You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.30 | নাগরপুর যুদ্ধ, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

নাগরপুর যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল জেলার সর্ব দক্ষিণে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার উত্তরে নাগরপুর থানা। বাঘা সিদ্দিকী এবার নাগরপুর আক্রমণের দিন স্থির করলেন ৩০ নভেম্বর। এর আগে কয়েকবার এই এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে কিন্ত চরম জয়লাভ সম্ভব হয়নি। তাই এবার সেরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণের উদ্যোগ করা হলো। মোস্তফা সাইদুল মালেক খোকার কোম্পানি গুলির বাছাই করা ছেলেদের একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করা হলো। এর সঙ্গে থাকলো স্বয়ং বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিদ্দিকির ক্র্যাক সেনাদল ও সবুর খানের বেপরোয়া মুক্তিযোদ্ধারা। এই অমিত বিক্রম মুক্তিবাহিনী নাগরপুর আক্রমণ করলো। সকাল ১০টায় কুড়িটি এলএমজি একটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও একটি রকেট লাঞ্চার নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে হামলা চালানো হয়। নাগরপুর ঘাঁটিটি শক্রর জন্য বেশ সুবিধাজনক অবস্থান। সামনে সমতল ভূমি আশেপাশে বাড়িঘর। কিন্ত শক্রর প্রতিরক্ষার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে স্বয়ং বাঘা সিদ্দিকীর পরিচালনায় মুক্তিবাহিনী ইয়া আলী ও জয় বাংলা ধ্বনি নিয়ে অগ্নিবর্ষণ শুরু করল। বাঘা সিদ্দিকী তীর বেগে ছুটে দুশমনের ঘাঁটির বিশ গজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে প্রচন্ডভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। মর্টার, এলএমজি, রকেটের কর্ণ বিদারী শব্দে জনপদ কেঁপে উঠতে থাকে। পাকসেনাদের দলে ছিল এক কোম্পানি মিলিশিয়া ও শতাধিক রাজাকার। তারা বাংকারের মধ্যে থেকে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। কিছুতেই দুশমনকে ঘায়েল করা যাচ্ছে না দেখে সিদ্দিকি সরে এসে ৮৩ মিলিমিটার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা বর্ষণ শুরু করলেন। দুইটি গোলার আঘাতে দুশমনদের বাংকার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কিন্ত সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ৬ জন শক্র সেনা নহত হল। মুক্তিবাহিনী এর মধ্যে আর একটু সুবিধাজনক স্থানে এগিয়ে গেল। কিন্ত দুশমনকে কাবু করা অসম্ভব ব্যাপার মনে হলো, কারণ তারা মাটির তলায় কংক্রিটের ব্যাংকারের মধ্যে নিরাপদে বসে আত্মরক্ষা করেছিল। এখানকার জনসাধারণের মধ্যে কিছু সংখ্যক পাকবাহিনীর গুপ্তচরের কাজ করেছিল। মুক্তিবাহিনী দুশমনদের এত কাছে গিয়ে ছিল যে সেখান থেকে পা তুলে পিছনে আসা সম্ভব নয়। তাই সারাদিন ধরে নিস্ফল গোলাগুলির বিনিময় হল। ক্রমে রাত নেমে এল। শীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট হবে মনে করে স্থানীয় কিছু দেশভক্ত লোক নিজেদের বাড়ি থেকে কাথা কম্বল এনে দিল। সকালবেলা বাঘা সিদ্দিকী নতুনভাবে আক্রমণ পরিচালনা করলেন। কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ন গ্রেনেড নিক্ষেপকারী রাইফেল নিয়ে শক্রঘাটির উপর হামলা চালালেন। সবুর ও মোস্তাফা কলেজ ও বাজারের দিক থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে কলেজ ও বাজার দখলে আনলো। অন্যদিকে হুমায়নের পাহাড়ি গ্রেনেড আক্রমণের তীব্রতায় শক্রর বাংকার চুরমার হতে লাগলো এবং শক্র সেনাদের ভবলীলা সাঙ্গ হল। এর মধ্যে শক্রর একটি গোলা এসে হুমায়ন পাহাড়ি শামসু ও তার একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আহত করল। আক্রমণ তবুও অব্যাহত গতিতে চলছে। মুক্তিবাহিনীর মর্টার শেল ও রকেট আক্রমনের শক্রপক্ষ পরাজয়ের সম্মুখীন। এমন সময় বেলা সাড়ে তিনটায় সংবাদ এল যে নাগরপুরের অবরুদ্ধ হানাদারদের সাহায্যের জন্য এক ব্যাটেলিয়ান পাকসেনা টাঙ্গাইল থেকে নাগরপুরের দিকে আসছে। এরা যে আসতে পারে সে কথা বাঘা ভেবে সিদ্দিকী এদের পথ রোধ করার জন্য এলাসিন খেয়াঘাটে রবিউলের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিসেনা মোতায়েন করেছিলনে। কিন্ত শক্রর কথা চিন্তা তিনি নাগরপুর যুদ্ধের নেতৃত্বে সিনিয়র কমান্ডার মোস্তফার উপর ন্যাস্ত করে নিজের দল ও সবুরের দল নিয়ে এলাসিয়ানের দিকে রওনা হলেন। মোস্তফার উপর দায়িত্ব দেওয়ার কারণ সে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন দক্ষ সাহসী সৈনিক। এর আগে সে প্রত্যেকটি যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঘা সিদ্দিকী দ্রুত গতিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন এলাসিন ঘাঁটের কাছে পৌঁছলেন তখন তার মনে হয়েছিল যে সামনে যখন এক কোম্পানি মুক্তিসেনা আছে এবং তাদের সঙ্গে যখন এখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি তখন নিশ্চয়ই পাকসেনারা এখনো অনেক দূরে আছে। কিন্ত তিনি যখন ঘাটের খুব কাছে এলেন তখন ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি এসে তার কাছাকাছি পড়তে লাগলো। তিনি তখন শুয়ে পড়লেন। কিন্ত হাজার হাজার গুলি এসে তার আশেপাশে পড়তে লাগলো। সামনে বা পাশে আড়ালে করার কোনো জায়গা নেই, কাজেই গড়িয়ে তিনি খালের মধ্যে পড়লেন। সিদ্দিকীর পাশের অবস্থানের বেনু মির্জা শক্রর গুলিতে আহত হয়। এই বিপজ্জনক অবস্থায় বাঘা সিদ্দিকী তাকে ছেড়ে সবাইকে পিছু হটে যেতে বললেন। কিন্ত সবাই তীব্রভাবে জানালো অধিনায়ককে বিপদে মুখে ছেড়ে তারা কোথাও যাবে না। সবুর একটা টিলার আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। সে যখন দেখল যে তার সর্বাধিনায়ক মহাবিপদের সম্মুখীন তখন সে ডান পাশে সরে গিয়ে একটু আড়াল থেকে চীনা এক এমজি দিয়ে কভারিং ফায়ার চালাতে লাগলো। তার সঙ্গে সামসুও যোগ দিল তার সব মেশিনগান নিয়ে। দুশমনরা নদীর ওপার থেকে এসএমজি চালাচ্ছে। একদল নদী পার হয়ে একটি চরে অবস্থান নিয়েছে এবং আর একটি দল গুলির আচ্ছাদনের মধ্যে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছে। সবুর আক্রমণ চালাচ্ছে দেখে দুশমনরা এবার সবুরের দিকে ধাবিত হলো। ইতোমধ্যে বাঘা সিদ্দিকী তাঁর আহত সঙ্গীকে নিয়ে একটু নিরাপদ স্থানে সরে গেলেন। শক্র সেনাদের দুটি দল ইতোমধ্যে নদী পার হয়ে সবুরকে পাকড়াও করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। এ অবস্থায় সবুর ও শামসু হাঁটতে বাধ্য হলো। বাঘা সিদ্দিকী ও সবুর মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নগরপুরে মোস্তফাকে নির্দেশ পাঠানো হলো যে তারা যেন আর আক্রমণ না চালিয়ে পিছু হটে আসে। এলাসিনে রবিউলের কোম্পানীকে পাকসেনাদের পথরোধ করার জন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্ত সে যে কান্ড করলো তা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের কলঙ্কের কথা। রবিউল খানসেনাদের শক্তি উপলব্ধি করে তাদের উপর কোনো রকম আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে রাজী নয়, তারা রবিউলকে চাপ দিতে থাকে হামলা চালাবার জন্য, কিন্ত হামলা করা তো দূরের কথা সে তার দলবল নিয়ে এলাসিন থেকে পালিয়ে যায়। তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা তবুও দুশমনদেরকে বাঁধা দিয়েছিল, কিন্ত ২০ মিনিটের যুদ্ধে দু’জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করে। ভীরু রবিউল শহীদদের লাশ উদ্ধার না করেই পলায়ন করলো, যা মুক্তিযোদ্ধাদের নীতির বিরোধী। কেদারপুরে অবস্থান করছিলেন বাঘা সিদ্দিকীর বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ারুল আলম ও নুরুন্নবী। তারা সিদ্দিকীর কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে সারারাত জেগে কাটালেন। রাতে রবিউলের কাছ থেকে একটা সিগন্যাল এল সর্বাধিনায়ক দুশমনের হামলার মুখে পড়েছিলেন, তারপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই মহাচিন্তায় মগ্ন। সকালবেলা সবুর ও বাঘা সিদ্দিকীর দলের ছেলেরা এসে সংবাদ দিল যে সর্বাধিনায়ক বিপদমুক্ত। তিনি অন্য কোথাও নিরাপদে আছেন। বাঘা-সিদ্দিকী আহত বেণু মীর্জার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাঁর দলের ফজলু ও অন্যান্যদের খুঁজছিলেন এবং জানতে পারলেন যে সবুরসহ সকলে নিরাপদে চলে গিয়েছে। তিনি একটু নিশ্চিত হয়ে এলাসিন ঘাঁট থেকে দুজন শহীদের লাশ উদ্ধার করে কেদারপুরের দিকে রওনা হলেন। পথে তিনি দেখতে পেলেন যে পাকবাহিনী নাগরপুর থেকে অবরুদ্ধ সৈন্যদের নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে চলছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রায় ৫০ আহত সেনা এবং কয়েকটি শাল। সিদ্দিকীর ইচ্ছা হলো ওদের উপর আর এক বার আক্রমণ চালানোর, কিন্ত তখন তার সঙ্গে ছিল মাত্র সাত জন মুক্তিযোদ্ধা। কাজেই তাকে এমন ইচ্ছা দমন করতে হল।
[৫৯৫] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত