসিংহ শহরে ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদর দপ্তর। কলমকান্দা থানা এলাকায় এক প্লাটুন রেঞ্জার্স ফোরস এবং সহযোগী এক প্লাটুন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত টহল দানে নিয়োজিত ছিল।
২৫ জুলাই ১৯৭১ ঢালু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খবর আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি ঘাঁটি থেকে গোলাবারুদ এবং রেশন সামগ্রী কলমাকান্দা থানায় অবস্থানকারী পাক-সেনাদের জন্য নেয়ার প্রস্ততি গ্রহণ করছে। এই সংবাদে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী কমান্ডার নাজমুল হক তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দলকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করেন।
দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি থেকে কলমকান্দা থানা সদরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। যোগাযগের জন্য যানবাহন চলার মতো কোনো পাকা রাস্তা নেই। পাকিস্তানী বাহিনীকে গ্রামের পথেই অগ্রসর হতে হবে। বিরিশিরি থেকে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে নাজিরপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে কলমাকান্দা থানা সদরে যাওয়ার একটি মাত্র গ্রামীণ পথ আছে। এই পথ ধরেই পাকিস্তানী বাহিনীকে অগ্রসর হতে হবে। মাঝপথে বিরিশিরির ৩ কিলোমিটার পূর্বে সোমেশ্বরী নদী। কমান্ডার নাজমুল হক নদীর ৫ কিলোমিটার পূর্বে নাজিরপুর গ্রামের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নাজিরপুর গ্রামটি একটি দুর্গম এলাকা। গ্রামের মাঝ দিয়ে রাস্তা থাকলেও আশেপাশে ছিল জঙ্গল ও ঝোপঝাড়। নাজমুল হক তারা তাঁর কোম্পানির অধীনস্থ কমান্ডার ইপিআর বাহিনীর সদস্য আবদুল গণি এবং পুলিশ সদস্য রহমত উল্লাহর সাথে আলাপ আলোচনা করে পাকিস্তানী বাহিনীকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।
২৫ জুলাই ১৯৭১ সন্ধ্যায় নাজমুল হক তারা মুক্তিযোদ্ধা দলসহ রংড়া ক্যাম্প থেকে নাজিরপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ঐ রাতেই নাজিরপুর গ্রামে পৌঁছান। প্রাথমিকভাবে এলাকার অবস্থান ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর গ্রুপ কমান্ডারদের নিয়ে তিনি আক্রমণের স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি কোম্পানীর সদস্যদের তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করে তিন স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন।
প্রথম গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ জন। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআর বাহিনীর সদস্য আবদুল গণি। এই গ্রুপটি নাজিরপুর বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। দ্বিতীয় গ্রুপের সংখ্যা ছিল ৩০ জন। পুলিশ বাহিনীর সদস্য রহমত উল্লাহ এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। এই দলটি নাজিরপুর গ্রামের পূর্বদিকে গজারমারী গ্রামে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের তৃতীয় গ্রুপটিকে নিয়ে কমান্ডার নাজমুল হক দুই দলের মধ্যবর্তী স্থানে ভবানীপুর কাচারীর সম্মুখে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩০ জন।
তিন দলের অবস্থান ছিল তিনটি পৃথক স্থানে। এক দলের অবস্থান থেকে অন্য দলের অবস্থানটি বেশ কিছুটা দুরে। যোগাযোগের জন্য তাদের সাথে কোনো ওয়্যারলেস সেট না থাকায় ব্যাক্তি মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার সিদ্ধান্ত জানান হয়। রাতের মধ্যেই সমস্ত দল তাদের নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।
নাজিরপুরের জঙ্গলের ভেতরে বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর পাকিস্তানী সেনাদের কোনো সন্ধান না পেয়ে ইপিআর সদস্য আবদুল গণি তার গ্রুপ নিয়ে এম্বুশ স্থল ত্যাগ করে রংড়া ক্যাম্পে ফিরে আসে। পুলিশের রহমতউল্লাহ তার অবস্থানের কাছাকাছি কলমাকান্দা থানা থেকে খাদ্য সামগ্রী বহনকারী ৮ জন রাজাকারকে একরকম বিনা যুদ্ধে বন্দি করে কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন করেন। এর মধ্য থেকে কয়েক জন রাজাকার পালিয়ে ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানিয়ে দেয়।
বেলা ৯ টা নাগাদ নাজমুল হক তারা সামনে এবং পিছনে থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনে সতর্ক হয়ে পড়েন। উভয় পাশ থেকে গুলি ছোঁড়ার মাত্রা বৃদ্ধিতে তিনি নিজেই দলসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে পড়েছেন বলে অনুমান করেন। অল্পক্ষণেই তার অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। দু’দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
অতর্কিত এই আক্রমণে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কারণ যে দু’দিক থেকে অর্থাৎ গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে গুলি আসছে ঐ দু’টি অবস্থানে তাঁর নিজের দু’টি গ্রুপের অবস্থান থাকার কথা। তিনি অবস্থান ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের কারণে সেটা সম্ভব হবে না বিবেচনা করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যরা ক্রলিং করে সন্তর্পণে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স এরিয়াতে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম খানের স্টেনগানের গুলিতে দু’জন পাকসেনা আহত হয়। এল.এম.জি চালক জামাল এল.এম.জি দিয়ে পাকিস্তানীসেনাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। কমান্ডার নাজমুল হক তারা রাস্তার পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলার চেষ্টা করেন।
দুপুরের দিকে পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর এলএমজি পজিশন নির্দিষ্ট করে জামাল এর অবস্থানের ওপর ফায়ার শুরু করে। পাকবাহিনীর গুলিতে ঘটনাস্থলে জামাল শাহাদাতবরণ করেন। বিকেল ৪টা নাগাদ মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হলে কমান্ডার নাজমুল হক তার গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এরপর যুদ্ধের গতি পাল্টে যায়। পাকিস্তানী বাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। কমান্ডার নাজমুল হক আহত অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে আসেন। মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা বিক্ষিপ্ত অবস্থান ছেড়ে আত্মরক্ষা করে ক্যাম্পে ফিরে আসেন।
[৩০] এ এস এম সামছুল আরেফিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!