You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.11 | নারায়ণগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নৌকমান্ডো অপারেশন-১ - সংগ্রামের নোটবুক

নারায়ণগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নৌকমান্ডো অপারেশন-১

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরে ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে সশস্ত্র সংগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা বাংলাদেশকে সম্মুখ যুদ্ধের সুবিধার জন্য ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং সেক্টর কমান্ডার মনোনীত করা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজিবপুর থানা অন্তর্ভুক্ত করে ১১ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় (৫ এবং ৬ নম্বর সেক্টরের মধ্যাঞ্চল) আগস্ট মাসে। প্রাথমিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চলকে ১০ নম্বর সেক্টরের এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে এলাকাটি রণকৌশলগত বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ অনুভূত হয়। তাছাড়া তখন বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) পাকিস্তানের বন্ধভাবাপন্ন ছিল। বার্মার সাথে সীমান্ত থাকার কারণে নতুন শক্র সৃষ্টি করা থেকে বাংলাদেশ বিরত থাকতে সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ নৌ অঞ্চলকে ১০ নম্বর সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। মার্চের ৩০ তারিখ ফ্রান্সের তুলো প্রোতশ্রয় থেকে পালিয়ে আসে ৯ জন বাঙালি সাবমেরিনার। ফ্রান্স থেকে কেনা মোট ৩টি ডেফনে ক্লাস সাবমেরিনের দুটি পিএনএস হাঙ্গর এবং পিএনএস শুশুক ইতোমধ্যেই করাচি পৌঁছে যায়। তৃতীয়টি, পিএনএস ম্যাংগো নামের এই সাবমেরিনটি পরের দিন ৩১ মার্চ পাকিস্তানের করাচি বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। তুলো থেকে পালিয়ে আসা ৯ জনের মধ্যে ৮ জন সাবমেরিনার ভারতে পৌছতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও নৌ বন্দরে তাদের অপারেশন পরিচালনা করার অপার আগ্রহে ভারতীয়রা এক পর্যায়ে একমত হয়। বিভিন্ন রকম জিজ্ঞাসাবাদ ও মতিবিনিময়ের পর ভারতীয় নৌ বাহিনীর উদ্দ্যোগে তাদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ৯ জন নৌ সেনা-সৈয়দ মোশাররফ হোসেনের র‍্যাঙ্ক ছিল ইঞ্জিন রুম আরটিফিসার (ইআরএ)-৪, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর র‍্যাঙ্ক ছিল রেডিও অপারেটর জেনারেল (আরওজি)-১ রহমত উল্লাহর র‍্যাঙ্ক চিফ রেজিও আরটিফিসার, বদিউল আলমের র‍্যাঙ্ক ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক (এমই)-১, আমিনউল্লাহ শেখের র‍্যাঙ্ক ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক (এমই)-১, আবদুর রহমানের র‍্যাঙ্ক ছিল সিম্যান (এবি) এবং আবদুর রকিব মিয়ার র‍্যাঙ্ক ছিল ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক (ইএন)-১। এই ৮ জন সাবমেরিনারকে ভারতীয় নৌ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দিল্লির অদূরে যমুনা নদীতে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এক মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গেও ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীতে নৌ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ২৭ মে পুরণাঙ্গো পরিসরে এ নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। এই ক্যাম্পের অবস্থান, কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সর্বাত্মক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। গোপনীয়তার স্বার্থে পলাশীর এ ক্যাম্পের নাম দেয়া হয় সি ২ পি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের জন্য অচল করে দেয়া এবং অভ্যন্তরীণ নৌ বন্দরগুলোকে ব্যবহার অযোগ্য করে দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্যে নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। মানুষের খাবার, যানবাহনের খাবার (বিভিন্ন প্রকার দাহ্য ও জ্বালানী তৈল) এবং অস্ত্র ও অস্ত্রের খাবার (গুলি, গোলা, বিস্ফোরক ইত্যাদি) জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তথা বঙ্গপোসাগর শক্রমুক্ত রাখা ছিল পাকিস্তানীদের জন্য অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, আভ্যন্তরীন নৌ বন্দরসমূহ ব্যাবহার অযোগ্য করতে পারলে পাকিস্তানীদের সড়ক পথ ব্যাবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে। যেহেতু সারা দেশের রেলপথ অচল করে ফেলা হয়েছিল এবং আকাশ পথে সৈন্য ও রশদ পরিবহন পাকিস্তানীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই তাদের চলাচল প্রধানত সড়ক পথের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে। সড়ক পথে ব্রিজ ও কালভারট ধ্বংস করে এবং পাকসেনাদের অ্যাম্বুশ করে যুদ্ধের ভারসাম্য নিজেদের অনুকূলে আনার লক্ষ্যে নৌ কমান্ডোদের কঠিন ও কঠোর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, গাইবান্ধা ইত্যাদি যেসব এলাকায় সমুদ্র ও নৌ বন্দর রয়েছে সেসব এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের শিক্ষিত ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ তরুণদের নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়। ভারতে অবস্থিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে এ তরুণদের নির্বাচন করা হয়। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে কোনোও বাংলাদেশী নৌ বাহিনীর অফিসার ছিল না সেহেতু প্রধানত ভারতীয় নৌ বাহিনীর সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে পলাশী ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন পরিচালিত হয়। কঠিন নির্বাচন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ৩১৫ জন সুঠামদেহী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে শুরু হয় প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ। মধ্য আগস্টের প্রথম নৌ কমান্ডো অভিযানে এই ব্যাচের মধ্য থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৪টি নদীবন্দরে ৪ গ্রুপে ১৬০ জন কমান্ডোকে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে আরো ২টি ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষনের জন্য সংগৃহীত মোট ৫১০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ২০ জন পলাশী পৌঁছলেও তারা শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিতে পারেনি। এই হিসেবে প্রশিক্ষণ পাওয়া মোট নৌ কমান্ডোর সংখ্যা ৪৯০ জন। এর মধ্যে ৮ জন ফ্রান্সের তুলো থেকে পালিয়ে আসা সাবমেরিনার, যারা পলাশীতে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব দেয়াসহ বিভিন্ন নৌ অভিযানেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অফিসাররা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও নৌবাহিনীর কোনো অফিসার পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। বরং ২৫ মার্চ ও তার (স্বেচ্ছায় বাঁ বাধ্যগতভাবে) পাকিস্তান চলে যান। নৌকমান্ডো এবং নৌবাহিনী গঠনের বিষয়ে সার্বিক দায়িত্ব পালন করে ভারতীয় নৌ ও সেনাবাহিনী। অপারেশনে যাবার আগে বিদায়বেলা অপারেশন সফল করার জন্য প্রতিজন নৌকমান্ডোকে সাথে দেয়া হয় একটি সুমিং কস্টিউম, দুটি করে লিমপেট মাইন, একজোড়া ফিনস, একটি ধারালো ছুরি ও হ্যান্ড গ্রেনেড। কয়েকটি দলে বিভক্ত নৌকমান্ডোদের প্রতিটি দলের সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় গুলিও দেয়া হয়। এর সাথে পথ-খরচের জন্য কিছু পাকিস্তানী টাকা। সবশেষে, দলনেতাদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেয়া হয় একটি করে একব্যান্ড ট্রানজিস্টার। নৌকমান্ডো অপারেশন আওতায়ভুক্ত স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের সকল নদী ও সমুদ্রবন্দর। এই পরিকল্পনার আওতায় মধ্য আগস্টের সূচনালগ্নে চারটি প্রধান নদী ও সমুদ্রবন্দরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, মঙ্গলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জের নৌবন্দরসমূহ। পলাশীতে নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ শেষ হবার আগেই অপারেশনের অভিযান-পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং পরিকল্পনা প্রণয়নের মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অপারেশন চালানোর জন্য বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলো চিহ্নিতকরণ ও নদ-নদীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট সময়ের চন্দ্রতিথি, জোয়ার-ভাটা, বাতাস ও স্রোতের গতি-প্রকৃতি প্রভৃতি নানাবিধ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা হয়। বন্দরগুলোতে জাহাজের অবস্থান এবং সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের তৎপরতা সম্পর্কেও বিশদ খোঁজখবর নেয়া হয়। এসময় বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরগুলোর আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তার কারণে সাধারণ নৌ-চলাচলের ওপর কোথাও কোথাও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোট নিয়ে নদীবন্দর, বিভিন্ন মোহনা এবং নদীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রায় নিয়মিত টহল অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানীদের এই শকুনচোখা টহল যানগুলোকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে নৌ-অপারেশন চালানো যাবে, অপারেশনের সময় বা অপারেশনে যাওয়া-আসার পথে নৌকমান্ডোরা কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারে কিংবা বন্দর রক্ষায় পাকিস্তানীরা কোথায় কোথায় অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে। সমূহ বিষয়াবলি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা হয় পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়। অনেক আলাপ-আলোচনা এবং পক্ষে-বিপক্ষে সবদিক বিবেচনার পর অবশেষে অপারেশন কার্যক্রম শুরু করার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৪ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মান বাহিনী দখলিকৃত ফরাসি উপকূলে মিত্রবাহিনীর গোপন অভিযান পরিচালনার সময় রেডিওতে অনুষ্টান প্রচারের ভেতরে এই রকম সাংকেটিক সঙ্গীত ব্যবহার করে হয়েছিল। বিবিসি থেকে সম্প্রচারিত গানের সংকেত অনুসরণ করে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন মিত্রবাহিনীর দেড় লক্ষাধিক সৈন্য অবাধে অবতরণ করে ফ্রান্সের নরমান্ডি উপকূলে। দিল্লিতে ভারতীয় সমরবিদরা অনুরূপ সাংকেতিক সঙ্গীত বেছে নিয়ে তা সবিস্তারে বুঝিয়ে দিল পালিয়ে আসা সাবমেরিনারদের। তাদেরকে বলা হয়, মূল অপারেশন শুরু হবার কয়েকদিন আগে থেকেই আকাশবাণীর সঙ্গীতানুষ্টানগুলো মনোযোগ সহকারে নিয়মিত শুনতে। আকাশবাণী কলকাতার ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত নিয়মিত সাধারণ অনুষ্টানের একটি বিশেষ সময়ে বাজানো হবে প্রথম গানটি। তবে ঠিক ক’টায় এ গান বাজানো হবে, সে ব্যাপারে কোনো আগাম তথ্য দেয়া হলো না। তবে নির্দেশ থাকল, প্রথম গানটি শোনার সাথে সাথেই অপারেশন শুরু করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এমনকি প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেয়ার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে। দ্বিতীয় গান বাজানো হবে একই বেতারকেন্দ্র থেকে, প্রথম গান বাজানোর ঠিক চব্বিশ ঘন্টা পর। গান দুটি শোনার জন্য প্রয়োজনীয় বেতারযন্ত্র সময়মতোই তাদেরকে দেয়া হবে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়। শেষ এই গানটি শোনার পর সাথে ট্রানজিস্টার রাখার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যাবে। তখন এটি ফেলে দিলেও চলবে। কিন্ত দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ গান শোনার সাথে সাথে শক্র পক্ষের নির্দিষ্ট টার্গেটগুলোতে আঘাত করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং ওইদিন মধ্যরাতেই পরিস্থিতি যতো প্রতিকূলই হোক, নির্দ্বিধায় পানিতে নেমে পড়তে হবে। রাত একটা থেকে দুইটার মধ্যে অভিযান শুরু করার সময়সীমা নির্ধারিত। কাজেই, শেষ গান শোনার পর এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে অপারেশন শুরু করতে হবে। এর আগে টার্গেট নির্দিষ্ট করার কাজ সেরে রাখতে হবে দিনের আলোতে। প্রয়োজনে অপারেশনে নামার আগে সেসবারের মতো টার্গেটগুলো দেখে নেয়া যেতে পারে। কিন্ত অপারেশন থেকে পেছানো যাবে না কোনো অবস্থাতেই। ৭ আগস্ট অন্য দলগুলোর সাথে নারায়ণগঞ্জ অপারেশনের জন্য নির্ধারিত কমান্ডোদেরকে পলাশীর প্রশিক্ষণ-ক্যাম্প থেকে সড়কপথে নিয়ে আসা হয় ব্যারাকপুরে। পরদিন দমদম বিমান বন্দর হয়ে আকাশপথে তারা এসে পৌঁছে আগরতলা। ভারত ভূখণ্ডের মধ্যে আগরতলাই হচ্ছে শেষ ঘাঁটি। তাদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য এখানে রয়েছে নিউক্যাম্প নামে একটি স্বতন্ত্র ক্যাম্প। আগরতলার নিউক্যাম্পে পৌঁছার কিছুক্ষণ পর ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন অফিসার কমান্ডোদলের নেতা আবিদুর রহমানকে একাকী আড়ালে ডেকে নিয়ে যান এবং অপারেশনের যাবতীয় নির্দেশাবলী শেষবারের মতো বুঝিয়ে দেন। তিনি তার কোটের পকেট থেকে একটি ছোট ট্রানজিস্টার বের করে আবিদের হাতে দিয়ে অন্য দলনেতার মতো তাকেই এর আগে দিল্লিতে বাজিয়ে শোনানো সাংকেতিক গান দুটির কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। এরপর নিউক্যাম্পে ফিরে এসে কমান্ডোদলের সামগ্রিক অস্ত্রশস্ত্র, মাইন এবং সাজসরঞ্জামও তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। অপারেশনের মূল অস্ত্র হিসেবে তার দলের মোট ২০ জন কমান্ডোর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক লিমপেট মাইন দেয়া হয়। নারায়নগঞ্জের শেষ আশ্রয়স্থল পর্যন্ত পথ চিনিয়ে নেবার জন্য সাথে দেয়া হলো গাইড। ৮ আগস্ট রাতেই এই দল সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে অবরুদ্ধ স্বদেশের মাটিতে। যাত্রাপথের নিরাপত্তার কথা ভেবে অন্য দলগুলোর মতো তাদেরকেও অনেক ঘুরপাক ধরে এগোতে হয় নারায়ণগঞ্জের দিকে। তবে পথে বড় ধরনের কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। ফলে, শেষ আশ্রয়স্থল পর্যন্ত পৌছতে এই দলের সময়ও লাগে অনেক কম। অন্য দলগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামমুখি কমান্ডো দলটিকেই যাত্রাপথেই সব থেকে বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের যাত্রাপথের গোটা আয়োজনটাই ছিল জটিল এবং একই সাথে বিপদসংকুল। কিন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ ও কষ্ঠের পথ অতিক্রম করতে হয় মংলা বন্দরের জন্য নির্বাচিত কমান্ডোদলকে। এই দলের যাত্রাপথে পুরাটাই ছিল নৌপথ। কিন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দরের জন্য নির্ধারিত দলটি অত্যান্ত অল্পসময়ের মধ্যেই তাদের আশ্রয়স্থলে এসে পৌঁছে যায়। এত অল্পসময়ের মধ্য আগস্টের প্রাথমিক ধাপের অভিযানে আর কোনো দল লক্ষ্যস্থলে পৌছাতে পারেনি। এই দল নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছে ১১ আগস্ট। বন্দরের কাছাকাছি একটি বাড়িতে তারা আশ্রয় নেয়। অপারেশন শুরু করার জন্য তখনো অনেক সময় বাকি। নির্দিষ্ট সংকেত না শোনা পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই অপারেশন শুরু করা যাবে না। এই সংকেত কেবল দলনায়েকই টের পাবে। আর কারোই তা জানবার কথা নয়। আশ্রয়স্থলে পৌঁছার পর থেকেই কমান্ডোরা অপারেশনের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তারা দলনায়ককে এ ব্যাপারে তাড়া দিতে থাকে। কিন্ত আবিদুর রহমান তার সিদ্ধান্তে অটল। অপারেশন এখনই শুরু করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বন্দর এলাকায় কয়েক দফা রেকি করা হয়েছে। প্রতিদিনই সন্ধানী দল পাঠানো হচ্ছে সেখানে। দলনায়ক নিজেও কয়েকবার বন্দর পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেখানে জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিনই ওঠানামা করছে। বিভিন্ন স্থান থেকে জাহাজ আসছে। মালামাল খালাস হয়ে যাবার পর কোনো কোনোটি ফিরে যাচ্ছে অন্যত্র। দু-একটি অজ্ঞাত কারণে তারপরেও নোঙ্গর করে থাকে নদীর মধ্যে। কোনো কোনো জাহাজ থেলে মালমাল খালাসই করা হয়নি। সেগুলো বন্দরের জেটিতেই ভেড়ানো আছে। এখন যে কোনো রাতেই অপারেশন চালানো যায়। কিন্ত তা সম্ভব হচ্ছে না প্রয়োজনীয় সংকেত না পাবার কারণে। দলনায়ক সর্বক্ষণই ছোট ট্রানজিস্টারটি তার কাছে কাছে রাখেন। বিশেষ সময়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কলকাতা কেন্দ্রের বাংলা সঙ্গীতানুষ্টানগুলো শোনেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সঙ্গীতটি যেন আর শোনা যায় না। অপারেশনের জন্য কমান্ডোরা দিন দিন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বিরক্তও হচ্ছে দলনায়কের ওপর। দলনায়ক নিজেও মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। অবশেষে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর ইথারে ভেসে এলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সুরেলা কন্ঠ ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি’। অনেকের সাথে দলনায়কও শুনলেন গানটি। তবে এর সাংকেতিক অর্থ এই মুহূর্তে তিনি ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারল না। প্রথম গান শোনার সাথে সাথেই আবিদুর রহমানের মধ্যে চাপা উত্তেজনা শুরু হতে থাকে। আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা। এরপর নিশ্চয়ই অপর গানটিও শোনা যাবে। এই সময়ের মধ্যে আরেকবার সন্ধানী দল পাঠাতে হবে বন্দরের দিকে। কেননা আগের দিনের রেকি করা জাহাজের অবস্থান সময়ের ব্যবধানে পালটে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অপারেশন চালাতে গিয়ে বিভ্রান্তির শিকার হবে কমান্ডোরা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে প্রথম গান শোনার পরদিন বন্দরে সন্ধানী দল পাঠানো হয়। সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় গানটিও শোনা যাবে এবং সে রাতেই চালাতে হবে অপারেশন। দলনায়ক গান শোনার পর কমান্ডোদের নিয়ে পরামর্শ-বৈঠকে বসলেন। বৈঠকে তাদেরকে আভাস দেয়া হলো যে, খুব শিগগির সকল উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষার অবসান ঘটবে। আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা পর অপারেশনের জন্য পুরাপুরি প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পরদিন সকালে শেষবারের মতো রেকি করা হয় বন্দরে। দলনায়ক আবিদ নিজেও দেখে এলেন কোথায় কোনো জাহাজ অবস্থান করছে। মোট পাঁচটি জাহাজ রয়েছে বন্দরে। জাহাজগুলো ধ্বংসের জন্য প্রতি গ্রুপে তিনজন করে ১৫ জন কমান্ডোই যথেষ্ট। একটি জাহাজে ৩টি করে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেয়া সম্ভব হলে এবং সেগুলো ঠিকমতো বিস্ফোরিত হলে কোনো জাহাজই পানির ওপর ভেসে থাকতে সক্ষম হবে না।
১৫ আগস্ট। সন্ধ্যার পর ট্রানজিস্টারে দ্বিতীয় গানটিও যথারীতি শোনা গেল ‘আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান’। দলনায়ক এবার তার সঙ্গীদের শেষ নির্দেশ দিলেন চূড়ান্তভাবে তৈরি হবার জন্য। ৫ জন কমান্ডো ডাঙ্গায় রেখে বাদবাকি পনেরোজনকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হলো। এর এক ভাগে অন্তর্ভুক্ত হলেন দলনায়ক নিজে। পাঁচটি দল বন্দরের পাঁচটি জাহাজে মাইন লাগানোর জন্য পানিতে নামবে। স্থলভাগের কমান্ডোরা নদীর তীরে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকবে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য। রাত ১২টার দিকে কমান্ডোদল অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্প থেকে। নারায়ণগঞ্জের পূর্ব পাড়ে সোনাকান্দা গ্রামের ভেতর দিয়ে বন্দর সোজা নদীর পাড়ে এসে তারা পৌঁছে। এই স্থানটির দুদিকে অত্যান্ত কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থান করছে পাকিস্তানীরা। তা সত্ত্বেও এই বিপদসংকুল স্থান বেছে নেয়া হয় অপারেশনের জন্য। জায়গাটি অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলে টার্গেট স্থলের দূরত্ব এখান থেকে অনেকটা কাছে। নদীর পাড় ধরে পাকা রাস্তা। রাস্তার ডানপাশে পাকিস্তানীদের অবস্থান আড়াক করে এক পাশে দারিবদ্ধ দোকানের পেছনে এসে জড়ো হয় কমান্ডোরা। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। ওপারে বন্দরের তীব্র আলো। এ আলোর ক্রমহ্রাসমান আভাস এপারেও এসে পড়েছে। তবে রাস্তার পূর্ব পাশের দোকানবহরের দিকটা মোটামুটি অন্ধকার। এই অন্ধকার গলিয়ে তিনজনের ৩টি গ্রুপকে নিঃশব্দে নামিয়ে দেয়া হয় নদীতে। তারা ফিনস পায়ে ডুবসাঁতার দিয়ে এগিয়ে যায় বন্দরের দিকে। পেছনে দুটি গ্রুপ তখনো অবস্থান করছে। দোকানের আড়ালে। দলনায়ক নিজেও রয়েছেন গ্রুপগুলোর সাথে। এই গ্রুপ দুটি প্রস্তুতি নিয়ে দোকানের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসামাত্রই কোত্থেকে অস্ত্র হাতে এক রাজাকার সেখানে এসে হাজির। একটি রাইফেল তার কাঁধে ঝুলানো। এর আগে যে পথে রাস্তা অতিক্রম করে কমান্ডোদের তিনটি গ্রুপ নদীতে নেমে গেছে, রাজাকারটি ঠিক সেখানে এসে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাকডাক শুরু করে দেয়। নির্জন অন্ধকার নদীর তীরে রাজাকারটি সম্ভবত নিজেও ভয় পাচ্ছে। এই ভয় তাড়ানোর জন্যই সে বিরতি দিয়ে একটু পরপরই হাক দিতে থাকে। অল্প পেছনে দোকানের আড়ালে কমান্ডোদের অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। খুবই বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক অবস্থা। রাজাকারটি একেবারেই নড়ছে না। কাঁধে ঝুলানো রাইফেলের বাটে একহাত রেখে সে নির্বিকার এবং নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। তার মুখ কোনাকুনি নদীর দিকে। পেছনে দোকানের আড়ালে অধৈর্য অপেক্ষায় প্রহর গুণছে কমান্ডোরা। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। অগ্রবর্তী তিনটি গ্রুপ ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আর অপেক্ষা করা চলে না। রাজাকারটিও যে শিগগিরি এই স্থান ত্যাগ করবে, এমন মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় কমান্ডোরা তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এ ছাড়া আর কোনো সহজ উপায় নেই পথ পরিষ্কার করার। দোকানের আড়ালে আবছা অন্ধকারে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস আলাপ করে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। রাজাকার খতম করার দায়িত্ব নিলেন স্বয়ং দলনায়ক আবিদ। সম্ভাব্য পাল্টা হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হলো সঙ্গীদের। রাজাকার হত্যা করার কাজ সারতে হবে নিঃশব্দে। খুব কাছাকাছি রয়েছে পাকিস্তানীদের সতর্ক অবস্থান। সামান্য শব্দ কিংবা চিৎকার হলেই বড় ধরনের বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। কাজেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। ওকে খুন করতে হবে ছুরি দিয়েই। দলনায়ক তার দলবলসহ আরো একটু কাছাকাছি এগিয়ে আসেন রাজাকারের দিকে। তারপর তিনি তার কোমর থেকে টেনে বের করে আনেন জাহাজের শ্যাওলা পরিষ্কার করার ছুরিটি। প্রচণ্ড ধারালো ইস্পাতের ছুরি। সঙ্গীদের পেছনে রেখে শক্তহাতের মুঠোয় ছুরি চেপে ধরে আবিদ ক্রলিং করে এগিয়ে যান রাস্তার দিকে। রাস্তার ওপর দাঁড়ানো রাজাকারটিও যেন ধরা দেবার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছে। সবকিছুই ঘটে যাচ্ছে তার অজ্ঞাতে। নিঃশব্দে ক্রলিং করে আবিদ যখন রাস্তার কিনারে এসে পৌছেন, ঠিক সেই সময় সামনের উল্টাদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা রাজাকার তার কাঁধ থেকে ঝুলন্ত রাইফেলটি নামিয়ে এনে দুপায়ের মাঝামাঝি হেলান দিয়ে রাখে। সে এখন বিড়ি ধরাবে। ঠোটের সাথে চেপে রাখা বিড়িতে আগুন দেবার জন্য দিয়াশলইয়ের কাঠি জ্বালাবার সাথে সাথে আবিদ একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর। তিনি প্রথমেই এক ঝাটকায় রাইফেলটি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নেন। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, রাজাকারটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুদিক থেকে দুটি স্টেনের ঠন্ডার স্পর্শ তার ঘাড়ে এসে ঠেকে। এই অসহায় অবস্থার মধ্যে অনিবার্য মৃত্যুভয়ে হাউমাউ করে সে কেঁদে ওঠে। কমান্ডোদের হাত পা জড়িয়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়ে ব্যাকুল হয় রাজাকারটি। শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হলো না। নতুন পরিকল্পনা মাথায় আসে কমান্ডোদের। তারা ছিনিয়ে নেয়া রাইফেলের গুলি বের করে সেটা আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়। মৃত্যুভয়ে রাজাকার তখন যে কোনো নির্দেশ মেনে নিতে রাজি। তাকে বলা হলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আগের মতোই হাকডাক দিতে যাতে গটা পরিস্থিতি পূর্বাপর স্বাভাবিক থাকে। হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় নির্দেশ মতো কাজ না করে কোনো চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হলে পেছন থেকে গুলি করা হবে তাকে। এরপর স্থলভাগের কমান্ডোরা আবার গিয়ে আশ্রয় নেয় দোকানের আড়ালে। আর নৌকমান্ডোদের ৩ জনের দুটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে থাকা রাজাকারের সামনে দিয়েই ফিনস পায়ে লাগিয়ে নেমে যায় নদীতে। অবস্থাটি এখন এই রকম যেন রাজাকারটি পাকিস্তানীদের জাহাজ ধ্বংস করতে যাওয়া কমান্ডোদের পাহারা দিচ্ছে। সে গুলিবিহীন রাইফেল হাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। পেছনে দোকানের আড়ালে কমান্ডোদের স্টেনগানের ব্যারেল তখন তার দিক এতাক করে আছে, বুঝি এটা সে বুঝতে পারে। এই রাজাকার তখনো জানে না তার সামনে বন্দরের নদীতে কী ঘটতে যাচ্ছে। উদোম শরীরের নিরস্ত্র কমান্ডোরা সাঁতার কেটে এভাবে কোথায়ই বা যাচ্ছে। মাঝপথের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবার আগেই কমান্ডোদের যে ৩ টি গ্রুপ নদীতে নেমে যায়, তারা ততক্ষণে যার যার জাহাজে মাইন লাগানো শেষ করেছে। এরপর বিলম্বিত গ্রুপ দুটিও নির্বিঘ্নে জাহাজে মাইন বসিয়ে দেয় এবং দ্রুত সাতরিয়ে ফিরে আসে নদীর পূর্ব পাড়ে। সেখানে দোকানের পেছনে তারা আবার একত্রিত হয়। ক্যাম্পের দিকে ফিরে যাবার সময় হটাৎ তাদের চোখ পড়ে রাস্তার ওপর। সেখানে রাজাকারটি নেই। কোনো ফাকে সে সটকে পড়েছে তাড়াহুড়ার মধ্যে কেউ খেয়ালই করেনি। ঠিক এই সময় নদীতে বিস্ফোরণ শুরু হয়। বন্দরের সমুদয় জলরাশী এবং দুই পাড় প্রকম্পিত করে পরপর ১৫টি মাইনই বিস্ফোরিত হলো। এর সাথে ভীতবহবল পাকিস্তানীদের গোলাগুলিতো আছেই। সাথে বিকট শব্দে বেজে ওঠে সাইরেন। সব মিলিয়ে এখানেও সৃষ্টি হলো এক প্রলয়ঙ্কারী অবস্থা, যে অবস্থা ওই রাতে প্রায় একই সময় সৃষ্ট হয় বাংলাদেশের আরো তিনটি নৌবন্দরে। শেষ পর্যন্ত কমান্ডোরা একটি গুলি খরচ না করে নিরাপদে ফিরে আসে আশ্রয় ক্যাম্পে। পালিয়ে যাওয়া ভীত রাজাকারটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছে। পরদিন সকালে আবিদ একজন সঙ্গী সাথে নিয়ে বন্দরের পরিবর্তিত অবস্থা পর্যবেক্ষণে যান। গতত্রাতের অপারেশনের সফলতার খবর তারা পথিমধ্যেই শুনতে পায়। লিমপেটের মাইনের আঘাটে বন্দরে ৫টি জাহাজ ডুবে গেছে। এই খবরে অপরিসীম আনন্দে ভরে ওঠে তাদের বুক। তারা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটি ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায়। গতরাতের সেই বেঁচে যাওয়া রাজাকার পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসে কাছে। প্রকাশ্য দিনের আলোতে তাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে আতঙ্কিত হয় কমান্ডোরা। কিন্ত একটু পরেই বোঝা গেল বিপদের তেমন কিছু নেই। অজ্ঞাতনামা এই রাজাকার কাছে এসে আশ্বাস দিয়ে জানায় যে, সে তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। সম্ভব হলে উপকারই করবে। শেষ পর্যন্ত সে তার কথা ভঙ্গ করেনি। দলনায়ক আবিদ তার সঙ্গী এবং রাজাকারটিকে নিয়ে কথা বলতে বলতে নদীর পাড় ধরে হেঁটে এগোচ্ছেন। আশপাশের কোনো লোক তাদের সন্দেহ করছে বলে মনে হয় না। আবিদ সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন চারদিকে। সহসা তিনি লক্ষ্য করলেন, সামনে একটি রিকশায় দুজন পাকিস্তানী সৈন্য এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সাথে রাজাকারের ভূমিকা নিয়ে তিনি এবার চিন্তিত হলেন। রাজাকারটি বিশ্বাসঘাতকতা করবে নাতো! রিকশাটি তাদের কাছাকাছি এসে থামে। দুজন সৈন্য রিকশা থেকে নামতে নামতে হাতের ইশারা রাজাকারকে ডাকে। নিশ্চয়ই সে তাদের পরিচিত। আতঙ্ক বুক দুরু দুরু করতে থাকে কমান্ডোদের। আবিদের পকেটে একটি পিস্তল আছে। গুলি ভরাই তাতে। কিন্ত সঙ্গীটির কাছে কোনো অস্ত্র নেই। আবিদ মনে মনে প্রস্তুত হলেন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। কিন্ত না, তেমন কোনো বিপদ ঘটল না এখানেও। রাজাকারের সাথে দু-একটি কথা বলে সৈন্যরা আবার রিকশায় চেপে বসে। কমান্ডোদের সামনে দিয়ে রিকশা এগিয়ে যায়। এরপর রাজাকারের সহায়তায় তারা নির্বিঘ্নে হেঁটে চলে আসে নিরাপদ এলাকার দিকে। ১৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ বন্দরে নৌকমান্ডো অপারেশন ৫টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ অপারেশন পাকিস্তানীদের বিশ্বাসের ভীত নাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভশনে প্রচারিত হয় ১৫ আগস্টের বাংলাদেশের ৪টি বন্দরের জাহাজ ডুবানোর সংবাদ। টেলিভিশনে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। উল্লাসিত ও উৎসাহিত হয় নৌকমান্ডোরা।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত